শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
চোখ রাঙা হলেও লোকটার কণ্ঠস্বর কোমল, ‘ভয় কী! এসো। নৌকোর ছইয়ের নীচে মাধব বসে আছে। তুমি এলে নৌকো ছাড়বে। নদীর ওপারের জঙ্গলে যাব। ওখানে হাজার বছরের পুরনো বুদ্ধদেবের একটা চল্লিশ ফুট উঁচু পাথরের মূর্তি আছে। আমরা ওটা দেখেই ফিরে আসব। শান্তিময়বাবুর মুখে শুনেছি তুমি অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসো। এসো কিরীটী।’
এর আগে সে লোকটাকে দেখেনি। লম্বা ছিপছিপে চেহারা। গায়ে কালো আলখাল্লা। পায়ে লাল রঙের বুট জুতো। ফরসা মুখে লালচে গোঁফ-দাড়ি। চোখ দুটো রক্তের মতো লাল। লোকটা বাবার নাম জানল কী করে! কিট্টুর ভালো নাম যে কিরীটী সেটাও জানে! আশ্চর্যের ব্যাপার!
লোকটা আবার তাড়া দেয়, ‘কী এত ভাবছ! এসো। সন্ধে হয়ে আসবে। এরপর আর যাওয়া যাবে না। শান্তিময়বাবু এখন পাইন বনে পায়চারি করতে করতে নিশ্চয়ই ঘুঘুরামের কথা ভাবছেন। ওঁকে ভাবতে দাও। তোমাদের ড্রাইভার ললিত আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। চলো, এই ফাঁকে আমরা ঘুরে আসি।’ ওই লোকটা ও কিট্টু ছাড়া নদীর ধারে আর কেউ নেই। ছইয়ের নীচে হয়তো মাধব আছে।
কিট্টুর ভালো নাম কিরীটী রায়। তা বলে সে তো ডিটেকটিভ কিরীটী রায় নয়! এবার সে নদীকে পেছনে রেখে পাইন বনের দিকে ছুটতে লাগল। বিকেল শেষ হয়ে আসছে।
পাইন বনে পৌঁছে দেখল বাবা আপন মনে বিড় বিড় করে কী যেন বলছেন আর পায়চারি করছেন। বাবা ডাকসাইটে উকিল। তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ও প্রতিপত্তি।
পাইন বনে একটাও পাইন গাছ নেই। তবে আম জাম পেয়ারা বেল ও পেঁপে গাছ আছে। বাবার মক্কেল পল্লব পাইনের এই বাগান। তিনি এই ফলের বাগানটার নাম রেখেছেন পাইন বন।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাবার সামনে দাঁড়াল। শান্তিময় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল কিট্টু! হাঁপাচ্ছ কেন?’ কিট্টু বলল, ‘ছুটে এলাম। তাই।’ উনি বললেন, ‘খামোকা ছুটে এলে কেন!’ কিট্টু বলল, ‘মনে হল একটু ছুটে নিই।’ আসল কথাটা বলল না।
শান্তিময় বললেন, ‘একটা জটিল কেস নিয়ে ভাবছি। আসামি ধরা পড়েছিল। সাত দিনের মধ্যে জেলখানার পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাল। ইন্সপেক্টর বর্ধন চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছেন। শিগগির লোকটা ধরা পড়বে। পাইনবাবু খুব ভেঙে পড়েছেন। লোকটা ধরা না পড়লে তিনি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বেন। তাঁর ব্যবসার মূল্যবান নথিপত্র লোকটা হাতিয়ে নিয়েছে। হাতেনাতে ধরা পড়ে কিছু উদ্ধার করা গেছে। সব নয়। লোকটাকে সওয়াল করে সে সবের হদিশ ঠিক বার করে ফেলতাম।’
বাবার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোন ধরে বাবা বললেন, ‘হ্যালো। পাইনবাবু! হ্যাঁ। হ্যাঁ। এবার আমরা আসছি।’ ফোন পকেটে রেখে বললেন, ‘চলো, এবার পাইনবাবুর বাড়ির ভিতরে যেতে হবে।’
পাইন বনের বাইরে এসে দেখল তাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ললিতদা গাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। সামনেই পাইনবাবুর বাড়ি। যেন রাজপ্রাসাদ।
দুই
এই বাড়িতে কিট্টু দ্বিতীয়বার এল। প্রথমবার ললিতদা তাকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন নদীতে দুটো ফেরি নৌকো ছিল। ঘাটে আলাদা করে কোনও নৌকো বাঁধা ছিল না। কালো আলখাল্লা লাল বুট পরা লোকটাকে সেদিন দেখেনি। কিট্টু তখন জানত না নদীর ওপারে একটা জঙ্গল আছে। ওখানে হাজার বছরের পুরনো চল্লিশ ফুট উঁচু বুদ্ধদেবের পাথরের মূর্তি আছে। আজ প্রথম শুনল।
