শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
তবু, এই সময়টায় প্রকৃতিতে কী যেন একটা পরিবর্তন আজও ঘটে যায়! সত্যিই ঘটে না আমাদের আমুদে উৎসব প্রিয় বাঙালি মন ঘটিয়ে তোলে জানা নেই—তবে কিছু একটা ঘটে অবশ্যই। আর তার জেরে আমাদের নিত্যদিনের মনখারাপগুলো আমাদের অভাব অভিযোগ ক্ষোভ সব কেমন দূরে সরে যেতে থাকে, মনটা হাঁফ ছাড়ার জন্য কেমন যেন আকুলিবিকুলি শুরু করে! এবং তার পাশাপাশি কাজের চাপ থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার ইচ্ছেটাও যেন চাগাড় দিয়ে ওঠে বাঙালি মনে। ফলে, পুজোর সেই অমূল্য দিনগুলো যত এগিয়ে আসতে থাকে ঘরে-বাইরে সর্বত্র একটা ছুটির আমেজও যেন ক্রমশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজনের কথায় কাজে সেটা বেশ ধরাও পড়ে যায়। এবারও, এত এত বছর পর এত এত পরিবর্তনের মধ্যেও সে ছুটির ডাকে ব্যতিক্রম ঘটেনি! শুধু কি তাই, প্রকৃতিদেবীও মনে হয় আমাদের প্রতি কিছু প্রসন্ন হয়েছেন। তাই হয়তো মাঝে ক’দিন ধুমধাম করে যে বৃষ্টি নামছিল, তার দাপটও অনেকটা কমে যাচ্ছিল। এক আধ পশলা সামান্য ঝিরঝিরে কখনও কোথাও হলেও তা পুজোর আয়োজনে বা মানুষজনের কেনাকাটার আনন্দে বিশেষ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে না। বরং, বিশ্বকর্মা পুজো শেষে আশ্বিন পড়তেই বৃষ্টি মেঘের ফাঁক দিয়ে শরতের ঝলমলে নীল আকাশটা উঁকি দিতে শুরু করেছে। তাতে, পুজো উদ্যোক্তাদের বুকে ঘনিয়ে ওঠা ক’দিন আগের দুশ্চিন্তা যেমন অনেকটা ফিকে হয়েছে তেমনি মানুষজনের মধ্যেও স্বস্তি ফিরেছে। এবার দক্ষিণবঙ্গে দেরি করে এসে বর্ষা যেভাবে শুরু করেছিল তাতে মনে হচ্ছিল সে এবার পুজোটা হয়তো কাদা জলে পণ্ড করে ছাড়বে। এখন অনেকসময়েই শরতের ঝকঝকে আকাশ দেখে মানুষজনের মন থেকে সে শঙ্কাও নিশ্চয়ই অনেকটা দূর হয়ে গেছে। দোকানে বাজারে উৎসবমুখর মানুষের ঢল তার প্রমাণ দিচ্ছে। তবে, প্রকৃতিদেবীর খেয়াল বলে কথা। আমাদের যা অত্যাচার তিনি সইছেন, সয়ে আসছেন বছরের পর বছর তাতে তাঁর মাথা মন কতদিন কতটা শান্ত, ঠান্ডা থাকবে তা বোধহয় খোদ বিশ্বকর্তাও বলতে পারেন না, আমরা তো সামান্য মানুষ! তাই, পুজোর দিনগুলো নিয়ে একটা হালকা চিন্তা থেকে যায় বইকি।
তবে সে চিন্তার চেয়ে তো এখন বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি—পুজোর মুখে রাজ্যে এমন হইহই রাজনীতি, এমন একটা ডামাডোল পরিস্থিতি—সাধারণের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে নাকি? পুজোর মুখে কোথায় সবদিক ঠিকঠাক থাকবে, মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুরবে ফিরবে কেনাকাটা খাওয়া-দাওয়া করবে, প্যান্ডেল আলো মাইক প্রতিমা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তা না হাঙ্গামা পুলিস মিছিল পাল্টা মিছিল সিবিআই খোঁজাখুঁজি যানজট তর্ক-বিতর্কে উত্তাল এবং কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন। ক’দিন আগে এই রাজনৈতিক চাপান-উতোরের শুরুটা হল কলকাতার প্রাক্তন পুলিস কমিশনার রাজীব কুমারকে হেফাজতে নিতে সিবিআই অভিযানের মধ্য দিয়ে। কলকাতার সিবিআই দিল্লি থেকে আসা স্পেশাল সিবিআই দলে দলে ভাগ হয়ে মহানগরীর আইপিএস মেস থেকে পাঁচতারা হোটেল রিসর্ট মায় তার রান্নাঘর তোলপাড় করে খোঁজা শুরু করলেন রাজীব কুমারকে! টিভিতে তার ধারবাহিক বর্ণনার রোমাঞ্চ পুজোর আনন্দ ক’দিন অনেকটাই চাপা দিয়ে দিল। সকলে রাজীব-সিবিআই এপিসোড নিয়ে পড়লেন!
তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লি যাত্রা নিয়ে শুরু হল আর একপ্রস্থ রাজনৈতিক তরজা। সিপিএম, কংগ্রেস সমেত বিরেধীরা মমতার দিল্লি যাত্রা নিয়ে নানা কটুকাটব্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে আসর মাতিয়ে তুললেন। আর তারপরই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবুল-কাণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গেরুয়া শিবিরের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি’র একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে যাদবপুরের একদল ছাত্রছাত্রীর প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়লেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। অভিযোগ, গণ্ডগোল ঝামেলার মধ্যে বাবুল শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও রীতিমতো আহত হন, তাঁর জামাও ছিঁড়ে যায়! তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হল ডিজাইনার অগ্নিমিত্রাও! পরে রাজ্যপাল স্বয়ং ঘটনাস্থল থেকে বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করে আনেন। এই ঘটনা নিয়ে অনিবার্যভাবেই শাসক তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার অনুরোধ উপেক্ষা করে রাজ্যপালের ঘটনাস্থলে যাওয়া উচিত হয়েছে কি হয়নি তা নিয়েও বিতর্ক বেধেছে। আপাতত আমরা সে বিতর্কে
ঢুকছি না।
তবে, এটুকু বলছি, যাদবপুরের ঘটনা চূড়ান্ত অনভিপ্রেত। বাম অতিবাম কী অন্য কেউ—যাঁরাই এই কাণ্ড করে থাকুন তাঁরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বজোড়া সুনামের প্রতি সুবিচার করেননি। বাবুল সুপ্রিয় শত হলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তাছাড়া, এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ যশস্বী উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকেও তো অস্বস্তিতে পড়তে হল, অসুস্থ হয়ে ভর্তি হতে হল হাসপাতালে। পুজোর মুখে এমন দৃশ্য কি বাংলা বা বাঙালি কারও পক্ষেই সুখকর হল?
তার চেয়ে বড় কথা, ঘটনা তো যাদবপুরেই শেষ হল না। তাই নিয়ে মিছিল, পাল্টা মিছিল, ভাঙচুর, অবস্থান বিক্ষোভ—সব চলল। চলবেও হয়তো আরও! রাজীব কুমারের কী হবে, তাঁকে সিবিআই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে কি না বা নাকি শেষ অব্দি রণে ভঙ্গ দিয়ে রাজীব-সন্ধানে সাময়িক বিরতি নেবেন গোয়েন্দা কর্তারা—জানা নেই। কিন্তু যাদবপুর নিয়ে যদি জল আরও ঘোলায় তবে বাঙালির পুজোর উৎসবে তার প্রভাব পড়তেই পারে। এমনিতেই আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। পুজোর ক’টা দিন সেসব ভুলে থাকতে চান সকলেই। পুজোর ক’টা দিন মানে তো ওই চারটে দিন মাত্র নয়। বিশ্বকর্মা বিসর্জন থেকে জগদ্ধাত্রী—এই সময়টা। কিন্তু, বছরের এই সময়টুকুও যদি রাজনীতির হানাহানি বিতর্ক বিভ্রাট আর
শঙ্কা সংশয়ে ভরে থাকে তবে মানুষ হাঁফ ছাড়বে কোথায়! মুখ্যমন্ত্রী মমতার দিল্লি যাত্রা নিয়ে যাঁরা কটাক্ষ করছেন তাঁরাও কি প্রকারান্তরে পুজোর মুখের দিনগুলোকে রাজনীতি ভারাক্রান্ত করে তোলারই ব্যবস্থা করছেন না!
এদিকে উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়িতে একটি মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটার পর জানা যাচ্ছে মানুষটি নাকি এনআরসি’র আতঙ্কে আত্মঘাতী হয়েছেন! এমন আরও কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনার পিছনে এনআরসি’র আতঙ্ক কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের মতো কিছু এলাকায়। অথচ, এই পশ্চিমবঙ্গে আপাতত এনআরসি’র সম্ভাবনা যে নেই সেটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন প্রথম থেকেই। দিল্লি থেকে ফিরেও বলেছেন, এ রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না। তা সত্ত্বেও এমন সব বেদনাদায়ক মৃত্যু কেন? পুজোর মুখে যাঁদের পরিবারে এমন প্রিয়জন হারানোর ঘটনা ঘটল তাঁদের জন্য কোনও সান্ত্বনাই কি যথেষ্ট? কিন্তু, কী আর করা? নিয়তি বলে
মেনে নেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কী-ই বা করার আছে?
তবে, এনআরসি নয় আসন্ন পুজোয় যাদবপুর বা রাজীব নিয়ে রাজনীতি যেন আর গোল না পাকায় রাজ্যবাসী আপাতত সেই প্রার্থনাই জানাতে চাইছে। কারণ, তথ্যভিজ্ঞ মহলের খবর, অসমে এনআরসি নিয়ে নানা বিতর্ক ওঠার পর মোদিজি অমিতজিরা নাকি এনআরসি নিয়ে ধীরে চলো নীতি নিচ্ছেন। তাছাড়া, এনআরসি করতে যে বিপুল টাকা লাগছে সে খরচ চলতি মন্দার বাজারে জোগানোও অসুবিধেজনক। তাই, অসমে মহামান্য আদালতের নির্দেশে লাগু এনআরসির যাবতীয় সমস্যা মেটানোর পর অন্য রাজ্যের কথা ভাবা হবে—এমনটাই নাকি সিদ্ধান্ত। একথা বাতাসে উড়ছে, আমজনতার দরবারেও সে বাতাস পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও যে এনআরসি আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না—প্রান্তিক মানুষের ঘরে মর্মান্তিক আত্মহননের ঘটনা কি সেটাই বলছে না? অথচ, এই আতঙ্কের অবশ্য তেমন কোনও পোক্ত ভিত্তি এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, গোটাটাই তৈরি হচ্ছে গুজব ও এক ধরনের অতিরঞ্জনকে কেন্দ্র করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এনআরসি নিয়ে এই গুজব ও অতিরঞ্জনে লাগাম টানার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন। এবং সেসবে কান না দিতেও অনুরোধ জানিয়েছেন।
যাই হোক, পুজো আসছে। মাঝে আর মাত্র ক’টা দিন—তারপরই শুরু হয়ে যাবে দেবী দুর্গার আরাধনায় মত্ত বাঙালির উৎসব যাপন। আমাদের বিশ্বাস, সেই উৎসবের আনন্দ কোলাহলে আলোর বন্যায় জনস্রোতে ক’দিনের জন্য হলেও এনআরসি হোক কি যাদবপুর কি সারদা নারদা রাজীব কুমার—সব তলিয়ে যাবে। চিহ্নমাত্র থাকবে না। এতদিন তাই হয়েছে—এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
অতএব, মাভৈঃ।