শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এমন এক-একজন মহাপুরুষ জন্মান, যাঁদের জন্য মানুষ যুগ যুগ ধরে গর্ব অনুভব করে থাকে। আজ তেমনি একজন মহাপুরুষের কথা শোনাব তোমাদের, যিনি আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ১৮২০ সালে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন। তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতীদেবী। এই ছোট্ট ঈশ্বরচন্দ্রই কেমন করে সকলের প্রণম্য, প্রাতঃস্মরণীয় ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে উঠলেন সেই গল্পই আজ শোনাব তোমাদের। মা ভগবতীদেবীর ছিল এক বিরাট পরোপকারী মন। তিনি নিজের শত অসুস্থতার মাঝেও কারও অসুখ-বিসুখ করেছে শুনলে, নিজে হাতে ওষুধ-পথ্য তৈরি করে তার কাছে ছুটে যেতে পিছপা হতেন না। এই জন্য গ্রামের ডোমপাড়া, হাঁড়িপাড়ার গরিব মানুষরা তাঁকে ডাকত ‘ভগবতী-মা’ বলে। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরচন্দ্রও পেয়েছিলেন মায়ের মতোই এক নরম মন, পরের কষ্ট দেখলে যে মন অস্থির হয়ে উঠত!
তেমনি বাবা ঠাকুরদাসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন পড়াশুনোয় বিপুল আগ্রহ। আট বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামের পাঠশালাতেই পড়াশুনো করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তারপর, বাবার সঙ্গে চললেন কলকাতায়, সেখানে থেকে পড়াশুনো করবার উদ্দেশ্যে।
কলকাতায় আসার পথে ঘটল একটা মজার ঘটনা। বাটনা-বাটা শীলের মতো মাইল-ফলক লাগানো পাথর ছিল রাস্তার ধারে ধারে। তাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল মাইলের সংখ্যা। সেগুলি দেখিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বাবাকে বারে বারে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন ইংরেজি এক থেকে দশ সংখ্যা। ফলে কলকাতা পৌঁছবার আগেই তাঁর ইংরেজি ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত শেখা হয়ে গেল! এমনি ছিল তাঁর শেখার আগ্রহ আর শিখে নেবার মেধা!
ছেলেবেলায় পড়াশুনোয় এমনই মন ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের যে পাছে পড়ার সময় ঘুম পায় তাই কখনও ঘুম তাড়াতে চোখে সর্ষের তেল লাগাতেন, আবার কখনও জানলার গরাদের সঙ্গে নিজের টিকি বেঁধে রাখতেন যাতে ঘুমে ঢুলে পড়লেই টিকিতে টান পড়ে, আর তিনি জেগে যান। পড়ার সময় বাড়িতে প্রদীপ জ্বালানোর জন্য তেলের অভাব হলে তিনি বাইরে রাস্তায় গিয়ে ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে বসে পড়তেন। এমনই ছিল তাঁর পড়াশুনোর প্রতি নিষ্ঠা!
শুধু পড়াশুনোই না, কলকাতার বাসাবাড়িতে তাঁকে রান্নাবান্নাও করতে হতো নিজের হাতে কাঠ কেটে উনুন ধরিয়ে, কুটনো কুটে, বাটনা বেটে! খেলাধুলোতেও ছিল তাঁর খুব আগ্রহ। ভালোবাসতেন বন্ধুদের সঙ্গে লাঠি খেলতে, কবাডি খেলতে, কুস্তি লড়তে। ছোট্টখাট্টো চেহারা কিন্তু মাথাটা বড় বলে বন্ধুরা তাঁকে ‘যশুরে কৈ’ নামে ডাকত। যেহেতু যশোর জেলার কৈ মাছের মুড়ো খুব বড় হতো! কিন্তু এত ঠাট্টা করা সত্ত্বেও ঈশ্বরচন্দ্র যখন পরীক্ষাতে প্রতিবছর বৃত্তি পেতেন, তখন সবার আগে তাঁর মনে পড়ত এই গরিব বন্ধুদের কথাই। তিনি নিজের বৃত্তির টাকায় তাই প্রতি বছর বন্ধুদের কাপড় কিনে দিতেন।
কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনো করবার সময় তাঁর শিক্ষকরা অবাক হয়ে যেতেন তাঁর মেধা দেখে। তিনি পরীক্ষায় প্রথম তো হতেনই, সেই সঙ্গে খুব অল্প বয়সেই ব্যাকরণ, সাহিত্য, দর্শন, অলঙ্কার ইত্যাদি সব শাস্ত্রও ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ! তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে পণ্ডিতসমাজ স্বীকার করলেন যে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন মেধাবী ছাত্র পাওয়া সত্যিই বিরল! তাঁরা তাই তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করলেন।
এবার তোমাদের বলব বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কথা। তখন তিনি পড়াশুনো শেষ করে সবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেছেন, ছোটভাই শম্ভুচন্দ্রের বিয়ে উপলক্ষে মা ভগবতীদেবী চিঠি লিখলেন তাঁকে বীরসিংহ যাবার জন্য। কিন্তু কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেব তাঁর ছুটি মঞ্জুর করলেন না। কিন্তু মা যখন ডেকেছেন তখন তো তাঁকে যেতেই হবে— তাই মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর চাকরি ছেড়ে দেবার জন্য এবার আবেদনপত্র লিখে নিয়ে গেলেন মার্শাল সাহেবের কাছে।
তাঁর মাতৃভক্তি দেখে অবাক হয়ে গেলেন মার্শাল সাহেব, বুঝলেন ছুটি না দিয়ে খুব ভুল করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন তিনি। কিন্তু দামোদরের তীরে পৌঁছে বিদ্যাসাগর দেখলেন প্রবল ঝড় বৃষ্টির জন্য নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে, ঘাটে একটাও নৌকো নেই। পার হবেন কী করে! কিন্তু মা যে ডেকেছেন, যেতে যে তাঁকে হবেই! একটুও ভয় না পেয়ে ‘মা—আমি আসছি—!’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই উত্তাল দামোদরের বুকে! সাঁতরে পার হয়ে অনেক রাত্রে মায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলেন! মা অবাক হয়ে তাঁকে বললেন, ‘আমি ধন্য তোর মতো মাতৃভক্ত ছেলে পেয়ে!’
অসম্ভব নির্ভীক আর তেজী ছিলেন বিদ্যাসাগর। একদিন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন তিনি, দেখেন কার সাহেব টেবিলের উপর তাঁর জুতো সমেত পা তুলে বসে আছেন। বিদ্যাসাগরকে দেখেও সৌজন্যবশত পা নামানোর কোনও আগ্রহই দেখালেন না। ওই ভঙ্গিতেই বসে কথা বলতে লাগলেন। প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করলেন বিদ্যাসাগর। এরপর যেদিন কার সাহেব সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের কাছে একটা দরকারে এলেন, সেদিন বিদ্যাসাগরও তাঁর তালতলার চটি সমেত পা টেবিলের ওপর তুলে বসে বসে কার সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। অপমানিত কার সাহেব বুঝতে পারলেন এই ‘নেটিভ’ বিদ্যাসাগর তাঁকে উচিত শিক্ষা দিতে ছাড়লেন না তিনি ব্রিটিশ হওয়া সত্ত্বেও!
অনেক বই লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর—কথামালা, বোধোদয়, আখ্যান মঞ্জরী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস, মেঘদূত ইত্যাদি। তবে, যে বইয়ের জন্য আমরা প্রত্যেক বাংলা ভাষাভাষী তাঁর কাছে চিরঋণী, সেটি হল সহজ ভাবে বাংলা ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে লেখা ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, বাংলা ভাষা শিখতে গেলে আজও যে বই অপরিহার্য।
তিনি নিজে কিন্তু খুব সাধারণ ভাবে থাকতেন— মোটা ভাত, মোটা কাপড়- চাদর, পায়ে তালতলার চটি— এই ছিল তাঁর আজীবনের পোশাক, এমনকী বাংলার গভর্নর হ্যালিডে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও ওই একই পোশাকে তিনি যেতেন। তাঁর রোজগারের প্রায় সব টাকাই তিনি পরোপকারে খরচ করতেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্যও অকাতরে খরচ করতে কার্পণ্য করতেন না, বিশেষ করে মেয়েদের মডেল স্কুল খুলবার জন্য নিজেই সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতেন।
একদিন বিদ্যাসাগর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পাশের বাড়ি থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে জানলা দিয়ে তাদের বাড়ি উঁকি দিয়ে দেখেন যে, একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে জল খাওয়ার জন্য ছটফট করছে, আর দু’জন মহিলা তাকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখছেন। বিদ্যাসাগর চমকে গেলেন! তিনি বুঝলেন ওই বাচ্চাটি বালবিধবা। একাদশীতে যেহেতু বিধবাদের জল খাওয়া শাস্ত্রে বারণ, তাই মহিলা দুটি ওর হাত-পা বাঁধছে পাছে ছুটে গিয়ে জল খেয়ে ফেলে! কষ্টে বিদ্যাসাগরের চোখে জল এল। তিনি তক্ষুনি মনস্থির করলেন যে বিধবা বিবাহ আইন তিনি পাশ করাবেনই। কিছু দিনের মধ্যেই তা সত্যি সত্যি করে দেখিয়ে সমাজ সংস্কার করলেন।
তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে সাহায্যপ্রার্থীদের ভিড় লেগেই থাকত। কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কার বাড়ি নিলামে উঠেছে, কার অন্ন জুটছে না তিনি কিন্তু সবাইকেই সাহায্য করতেন। কাউকে ফেরাতেন না। তাই মানুষ তাঁকে ডাকত ‘করুণার সাগর’ বলে। আবার মানুষকে সঠিক পথ দেখাতেও তিনি জানতেন। একবার এক স্টেশানে এক যুবক একটি স্যুটকেশ হাতে নামলেন। কে বইবে স্যুটকেশ? যুবক হাঁক পাড়ল— ‘কুলি!’ কুলি নেই দেখে বিদ্যাসাগর নিজেই তার স্যুটকেশটা বয়ে দিলেন। যুবক তাঁকে চিনতে না পেরে, কুলি মনে করে টাকা দিতে যেতে বিদ্যাসাগর তাকে বললেন, ‘এই সামান্য কাজের জন্য পয়সা নেব কেন? এ কাজটুকু আপনি নিজেও করতে পারতেন। নিজের জিনিস নিজে বওয়া কি অন্যায়? যুবকটি তাঁর পরিচয় জানতে চেয়ে যখন শুনল যে তিনি স্বয়ং ‘বিদ্যাসাগর’ —তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল!
তিনি কোনও বাধাবিপত্তিকে গ্রাহ্য না করে নির্ভীক সৈনিকের মতো লড়াই করে যেতেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় গরিব মানুষদের অকাতরে হোমিওপ্যাথি ওষুধ বিলোতেন, কখনও বীরসিংহে অন্নসত্র খুলতেন আবার বেথুন সাহেবের স্কুলের জন্য ছাত্রী জোগাড় করে দিতেন সম্ভ্রান্ত ঘরের অভিভাবকদের রাজি করিয়ে। তিনি এক জীবনে কত কী যে করেছেন ভাবা যায় না। আমরা ধন্য তাঁর মতো যুগপুরুষকে পেয়েছি। আজকের দিনে তাঁর মতো মানবদরদি বন্ধুর অভাব আমরা অনুভব করতে পারছি আর তাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের তাঁর সম্বন্ধে করা উক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করছে—
‘বিদ্যার সাগর তুমি
বিখ্যাত ভারতে
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে
দীন যে, দীনের বন্ধু!’
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে