শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
আসলে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনশৈলী যেভাবে এগিয়েছে, তাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল স্থিতাবস্থা। অবশ্যই কিছু মহান মানুষ বদ্ধ ঘরে না থেকে জগৎ জয় করতে চান। তাঁরাই হয়তো এই সভ্যতার অগ্রগতিতে অনেকটা বেশি অবদান রাখেন। কিন্তু মোটের উপর বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ জীবন কাটিয়ে দেন সাদামাটা উপায়ে। এর মধ্যে যদি বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী হিন্দু বাঙালিদের কথা ধরা যায়, তারা খুব বাধ্য না হলে নিজের গ্রাম-শহর ছেড়ে দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়েন না। অবশ্যই যত দিন যাচ্ছে এই রাজ্যে কাজের সুযোগ কমছে অনেকটা। সে জন্যেই হয়তো দেশের অন্যান্য অংশে বৃত্তির সন্ধানে পাড়ি দেন নিম্নবিত্ত মানুষ। বাঙালি মধ্যবিত্তদের একটা অংশ পড়াশোনা করে পৌঁছে যান আমেরিকা কিংবা ইউরোপে। কিন্তু শতাংশের হিসেবে তা নগণ্য। সাধারণ বাঙালি থাকতে চান তাঁর নিজের বাড়িতে, অতিপরিচিত সংসারের বন্ধনী আঁকড়ে। তাতে একটু কষ্ট হলেও তাঁরা মেনে নেন অনেক কিছু। সময়ের সঙ্গে শহরাঞ্চলে যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো অণুবৃত্ত। তবে তা শুধু শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালির বৈশিষ্ট্য। উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির ছাদে বেড়ার দেওয়াল দিয়ে ভেন্ন হওয়া কিন্তু সারা বাংলার চিত্র নয়। গ্রাম কিংবা মফস্সলে নিম্নবিত্ত বাঙালি সংসার এখনও ততটা ভাঙেনি। সব মিলিয়ে হিন্দু বাঙালি মনের যে নমনীয়তা, দুঃসাহসিকতার অভাব, স্থিতিশীল একান্নবর্তী জীবনযাত্রার প্রতি আসক্তি, সেটাই আমাদের চরিত্র। কথায় কথায় সমাজবদলের ডাক দিয়ে শুধু হইচই করলেই তো চলবে না। মায়ের হলুদ মাখা আঁচল, বাবার সন্ধেবেলার আড্ডা, ছোট ছেলেমেয়েদের দল বেঁধে সরস্বতী আরাধনা, বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ঘুড়িতে মাঞ্জা, দুর্গাপুজোয় অষ্টমীর অঞ্জলি, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, উত্তম-সুচিত্রা, হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-আরতি সব মিলিয়ে হিন্দু বাঙালির যে ছবি, সেটাকে মুছে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। বিশেষ করে আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই প্রবণতা বিশেষভাবে বর্তমান, আমাদের এই রাজ্যেই। সেই জন্যেই হিন্দু বাঙালি এখন পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে। তারা কি বাধ্য হবে রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে নিজেদের বদলাতে? নাকি লড়ে যাবে শিকড়টাকে শক্ত অথচ চেনা মাটিতে গেঁথে রাখার সংগ্রামে?
অসমে যখন দেশ হারাচ্ছেন মানুষ, ঠিক সেই সময়েই শহর কলকাতায় নিজের বাড়ি হারাচ্ছেন বহু বছর ধরে বউবাজারে দিন কাটানো লোকজন। দু’দিকেই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। অসমের এনআরসিতে দেশ থেকে কিছু মানুষ কমিয়ে বাকি নাগরিকের উন্নতির উপন্যাস। কলকাতায় মাটির তলা দিয়ে পাতালরেল চালিয়ে শহরের মুখ উজ্জ্বল করার ছোটগল্প। দু’দিকেই হাড় হিম করা অনুভূতি। কোথাও হারাতে হবে দেশ, কোথাও বা নিজের পূর্বপুরুষের ভিটে। উন্নয়নের হিংস্রতায় কিছু মানুষের যে প্রাণ যাবে, একথা এখন সবার জানা হয়ে গেছে। সেটাই তো সভ্যতার সংজ্ঞা। কিন্তু তবু তো আমরা চাই নিজের মতো করে একটু শান্তিতে বাঁচতে। পাতাল রেলের পথ কখন কীভাবে বদলাবে সেকথা জানার অধিকার থাকবে না কলকাতায় বহু বছর ধরে বাস করা বাঙালি পরিবারের? কী ভাবছেন আমাদের রাজ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করা তৃণমূল সরকার আর তাঁদের দখল করা কলকাতা পুরসভা? তাঁদের অনুমতি ছাড়া তো মাটির তলার দানবীয় যন্ত্র যখন তখন পথ বদলাত না। বহুদিন ধরে অসমে বাস করা হিন্দু বাঙালির নাম বাদ যাবে নাগরিকপঞ্জি থেকে। এ ব্যাপারে কী ভাবছে বিজেপি? তাদেরও তো কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইনিংস। প্রশ্ন উঠবেই, কারণ গত সাতই সেপ্টেম্বর, শনিবার, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সম্মেলন হয়েছে রাজস্থানের পুষ্করে। সেখানে আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত সংগঠন ‘সীমা জাগরণ মঞ্চ’ অত্যন্ত দুশ্চিন্তার সঙ্গে জানিয়েছে যে অসমে নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ যাওয়া উনিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশ হিন্দু। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এই সংখ্যায় হিন্দু বাঙালি খুব কম নেই।
একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেস, বাম এবং তৃণমূল ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু তোষণ করেছে। আর এই তোষণ একেবারেই লোক দেখানো, কারণ সকলেই জানেন এরাজ্যে সেভাবে সংখ্যালঘুরা উচ্চপদের সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পেয়ে থাকেন বেশ কম। তাঁদের সার্বিক উন্নতি হয়নি কিছুই। তবে এই লেখায় তাঁদের কথা থাক। যেটা বলার তা হল কংগ্রেস, বাম, তৃণমূলের লোক দেখানো অসাম্প্রদায়িকতার স্লোগানে হিন্দু বাঙালিদের ভুগতে হয়েছে প্রচুর। আর আজকের দিনে বিজেপির যে রাজনীতি, তাতে সংখ্যালঘুদের চাপে রাখার বিষয়টা পরিষ্কার। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁদের কর্মসূচিতে হিন্দু বাঙালিদের ভবিষ্যতের কথাও খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না। বাংলার বাইরে থেকে ধার করে আনা হিন্দুত্বের দাপটে এই রাজ্যের মানুষের অবস্থা বেশ কোণঠাসা। রামনবমী কিংবা গণেশপুজোর উৎসবে অবশ্যই অবাঙালি প্রভাব বেশি। তাই বিজেপির নেতানেত্রীদের মুখে বাংলা থেকে এক, দুই কিংবা তিন কোটি অনুপ্রবেশকারী বিদায় করা নিয়ে যে আস্ফালন তাতে হিন্দু বাঙালিদের ভয় পাওয়ারই কথা। শেষে হয়তো দেখা গেল যে এরাজ্যে হিন্দু বাঙালিরাই ভিড় করে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকছে!
আসলে সাধারণ হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে কড়া হিন্দুত্ব কম, উদারনীতি এবং প্রগতিশীলতা বেশি। রোজ দুবেলা লোক দেখানো পুজো পার্বণ বাঙালিদের ট্র্যাডিশন নয়। কিন্তু একটু পরিসংখ্যান নিলেই দেখতে পাবেন বহু বাঙালি বাড়িতে নিত্যপূজা হয় আজকের দিনেও। সে পুজোয় আড়ম্বর নেই, আছে বিশ্বাস। সাধারণ বাঙালিদের কাছ থেকে তাদের সাধের দুর্গোৎসব একেবারে হাতছাড়া। তা এখন কর্পোরেটের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকেছে। পুজো কমিটি আর প্যান্ডেলের মালিকানা নিয়ে লড়াই করছে তৃণমূল-বিজেপি। বাড়ির কাছে শান্তিতে অঞ্জলি দেওয়ার জায়গা নেই, এদিকে দুর্গাপুজোর সময় রাস্তা আটকে বাঁশ বেঁধে প্যান্ডেল বানানোয় যানজটে বিপর্যস্ত হিন্দু বাঙালিরাই। কলকাতার বাইরে অবশ্যই দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু একটু হিসেব কষলে দেখা যাবে যে মুম্বইতে কুড়ি বছর আগে যতগুলো দুর্গাপুজো হতো, তার থেকে খুব বেশি কিছু সংখ্যা বাড়েনি। অথচ, কলকাতায় কুড়ি বছর আগে গণেশপুজোর এরকম রমরমা বারোয়ারি চরিত্র দেখা যেত না আদৌ। এর কারণ বাংলার প্রচারসর্বস্ব ধর্মাচরণে এখন পুরোটাই রাজনীতি। আর সেই জায়গাতেই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ আর সংখ্যালঘু তোষণের জটে পথ হারাচ্ছে হিন্দু বাঙালি। অন্ধ ধর্মবিশ্বাস বা ধান্দাবাজির রাজনীতি দিয়ে এই শ্রেণীর উন্নতির সম্ভাবনা কম।
হিন্দু বাঙালিদের বাঁচাতে পারে তাদের নিজস্ব প্রগতিশীল চেতনা, উদারনৈতিক ভাবধারা এবং আন্তরিক ধর্মবিশ্বাস। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকেও যে হিন্দু বাঙালিদের ভালো রাখা যেতে পারে, এই বিষয়টা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাই নিজেদের উৎসবের মরশুমে একটাই প্রার্থনা, হিন্দু বাঙালিরা পুজোর কদিন একটু শান্তিতে ধর্মাচরণের সুযোগ পাক। সেটা আমিষ খেয়েই হোক বা নিরামিষ। সেখানে যেন রাজ্যের উন্নয়নে পায়ের তলার মাটি না সরে যায়, আর রাষ্ট্রের উন্নয়নে যেন দাঁড়াতে না হয় নাগরিকত্ব প্রমাণের দীর্ঘ বক্ররেখায়। রাজনীতির কারবারিরা একটু সরে দাঁড়িয়ে আম জনতাকে একবার মনে করার সুযোগ দিন যে দুর্গাপুজো আসছে। তিনি তো শুধু আমাদের উপাস্য দেবী নন, হিন্দু বাঙালির ঘরের মেয়ে।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত