শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
প্রশাসন পরিচালনা সম্পর্কে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি ১৫১৩ সালে তাঁর ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ভালোবাসা আর ভয় পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে না। তুলনামূলকভাবে ভয় অনেক বেশি নিরাপদ ভালোবাসার থেকে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন প্রশাসককে প্রজা ভালোবাসে, এই প্রবণতা খুবই আনন্দাদায়ক হতে পারে, কিন্তু সেই ভালো লাগা অবস্থান যে কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে বদলে যেতে পারে। তখন আর ভালোবাসা না থেকে সেই প্রজা হয়তো বিদ্রোহী হয়ে যাবে। তাই ভয় অনেক বেশি কার্যকরী। কারণ যতদিন ভয় বজায় থাকবে,ততদিনই সিংহাসন সুরক্ষিত। আর তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগে দেখা যেত এই ভয় কায়েম করে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত রাজতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্র কিছু না কিছু একটা ক্রাইসিস তাদের সাম্রাজ্যে হয় নির্মাণ করছে অথবা বজায় রেখে প্রচার করছে। যাতে অন্তহীন একটার পর একটা আশঙ্কার বাতাবরণ সারাক্ষণ রাষ্ট্রে জোরালোভাবে থাকে। তাহলে জনগণ সেই জানাঅজানা আশঙ্কা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ভীত হয়। সাধারণত মানবসভ্যতায় দুই রকমের সরকার দেখা যায়। একটি হল ওয়ারফেয়ার প্রশাসন। অর্থাৎ সারাক্ষণই কেমন যেন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাব। আর একটি হল ওয়েলফেয়ার সরকার। যে সরকার নিভৃতে নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কার্যে ব্যাপৃত থাকে এবং চেষ্টা করে রাষ্ট্রে যতটা সম্ভব সংঘাত কিংবা অস্থিরতাকে নিবৃত্ত করে রেখে শান্ত একটি আবহে সরকার পরিচালনা করতে। নীতি আদর্শ অনুযায়ী যুগে যুগে বিভিন্ন সরকার এই দুটি নীতি সামনে রেখেই এগিয়েছে।
এই প্রসঙ্গগুলি সামনে আসার কারণ হল আমরা লক্ষ্য করছি আমাদের জীবন এখন অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় স্তরের ঘটনাপরম্পরা পরিচালনা করে চলেছে। প্রভাবিত করে চলেছে। কিছু বছর আগেও এভাবে সারাক্ষণ সাধারণ মানুষ নানাবিধ কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে চর্চা, প্রতিবাদ, সমর্থন কিংবা তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করেনি। কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের আমলে এই প্রবণতা বহুল পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, পরোক্ষে একটি ভয়, আশঙ্কা এবং অনিশ্চিয়তার চর্চাই সবথেকে বেশি স্থান করে নিচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে। প্রতিটি আলোচনায় চলে আসছে পক্ষে বিপক্ষে দুটি প্রকট বিভাজন। আবার কি কোনও বিশেষ নোট বাতিল হয়ে যেতে পারে? ব্যাঙ্কের সুদ কি আবার কমবে? এনআরসি কি আমাদের এখানেও চালু হবে? যদি চালু হয় তাহলে ডেটলাইন কী হবে? কোন কোন কাগজপত্র রেডি রাখা দরকার? হিন্দি কি একমাত্র অফিসিয়াল ভাষা হতে চলেছে? ইংরেজি তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে? হিন্দি না শিখলে তাহলে আগামীদিনে কি শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে বড়সড় সঙ্কট হবে? পাকিস্তান যদি পরমাণু বোমা ফেলে তাহলে কী হবে? উত্তর পূর্ব ভারতের আশঙ্কা কাশ্মীরের ৩৭০ অবলুপ্তির পর এবার কি ওইসব রাজ্যে ৩৭১ অবলুপ্তি হয়ে যাবে?
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন নোটবাতিল। তারপর থেকে লক্ষ করা যায়, যখনই সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় আজ রাত আটটায় কিংবা বিকেল চারটেয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, তৎক্ষণাৎ একটা অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা ও চরম কৌতূহলের সঞ্চার হয়ে যায় গোটা দেশে যে ‘এবার আবার কী নতুন হতে চলেছে ঘোষণা?’ গরিব খেটে খাওয়া এবং জীবিকার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করে চলা প্রান্তিক কোটি কোটি মানুষগুলিকে বাদ দিলে প্রায় গোটা ভারতই উৎসুক, উদগ্রীব হয়ে টিভির সামনে হাজির হয় যে দেখা যাক নতুন কী ঘোষণা হবে!
এনআরসি চালু করা হলে প্রকৃত যাঁরা ভারতবাসী তাঁদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর মোটামুটি বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের টার্গেট করা হবে যারা বেআইনি নাগরিক। কিন্তু অসমে দেখা যাচ্ছে বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু বাঙালি। মুসলিম অনেক কম। সুতরাং তারপরও যখন অমিত শাহ ঘোষণা করেন গোটা দেশেই চালু করা হবে এনআরসি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আর নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। হিন্দু মুসলিম সকলের মধ্যেই ভয় আর আশঙ্কা ঢুকে গিয়েছে। তাই আজকাল সর্বত্র এনআরসি নিয়ে আলোচনা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আলোচনা আবর্তিত হয়েছিল ৩৭০ নিয়ে। এনআরসির পাশাপাশি এখন এসেছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের আশঙ্কা। সেই রেশ কাটার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার বলেছেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অর্থাৎ জল্পনা চলছে তাহলে কি বিজেপির আগামীদিনের লক্ষ্য ওয়ান নেশন, ওয়ান পার্টি, ওয়ান ল্যাংগুয়েজ?
বস্তুত প্রশ্ন হল এভাবে নিরন্তর আলোচনার কেন্দ্রে থাকা আর অনিশ্চয়তার বাতাবরণ নির্মাণ করে সরকার পরিচালনার পদ্ধতি কি সম্পূর্ণ পরিকল্পনামাফিক? সম্ভবত এটাই একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশল বিজেপির দুই শীর্ষ নেতার। তাঁরা একটি ব্যাপারে সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন। সেটি হল ভারতজুড়ে প্রতিনিয়ত তাঁরাই আলোচনার কেন্দ্রে থাকছেন সর্বদাই। একটা দিনও এরকম যাচ্ছে না যে সাধারণ মানুষ কোনও একটি বিষয়কে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদি অথবা অমিত শাহকে নিয়ে আলোচনা করছে না। এই যে অবিরত আলোচনায় থাকার প্রয়াস এর কারণ কী? কারণটি হল একটা পরোক্ষ বার্তা প্রদান যে এই সরকার নজিরবিহীনভাবে সক্রিয়। মোদি এবং অমিত শাহ এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যে তাঁরা অতীতের প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের তুলনায় অনেক বেশি অ্যাকটিভ। আধুনিক সমাজের একটি বিশেষ অংশের পালস তাঁরা সম্যকভাবে ধরে ফেলেছেন। সেই অংশটি অ্যাকটিভিটি পছন্দ করে। তারা সর্বদাই চায় একটা কিছু উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটুক। এবং সরকার সর্বদা অ্যাকটিভ থাকুক। সেই অ্যাকটিভিটি আদতে ভালো না মন্দা বার্তা নিয়ে আসছে তা না ভাবলেও চলবে।
কিন্তু একটা পারসেপশন তৈরি হয়ে যায় যে এই সরকার অতি সক্রিয়, অলস নয়, আগে যা কেউ পারেনি এরা সেটা করে দেখাচ্ছে ইত্যাদি। আধুনিক যুগের এই ইনস্ট্যান্ট ডেমোক্রেসিতে এটা অত্যন্ত জনপ্রিয়। মনে করলে দেখা যাবে ডঃ মনমোহন সিংকে নিয়ে এরকম নিরন্তর আলোচনা, চর্চা হতো না। অথচ তাঁর ১০ বছরে ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি, তথ্য জানার অধিকার, কৃষকদের ৭০ হাজার কোটি টাকার ঋণ মকুব, ২০০৮ সালের বিশ্বজুড়ে মন্দার সময়ও ভারতের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো থাকা ইত্যাদি বহু ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। যা আজও সমান কার্যকর। কিন্তু যেহেতু মনমোহন সিং, প্রণব মুখোপাধ্যায় অথবা পি চিদম্বরমরা অতটা ভোকাল ছিলেন না, তাই সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘিরে সারাক্ষণ কোনও চর্চা, আলোচনা হতো না। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা লার্জার দ্যান লাইফ এক ইমেজে পর্যবসিত হননি তখন।
এখন কিন্তু সেটাই হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ অথবা সামগ্রিকভাবে সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, রাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘকালীন ক্ষতিকর হতে পারে, অত্যন্ত অবিমৃশ্যকারী হতে পারে, আবার সেই সিদ্ধান্তগুলি ভালোও হতে পারে। এসব চর্চার থেকেও বড় যে বার্তাটি সামনে আসছে তা হল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীদের থেকে প্রচারের হাওয়াটি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন এই দুজন। সমর্থন অথবা নিন্দা, প্রতিদিন আমজনতা মোদি, অমিত শাহকেই নিয়েই ব্যস্ত। তাঁদের নিয়েই চলে চর্চা। রাজনৈতিকভাবে এই যে নিজেদের একটা অবিরত রাজনৈতিক-সামাজিক ডিসকোর্সের কেন্দ্রে নিয়ে আসা এটা একটা বৃহৎ সাফল্য। মোদি এবং অমিত শাহ সর্বদাই চাইছেন মানুষ তাঁদের নিয়েই আলোচনা করুক। অন্য কোনওদিকে চর্চার অভিমুখ ঘোরানোর সুযোগই দেন না তাঁরা।
তাই দেখা যাচ্ছে, ক্রমাগত একটির পর একটি ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। একটি ইস্যু থিতিয়ে গেলেই আবার অন্য একটি বিষয় নিয়ে তোলপাড়। আজ আম জনতা আর কাশ্মীরে সত্যিই কতটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে তা নিয়ে খোঁজখবর নেয়? নেয় না। এটাই জনতার প্রবণতা। দ্রুত ইস্যু থেকে ইস্যু থেকে সরে যাওয়া। আর এই প্রবণতাকেই কাজে লাগিয়ে নিজেদের সর্বদাই মানুষের মস্তিষ্কে স্থান করে দিয়ে চলেছেন মোদি ও অমিত শাহ। তাঁদের সম্পর্কে বিরক্তি কিংবা ভালো লাগা যাই হোক, মানুষের চর্চা তাঁদের ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
শাসকের অন্যতম প্রিয় অস্ত্র হল ভয়। সেটা সর্বদাই যে জনতাকে প্রত্যক্ষভাবে ভয় দেখানো এমন নয়। সম্ভাব্য শত্রু ও অজানা আশঙ্কার একটি অবয়ব তৈরি করে প্রতিটি সমস্যার কারণ হিসেবে সেই অবয়বের দিকে আঙুল তোলা একটি বিশেষ প্রশাসনিক কৌশল। প্রাচীনকাল থেকে এরকমই একটি বিশেষ শাসনপ্রক্রিয়ার নাম হল পপুলার ফিয়ার। অর্থাৎ যে ভয়টি জনপ্রিয়। মানুষ যে ভয়কে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে। বৃহৎ সংখ্যক মানুষ ওই ভয়টাকে সত্যি মনে করে। তাই মাঝে মধ্যেই প্রচার করা হয় সমস্যা, সঙ্কট, বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এজন্য দায়ী হল কোনও বিশেষ জাতি, কোনও বিশেষ সম্প্রদায়, বিশেষ একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র, দেশের অভ্যন্তরের বিশেষ শ্রেণী। এরা সকলেই শত্রুপক্ষ। বৃহত্তর সংখ্যক জনগণের কাছে এই ধারণাটি গ্রহণযোগ্য হয়। অবিশ্বাস আর ভয়ের ককটেল।
জনগণকে তাই সর্বদাই পাশে পেতে মাঝেমধ্যেই সঙ্কট তৈরি করা নিয়ম। অর্থাৎ যুদ্ধ হতে পারে, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, রক্তক্ষয়ী কোনও বিপ্লবের চক্রান্ত হতে পারে। এরকম আশঙ্কা এবং সম্ভাবনায় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সরকারের পাশে থাকবে। আর সেটাই কাম্য। এই পদ্ধতি নতুন কিছু প্রবণতা নয়, প্রাচীন ইওরোপ এশিয়ার ইতিহাস থেকেই জানা যায়, এই প্রক্রিয়ার নাম ‘পপুলার ক্রাইসিস!’