শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
আসলে, যত রাজ্যের পড়াশোনা করা ছেলে-মেয়েরা তখন সব ওই বাড়িতেই বেশি।
কেউ কলকাতায় নামী বিজ্ঞানী, তো, কেউ ডাক্তার!
পাশের বাড়িটা বড্ড গরিব!
কেশবপুরের ঘোষপাড়া থেকে নাকি উঠে এসেছে দেনার দায়ে।
পাড়ার লোক তাকে খাঁদু বলে ডাকলেও ভালো নাম হল মহাদেব।
বউটির নাম উমা!
তখন তাদের একটাই ছেলে। জন্মেছিল কার্তিক পুজোর দিন ভোরবেলা। কিন্তু ইশকুলে ভর্তি করতে গিয়ে আর এক বিপদ!
বাবা বললেন, ছেলে আমার ঝড়ের বছর হয়েছে। বুঝলেন—
কালী মাস্টারমশাই একটু মাথা চুলকে বললেন, বুঝতে পেরেছি!
সত্যি বলতে সেই থেকেই একটা গেঁয়ো গল্প ঘুরছে তার সঙ্গে সঙ্গে।
একে রোগা-পাতলা ভিতু ছেলে।
ছোট থেকে গাছে ওঠাও শেখেনি! সাঁতার কি সাইকেল চাপা— কিচ্ছু জানেই না!
তবু পাশের সরকার পাড়া থেকে নদীর ওপারের বদরতলার আবদুল চাচারাও খুব ভালোবাসে ছেলেটাকে!
সরকার পাড়াতেই তখন দশখানা গাঁয়ের মধ্যে একটাই ডাক্তার। আর দুগ্গা পুজোর আনন্দ!
যদিও পাশের পাড়ায় উকিলবাবুদের পাকা সদর দালানেও ঠাকুর আসে বছর বছর, তবু যেন দূর মনে হয় কেমন!
সরকার পাড়ার কেষ্টদা, দেবুদা, গণেশদা, আর এক বয়েসি শৈল, লক্ষ্মীকান্ত— সব্বাই ছিল বড্ড কাছের।
পুজোয় তখন জামা-প্যান্ট হতো মাত্র একটা করে।
তা-ও মাপে ছোট-বড় হতো প্রতিবারেই।
ছেলে মুখ ভার করে আছে দেখে বাবা বলতেন, দেখি না কালীপুজোর সময় কী হয়!
মা বলতেন, ফুলঝুরি আনতে হবে না, যদি একটা জামা হয় দেখো।
কিন্তু এসব কথা হতো আর ক’দিন!
চার দিনের পুজো তখন চার দিনেই শেষ। পাঁচ দিনের সন্ধ্যায় বিজয়া হয়ে যেত নদীতে।
রাংতা কুড়োতে যাবে কি— সাঁতার জানে না তো!
তাই একলা ছেলে ফিরে আসত মুখ ভার করে।
পরের তিন-চারটে দিন আর খিদে পেত না তেমন!
একা একা বসে থাকত নদীর ধারে।
সেই তখন থেকেই ছেলেটা যেন কেমন!
গাছে উঠতেও জানে না। সাইকেল চড়াও শেখেনি।
পাশের বোস বাড়ির বড়রা বলতেন, আয় না— শিখিয়ে দিই তোকে। শুনেই তো সটকে পড়ত ছেলে!
সে সময় তো পাকা রাস্তার বালাই ছিল না কাছে-পিঠে কোথাও!
ব্রিজ ছিল না হরিণখোলার মুণ্ডেশ্বরী আর চাঁপাডাঙার কাছে দামোদরে। নৌকো পেরিয়ে তবেই কু-ঝিক ঝিক ছোট্ট ট্রেন ধরতে হতো মার্টিন কোম্পানির।
মায়ের সঙ্গে পানপুরের মামাবাড়ি যেতে গাড়ি বদল করতে হতো বড়গাছিয়ায়।
আহা! কী দুলকি চালের ছোট্ট ট্রেন ছিল ওই সময়।
জানলার ধারে বসলেই চোখে এসে পড়ত কয়লার গুঁড়ো। তবু পানপুর স্টেশনে নামলেই ছোট মাসি দাঁড়িয়ে থাকত এক ঠোঙা গুড়কাঠি নিয়ে!
মাথায় একটু বড় হতেই গাঁয়ের সেই গাছতলার ইসকুল থেকে চলে যেতে হল তিন মাইল দূরের বড় ইশকুলে।
সেখানেও সবে ইট গাঁথা চলছে। কোনও কোনও ঘরে জানলার পাল্লা নেই! দরজাও বসেনি।
তবু অঙ্ক স্যার রামবাবু ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরে ঘরে। যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়।
ইশকুলের কাছেই ডাকাবুকো সেই নদী মুণ্ডেশ্বরী নদী।
নদীর গা ঘেঁষেই মিরাজ, মাসুম আর জাকিরদের বাড়ি।
টিফিনের সময় তারাই মুড়ির ভাগ দেয় জোর করে। কোনও দিন আনে শালপাতায় মোড়া গুড়কাঠি।
সরকার পাড়ার লক্ষ্মীকান্ত, সুকুমার আর শৈলরা তখন রোজকার সঙ্গী। ওদেরও সাইকেল নেই তখন! আরামবাগ যেতেও কাঁচা রাস্তা। হাঁটতে যেন কারও কোনও কষ্ট ছিল না তখন।
পাশের পাড়ার কেষ্টদারাই তখন একমাত্র সম্বল আমার।
ওদের বাড়িতেই যত রাজ্যের আনন্দ। কলকাতার হাওয়া।
রেডিও। খবরের কাগজ। গল্পের বই।
ওর বাবা ছিলেন কলকাতার এক নামী খবরের কাগজে কাজ করা মানুষ!
