শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
বাবার রিটায়ারমেন্ট করার সময় জয়নাল এসে বলল,— বাবার সঙ্গে সে-ও চাকরি থেকে অবসর নিতে চায়, শুধু তাই নয়, রিটায়ার করে সে বাবার সঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকবে বলে জানাল। কারণ তার তিন কুলে কেউ আছে বলে জয়নাল অন্তত মনে করতে পারল না। বাবার সঙ্গে জয়নালও আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেল।
জয়নালকে পেয়ে বাবার অবশ্য অনেক সুবিধে হয়েছিল। আমাদের জমিজমা, খেত-খামার যা ছিল জয়নাল সবই দেখে নিল। তারপর চাষ-বাসের তদারকি, শুনো জমিতে রবিশস্যের ঠিকমতো ফলন কিংবা ফলের গাছে সময়ে ফল হচ্ছে কি না সবই সে দেখাশুনো করতে লাগল। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন জমি-জমা সংক্রান্ত কাজে বাবাকে সোনামুখী যেতে হল। বলা বাহুল্য জয়নালও তার সঙ্গী হল। সোনামুখীতে ছোট-বড় অনেক সরকারি অফিস, থানা, ব্যাঙ্ক, হাইস্কুল, বড় পোস্ট-অফিস সবই আছে, বাবা যে অফিসে কাজের জন্য গিয়েছিলেন সেই অফিসার সেদিন অন্য কাজে বাঁকুড়া গিয়েছিলেন। হেড-ক্লার্ক বলল— বাঁকুড়া গেলেও সাহেব নিশ্চয় বেলা তিনটের মধ্যে ফিরে আসবেন। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে চলল, অফিস ছুটির সময় প্রায় অতিক্রান্ত। কিন্তু সাহেব মানে সেই অফিসারের দেখা নেই। খবর নিয়ে জানা গেল পথের মধ্যে হঠাৎ বাসটার কল-কব্জা বিগড়ে যেতেই মেকানিকের অপেক্ষায় বাসসুদ্ধ সবাই হা-পিত্যেশ করে বসে রয়েছে। কখন, কতক্ষণ পরে যে বাস আবার চালু হবে তা কেউ বলতে পারবে না।
অগত্যা গ্রামে ফেরা ছাড়া উপায় নেই। সন্ধে প্রায় নেমেছে, রাত্তিরটা হয়তো কোনও দোকানের দাওয়ায় শুয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সারারাত্তির মশার কামড়। তারপর উপবাস। ব্যাপারটা বাবার ঠিক মনঃপূত হয়নি, বাবার কাছে একটা পকেট-ঘড়ি থাকত। সেটা বের করে বাবা দেখলেন প্রায় ছ’টা বাজে। এখনই রওনা দিলে ঘণ্টা চার বাদে নিশ্চয় বাড়ি পৌঁছানো যাবে।
জয়নাল শুনে বলল— ‘বাবু, আজ ভরা অমাবস্যা। এই রাত্তিরবেলা দশ মাইল রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি যাবেন?’
বাবা তার আশঙ্কাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন, — ‘এতদিন পুলিসে কাজ করেও তোর দেখছি ভূতের ভয় যায়নি।’
তারপরই ওকে তাড়া দিয়ে বললেন, —‘চল চল, বেরিয়ে পড়া যাক। রাত দশটার মধ্যে নিশ্চয় বাড়ি পৌঁছে যাব।’
রওনা হবার আগে বাবা সোনামুখী বাজারের বড় ময়রার দোকান থেকে টেনিস বল সাইজের পঁচিশটা রসগোল্লা কিনলেন। তখন সস্তাগণ্ডার দিন। পঁচিশটা বড় সাইজের রসগোল্লার দাম কত নিয়েছিল বাবার মুখে সে কথা শুনলেও এখন আর মনে নেই। মিষ্টির হাঁড়িটা এক কাঁধে বসিয়ে জয়নাল সামনে হাঁটতে লাগল। তার পিছনে বাবা, হাতে সেই তেল চুকচুকে হাতচারেক লম্বা শক্তপোক্ত লাঠি।
সোনামুখী ছাড়িয়ে দু’জনে পায়ে-চলা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। দু-পাশে গাছপালা, জঙ্গল। প্রায় ঘণ্টা দেড় হাঁটবার পর কোচডি গ্রামটা পিছনে পড়ে রইল। গ্রামের শেষে কোচডির মহাশ্মশান। সেটা পেরিয়ে আসার পরই বাবার মনে হল, রসগোল্লার হাঁড়িটা ডান কাঁধে নিয়ে হাঁটার সময় জয়নাল যেন টলছে। একবার ডান দিকে রাস্তার একপাশে আবার তারপরই রাস্তার বাঁদিকে চলে যাচ্ছে। ওর এই টলটলায়মান অবস্থা দেখে বাবা খুব অবাক হলেন। তবে জয়নাল যে নেশা-টেশা করে একথা তিনি কস্মিনকালেও শোনেননি। তবে?
জিজ্ঞেস করতেই জয়নাল পিছন ফিরল। বলল— ‘বাবু কোচডির শ্মশানটা পেরিয়ে আসার পরই কারা যেন আমার সঙ্গে হাঁটছে। কখনও আমাকে ঠেলে ডান দিকে নিয়ে যাচ্ছে আবার কখনও বাঁ-দিকে টানছে। মনে হয় ওদের নজর এই রসগোল্লার হাঁড়িটার ওপর। আমার কাঁধের ওপর থেকে যদি এই রসগোল্লার হাঁড়িটা মাটিতে ফেলে দিতে পারে তাহলেই ওদের ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়। রসগোল্লাগুলি সব ওদের দখলে চলে যাবে।’
‘তার মানে?’ বাবা সোজাসুজি শুধোলেন, —‘ওরা কি তোমার কাছে রসগোল্লা খেতে চেয়েছে?’
‘মনে হয় তাই।’ জয়নাল জবাব দিল, বলল— ‘আমি যদি কয়েকটা রসগোল্লা ওদের দিকে ছুঁড়ে দিই তাহলে হয়তো ওরা আমার সঙ্গ ত্যাগ করবে। কিন্তু আমি ব্যাটাদের একটি রসগোল্লাও দিচ্ছিনে। তা সে ওরা যা পারে করুক।’
কিন্তু ওই টলটলায়মান অবস্থায় জয়নালকে হাঁটতে দেখে বাবা নিজেই ওর কাঁধের হাঁড়িটা নামিয়ে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে গোটা চার রসগোল্লা বের করে দুটো পিছনে আর দুটো-দুপাশে ছুঁড়ে দিলেন। ব্যাস! এরপরই জয়নাল ফের সোজা হয়ে হাঁটতে লাগল। ওর ওই টলটলায়মান অবস্থা আর রইল না। বাড়ি পৌঁছতেই ওই এক হাঁড়ি রসগোল্লা দেখে মা তো বেজায় খুশি, কিন্তু হাঁড়ির মুখটা এমন খোলা কেন? জিজ্ঞেস করতেই কোচডির মহাশ্মশান থেকে পথের ঘটনা সবিস্তারে বাবা শুনিয়ে দিলেন মাকে। আর তাই শুনেই মায়ের হাসিখুশি মুখের আনন্দভাব সব কোথায় মিলিয়ে গেল, মা বলল, —‘না-না। ওই রসগোল্লার হাঁড়িতে যখন ভূতের নজর পড়েছে, তখন ওটা আর আমি ঘরে তুলছিনে। বলা যায় না রাত্তিরে হয়তো তেনারা দল বেঁধে রসগোল্লার খোঁজে ওই হাঁড়ির ওপর চড়াও হতে পারে।’ মা আরও বলল, —‘তার চেয়ে বরং এক কাজ করো। জয়নাল আর তুমি দু’জনে মিলে এই রসগোল্লার হাঁড়িটা শ্মশানে রেখে দিয়ে এসো। ইচ্ছে হলে তেনারা এসে পাঁচালের শ্মশানেই ভূতভোজন করবেন।’
অত রাত্তিরে জয়নালকে সঙ্গে নিয়ে বাবা ওই রসগোল্লার হাঁড়িটা বাঁধের পাড়ে গাঁয়ের শ্মশানে রেখে দিয়ে এল। তারপর মুখহাত ধুয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে দু’জনে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল।
রহস্যটা জানা গেল পরদিন খুব ভোরে। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই ঘুম থেকে ওঠা বাবার চিরকালের অভ্যেস, তখনও পাখপাখালি রব শুরু করেনি। আলো আর আঁধারে মেশা ভোর। বাবার কী খেয়াল হল তার সেই তেল চুকচুকে লাঠিটা নিয়ে চলে গেলেন বাঁধের পাড়ে শ্মশানে, মিষ্টির হাঁড়িটার কী পরিণতি হল সেটা জানতে তার খুবই ইচ্ছে ছিল।
শ্মশানে পা দিয়েই বাবা তো হতবাক। মিষ্টির হাঁড়িটা যেমন ছিল তেমনি অক্ষত রয়েছে। শুধু টেনিস বল সাইজের রসগোল্লাগুলি সাফ। হাঁড়ির ভিতরে একটাও পড়ে নেই।
কিন্তু অতগুলি টেনিস বল সাইজের রসগোল্লা গেল কোথায়? তবে কি অমানিশার গভীর রাতে কোচডির মহাশ্মশান থেকে তেনারা এসে রসগোল্লার ভূতভোজন করেছেন?
অথবা আরও ভোরে গ্রামের কোনও মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাঁধের পাড়ে এসে হাঁড়ির রসগোল্লাগুলিতে চক্ষুদান করে চম্পট দিয়েছে।
স্বীকার করছি এই রহস্যের সমাধান বাবা কিংবা জয়নাল কেউ করতে পারেনি।