পাইনবাবুর স্ত্রী প্রথম দিন কিট্টুকে সস্নেহে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার গৌরাঙ্গের মতো।’ কিট্টু অবাক হয়েছিল, ‘গৌরাঙ্গ আবার কে!’ উনি বলেছিলেন, ‘ধরে নাও তোমার ভাই। তোমাদের তো একই বয়স।’ পরে বাবার কাছ থেকে সে জানতে পেরেছিল পাইনবাবুর ছেলের নাম গৌরাঙ্গ। দার্জিলিংয়ে থেকে পড়াশোনা করে।
পাইনবাবুর স্ত্রী আগের দিন কিট্টুকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে সযত্নে লুচি মিষ্টি খাইয়েছিলেন। সে কোন ক্লাসে পড়ে বাড়িতে আর কে কে আছেন সব জিজ্ঞেস করেছিলেন। আজও লুচি মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কাল গৌরাঙ্গ আসবে। কিছুদিন থাকবে। এর মধ্যে বাবার সঙ্গে এখানে এসো। গৌরাঙ্গের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে তো!’
খেতে খেতে কিট্টু ভাবছিল আলখাল্লা পরা লোকটাই কি ঘুঘুরাম!
তিন
বাবা আজ তাড়াতাড়ি কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। দোতলার বারান্দার চেয়ারে বসে জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে কিট্টুর মা চিত্রাকে বলছেন, ‘ইন্সপেক্টর বর্ধন আধ ঘণ্টা বাদে আসবেন। আমার চেম্বারে জলখাবার দেবে।’
কিট্টু একটু আগে ফুটবল খেলে মাঠ থেকে ফিরেছে। স্কুল বন্ধ। ভোটের জন্য স্কুলে পুলিসক্যাম্প বসেছে। জ্ঞানবাবু কয়েকদিন পড়াতে আসবেন না। সপরিবারে দেশে গেছেন। একেবারে ভোট দিয়ে ফিরবেন।
ডাইনিং হলে বসে কিট্টু গরম গরম ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাচ্ছে। এতক্ষণ এখানে মা ছিলেন। গাড়ির হর্ন শুনে ছুটলেন, ‘কিট্টু, তোর বাবা বোধহয় এলেন। আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট লাগলে তরুদিকে বলিস।’ কিট্টু বলল, ‘আর লাগবে না।’ তরুদি পাশের কিচেনে।
এখান থেকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বাবা ও মাকে। ওঁদের কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেল পালানো আসামি ধরা পড়ল?’ বাবা বললেন, ‘না। এখনও ধরা পড়েনি। বর্ধন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শোনা যাচ্ছে লোকটা নাকি ছদ্মবেশে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাহস আছে বলতে হবে। একদিন নাকি পাইনবাবুর বাড়ির আশপাশেও তাকে দেখা গেছে।’ মা বললেন, ‘তক্ষুনি ওকে পুলিস পাকড়াও করল না কেন!’ বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘চিত্রা, তুমি তো দেখছি ভারী ছেলেমানুষ! এভাবে গ্রেপ্তার করা যায় নাকি! আইনের অনেক মারপ্যাঁচ আছে। কেবল অনুমানে তো হয় না। প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাই।’ মা বললেন, ‘ছদ্মবেশে লোকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা নিছক অনুমান তাহলে!’ বাবা বললেন, ‘অনুমান পুরোপুরি নয়। যাকগে, ওসব কথা থাক। এক্ষুনি জামাকাপড় বদলে একতলার চেম্বারে গিয়ে বসতে হবে। বর্ধন এই এলেন বলে।’
চেম্বারে বসে বাবা ও ইন্সপেক্টর বর্ধন কথা বলছেন। খানিকক্ষণ আগে মা জলখাবার দিয়ে গেছেন। কাজের লোক তরুদির হাতে চায়ের ট্রে ছিল। যাওয়ার সময় মা বাবার কথামতো দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে গেছেন।