দাদা ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের লেখক শশধর দত্ত। যাঁর দস্যু মোহনকে নিয়ে লেখা বই একশো ছাড়িয়ে গেছে তখনই!
সেই বাড়িতেই হঠাৎ একটু জায়গা জুটে গেল আমার।
আলমারি ভর্তি কত রকমের বই! অবনীন্দ্রনাথের নালক, শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল থেকে উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই। যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যের সন্ধান পেলাম আচমকা!
ও বাড়ির ছোট ছোট তিনটে মেয়ে শানু, মিন্টু আর সাধনা তারাও তখন সন্ধান পেয়ে গেছে সেসব বইয়ের!
পুজোয় আর নতুন জামা-জুতোর দিকে লোভ নেই কারওর, শুধু চাই বই আর বই!
গোটা বর্ষাকালে বদরতলার জলা পেরুতে তালগাছের ডোঙা থাকত তখন।
পুজোর ক’দিন সেই ডোঙায় চেপেই বিরিটি, তাজপুর, হরিণখোলা থেকে কত মানুষ আসত ঠাকুর দেখতে।
একটুতেই যেন কত আনন্দ ছিল তখন!
হোক গে একটা মাটির বাড়ি— উঠোনে ছিল শুধু একটা ঝামড়ি-ঝুমড়ি শিউলি গাছ।
পুজোর ঢাক বাজার আগেই মুড়ির মতো কুঁড়ি ধরত হাজার হাজার।
মা বলত— এই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক দেখছিস গন্ধে ম-ম করছে চারদিক!
ছেলেটাও তেমন! গাছটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত যখন তখন।
গ্রাম থেকে ছান্দ্রার বড় ইশকুলটায় যেতে না যেতেই, বন্ধু হয়ে গেলেন রাইপুরের কোলেপাড়ার দীনেশ জেঠু। বাবার চেয়ে বয়েসে অনেক বড়! কিন্তু কী মজার মানুষ!
সারাদিন শুধু বই আর বই।
বইয়ের জন্যে খাল-বিল আর জল থই থই জলা পেরিয়ে চলে যেতেন আরান্ডি! দশ-বিশখানা গাঁয়ে যা নেই, সেখানেই তখন নামকরা একটা লাইব্রেরি!
সঙ্গী ছেলেটা তখন হাঁ।
লাইব্রেরি ঠিক কাকে বলে, সেই তখন চোখের সামনে দেখল ছেলেটা!
—এই বইটা নয়! আগে পড়বি এইটা। ভোঁদড় বাহাদুর রবীন্দ্রনাথের ভাইপো ছিলেন উনি। বুঝলি?
অবশ্য শানুদের বাড়িটাও ছিল একটু অন্যরকম। পুজো মানেই বাড়িতে আসবে নতুন বই! কী মজা!
তবু পাশের বোসদাদুদের বাড়ির উঠোনে স্থলপদ্ম গাছটায় যেই ফুল ফুটত ভোর থেকে, তখন কেমন মনটা ভালো হয়ে যেত ছেলেটার। বাবার জন্যে বড্ড হানটান করত মনটা।
কিন্তু দোকানের চাকরি কলকাতার। ষষ্ঠীর দিন হয়ে ছুটি। তারপর ট্রেন ধরা।
সে-ও কি আর তাড়াতাড়ি আসত?
হায় রে! কয়লার ইঞ্জিন কথায় কথায় জল খেত তখন। তারপর সেই কু-ঝিক ঝিক ঝিক—
চাঁপাডাঙায় নেমে পেরুতে হবে দামোদর। তারপর হরিণখোলার মুণ্ডেশ্বরী।
কাঁচা রাস্তায় চলত ভাঙা মোটর দু-তিনটে। পা-দানিতেও পা রাখার জায়গা হতো না সহজে।
বাড়িতে বাবার জন্যে জেগে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ত ছেলেটা—
আহা রে!
তবু ভোরবেলাটা কী লক্ষ্মী ছিল তখন! শিউলি ফুলের গন্ধটা এমন করে ছড়িয়ে দিত গোটা পাড়ায় যে বলার নয়!
বছরে সেই একবারই মায়ের জন্যে আসত জবাকুসুম তেল!
শিউলি গাছটাও তখন যেন ফেল করত ক’দিন।
ভোর থেকেই ঢাক বেজে উঠত দুগ্গা তলায়।
তবু মনটা বড্ড উসখুস করত ছেলেটার!
নিজের নতুন জামা আর প্যান্ট কেমন হল— সেদিকে কোনও খেয়াল নেই। শুধু মায়ের দিকে চেয়ে থাকত দূর থেকে! হঠাৎ যেন ভিজে আসত দুটো চোখ। পুজোর সকালটাও যেন কেমন মনমরা মনে হতো তখন!
শানু বলত, ওমা— হাসি নেই কেন! কী হয়েছে তোমার?
বাপরে! অত বড় হয়েছে ছেলেটা— তবু কী লাজুক।
হরাদিত্যর ঠাকুর গড়া মিস্ত্রিরাও তো ওকে চেনে।
কবে থেকে বসে থাকত কাছাকাছি। কোনও দিন একটুও রং চায়নি ছেলেটা। শুধু রাংতার সাজ দেখে কেমন যেন একটু মন-মরা মনে হচ্ছে!
লক্ষ্মী ঠাকুরের মুখটা কী মিষ্টি! ঠিক যেন মায়ের মতো অনেকটা!
শুধু একটা নাকছাবি থাকলেই মায়ের মুখটাও আলো হয়ে থাকত ক’দিন! আহারে...