অভিনেতা হওয়ার গুণ কী? চিত্রনাট্য অনুযায়ী তিনি মানানসই হয়ে ওঠেন। তাঁর শরীরী ভাষা, বাচনভঙ্গি, অভিব্যক্তি প্রকাশ, পোশাক চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখলে, কথা শুনলে তাঁকে অভিনেতা ভেবে বিভ্রম হওয়া স্বাভাবিক। স্বাধীনতা দিবস কিংবা সাধারণতন্ত্র দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে তাঁর কথা শুনলে মনে হবে, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বা বাবাসাহেব আম্বেদকরের আশীর্বাদ নিয়ে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন। আর নির্বাচনীসভায় আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তাঁর বক্তৃতা শুনলে মনে হবে, দেশের গরিব দুঃখীদের জন্য কতটা প্রাণ কাঁদে এই প্রধানমন্ত্রীর! সাধারণতন্ত্র দিবসের দিন প্রতিবছর ‘থিম’ অনুযায়ী তিনি যেমন পোশাক পাগড়িতে বদল আনেন, তেমনই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুযায়ী তাঁর বক্তৃতা দেওয়া দেখে জীবদ্দশাতেই হয়তো তাঁকে ভারতরত্ন সম্মান দেওয়ার কথা কারও মনে হতে পারে। কিন্তু কথা সেটা নয়। ইতিহাস সাক্ষী আছে, দারিদ্র্য-বুভুক্ষা-বেকারি নিরসন, অসাম্য দূর করা, বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র রক্ষা করা, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বজায় রেখে বহুত্ববাদের ঐতিহ্যকে লালন করা বা সংবিধানের আদর্শগুলি চোখের মণির মতো রক্ষা করার কাজে মোদির ভারত ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। অন্যভাবে বললে, পরিকল্পনামাফিক এক সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে। যেখানে ‘সাধারণের তন্ত্র’ নয়, এক হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করাই শাসকের মূল লক্ষ্য। নরেন্দ্র মোদি তথা প্রধানমন্ত্রীর চড়া দাগের আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় এই সত্যকে আড়াল করা যাবে না।
ঘটনা হল, মোদি জমানায় সবচেয়ে বেশি বিপদে দেশের সংবিধান। দেশের আপামর জনগণকে সুরক্ষা দিতে যে রক্ষাকবচগুলির কথা বলা আছে সংবিধানে, তার প্রায় সবক’টি আজ বিপন্ন। হিন্দু মৌলবাদীদের একাংশের আগ্রাসনে সমাজে বিভাজন ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। সংখ্যালঘু, দলিত, অনগ্রসর, গরিবদের ‘দ্বিতীয়’ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। সবচেয়ে আতঙ্কের কথা হল, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ দুটি বাদ দিতে উঠে পড়ে লেগেছে শাসক দল। সুপ্রিম কোর্টের বাধায় আপাতত সেই চেষ্টা আটকানো গিয়েছে। পদ্মশিবিরের পরিকল্পনা ছিল, লোকসভা ভোটে ৪০০ আসনে জিতে দুই তৃতীয়াংশের গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসে সংবিধান বদলে দেওয়ার। সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে হয়েছে শাসক দলকে। কারণ, লোকসভার ভোটে ৪০০-র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তারা পেয়েছে মাত্র ২৪০টি আসন। অথচ পাকা অভিনেতার মতো চিত্রনাট্য মেনে এবারও সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে সংবিধানকে পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরে মোদি বলেছেন, ‘ভারতে জাতিগত, ভাষাগত এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্য একটি অমূল্য সম্পদ, যা আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখে।’ আরও বলেছেন, ‘ভারতের সংবিধান শুধু একটি আইনের সংকলন নয়, এটি আমাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তিও বটে।’... সরকারের লক্ষ্য হবে দেশের প্রতিটি কোণায় এই আদর্শগুলি প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায়— বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ হচ্ছে ঠিক তার উল্টো!
সংবিধানের মূল মন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রের উপর প্রথম আঘাত আনা হয়েছিল ১৯৯২ সালে, বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে। পরে মোদি জমানায় আদালতের নির্দেশে অযোধ্যার সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে রামমন্দির। বলা যায় সেই শুরু। প্রধানমন্ত্রীর রাজত্বে গো-মাংস রাখার অপরাধে দেশের নাগরিককে পিটিয়ে মারা হয়েছে ধর্মের নামে। গত এক দশক ধরে বজরং দল, হিন্দুসেনারা যেমন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তেমনই প্রশাসনিক কাঠামোকে ব্যবহার করে ‘এক দেশ, এক ভাষা, এক নেতা, এক ধর্ম’-র তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ভেঙে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। রাজ্যগুলির সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা অব্যাহত। মোদি প্রকাশ্যে অন্য কথা বললেও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়েই সংবিধান প্রণেতাকে ‘অপমান’ করেছেন অবলীলায়, অভিযোগ বিরোধীদের। সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, ঘৃণাভাষণ, নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে সংখ্যালঘু বিতাড়ণের এজেন্ডা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। অথচ দশ বছর মোদি জমানার শেষেও দেশের বহু মানুষ দু’বেলা দুমুঠো পেটভরে খাবার খেতে পান না। লাগামছাড়া বেকারি। মান্যতা পায় না নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি। প্রধানমন্ত্রীর ‘ভাষণের’ সঙ্গে বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির আসমান জমিন ফারাক। সংবিধানের মতো পবিত্র গ্রন্থের প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শনে ঘাটতি রয়েছে মোদি জমানায়। তবু দেশবাসীর মন জয়ের চেষ্টায় ‘দক্ষ অভিনেতার’ মতো চমকপ্রদ ভাষণের খামতি নেই!