কিট্টু ওই ভেজানো দরজার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে। চেম্বারে ওঁরা কথা বলছেন। কিন্তু কী বলছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিট্টু এবার ছিটকে সরে এল। এ কী করতে যাচ্ছিল! আড়ি পেতে ওঁদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল! খুব অন্যায়। ভেবেছিল জেল পালানো আসামিটা ঘুঘুরাম। ওঁদের কথাবার্তায় নিশ্চয়ই জঙ্গলের বুদ্ধদেবের মূর্তিটার কোনও হদিশ থাকলেও থাকতে পারে। এভাবে রহস্য উদ্ধার করতে চায় না। কিট্টু নিজের বুদ্ধিবলে সব রহস্য উদ্ধার করবে।
চার
কোর্টে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। কিট্টুদের স্কুলেও। পাইনবাবুর ছেলে দার্জিলিং থেকে নিজেদের বাড়িতে এসেছে। কিট্টুর খুব ইচ্ছে করছে গৌরাঙ্গের সঙ্গে আলাপ করতে। কিন্তু বাবা তো আর পাইনবাবুর বাড়িতে যান না। হয়তো তাঁর সঙ্গে বাবার ফোনে কথাবার্তা হয়। মাঝে মাঝে ইন্সপেক্টর বর্ধন বাবার কাছে আসেন। চেম্বারের দরজা ভেজিয়ে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে বর্ধন চলে যান। কিট্টু বুঝতে পারে আসামি এখনও ধরা পড়েনি। সকাল সন্ধে অন্যান্য মক্কেলদের নিয়ে বাবা ভারী ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বাবা যখন বিকেলে একলা দোতলার বারান্দায় বসে দূরের গির্জাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তখন বাবাকে দেখে কিট্টুর মনে হয় তাঁর মন ভালো নেই। কিট্টুরও মন ভালো নেই।
জ্ঞানবাবু দেশ থেকে ফিরেছেন। সোম থেকে শনি নিয়ম করে সন্ধেবেলায় পড়াতে আসছেন। তবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কিট্টুর মনে হয় স্যারেরও মন ভালো নেই। এক-একটা মানুষের মন এক-একরকম। তাই মন খারাপের কারণগুলোও এক একরকম।
সেদিন সাতসকালে একটা ফোন পেয়ে শান্তিময় ভারী উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘চিত্রা। চিত্রা। এক্ষুনি আমাকে বেরতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি ললিতকে বলো গাড়ি বের করতে। গৌরাঙ্গকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। বর্ধন পাইনবাবুর বাড়িতে পুলিস ফোর্স নিয়ে চলে গেছেন।’
বাবার কথা শুনতে পেয়ে কিট্টু ছুটে এল, ‘বাবা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’ বাবা কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘বেশ। চলো।’
পাঁচ
বাবার সঙ্গে কিট্টু এখন সেই নদীটার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে পুলিস। একটা মোটর বোটে চেপে একদল পুলিস নিয়ে ইন্সপেক্টর বর্ধন ছেলেধরার পিছু নিয়েছেন। ছেলেধরা আর কেউ নয় সেই জেল পালানো আসামি। কিট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আসামির নাম কি ঘুঘুরাম!’ বাবা অবাক, ‘ওর নাম তুমি জানলে কী করে! ঘুঘুরাম একটা আস্ত শয়তান।’ কিট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘নদীর ওপারের যে জঙ্গলে বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে ঘুঘুরাম গৌরাঙ্গকে নিয়ে নিশ্চয়ই ওখানে গেছে।’ এত বিপদের মধ্যেও শান্তিময় হেসে ফেললেন, ‘জঙ্গল, বুদ্ধমূর্তি কী আবোল-তাবোল বকছ! ওপারে ওসব কিছুই নেই। কয়েকটা বন্ধ কারখানার ধ্বংসস্তূপ আছে।’ কিট্টু বলল, ‘পুলিস গৌরাঙ্গকে উদ্ধার করতে পারবে?’ ছেলের অশ্রু-ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তিময় বললেন, ‘পারবে। তুমি মন খারাপ কোরো না।’ কিট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে!’ শান্তিময় বললেন, ‘ভালো কিছু পেতে গেলে অপেক্ষা করতে হয় কিট্টু।’ কিট্টু অবাক, ‘ভালো কিছু এখানে পাব!’ উনি বললেন, ‘আসামি ঘুঘুরাম ধরা পড়বে। আর গৌরাঙ্গকে আমরা ফিরে পাব। এগুলোই তো ভালো কিছু।’ কিট্টু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল।