শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
পরিকল্পনা মতো শুরু হল কাজ। তৃণমূলের দাপুটে, কোণঠাসা, প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ। একবুক প্রত্যাশা নিয়ে দিল্লিতে উড়ে গিয়ে বীরভূমের লাভপুরের বিতর্কিত দাপুটে বিধায়ক মনিরুল ইসলাম, খানাকুল পঞ্চায়েত সমিতির কর্তা নইমুল হক ওরফে রাঙা বিজেপিতে যোগ দিলেন। লাইনে তখন আরও অনেকে। কারণ দল বাড়ানোর আশায় হাট করে খুলে রাখা বিজেপির দরজা দেখে কাটমানিতে আতঙ্কিত অনেকেই ‘রক্ষাকবচ’-এর আশা দেখেছিলেন। কিন্তু, জেলায় ফিরতেই মনিরুল সাহেবের কপালে সংবর্ধনার বদলে জুটল বিক্ষোভ। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেল যে, মনিরুল ইসলাম প্রকাশ্যে সদস্যপদ গ্রহণ করেও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। মনিরুল সাহেবের ‘আমও গেল, ছালাও গেল’। আর এসব দেখে বিজেপির দিকে পা বাড়ানো নেতারা ব্রেক কষলেন।
বিজেপি নেতৃত্বও স্ট্র্যাটেজি বদল করল। তৃণমূলের ভুলভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে কাছে পাওয়ার দিকে নজর দিল। কৌশলটা অনেকটা মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো হাতে গ্লাভস পরে উইকেটের পিছনে ওঁত পেতে বসে থাকা। ক্রিজ ছেড়ে বেরলেই স্টাম্প আউট করা অথবা ক্যাচের জন্য অপেক্ষা। বল ব্যাটের কানায় লাগলেই তা লোফার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া।
সেই স্টাইলেই বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলি গ্রামেগঞ্জে, মহল্লায় মহল্লায় তৃণমূলের ত্রুটি কাজে লাগিয়ে মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা। সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা, রাস্তা তৈরি নিয়ে অশান্তি, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখলেই হাজির। বিক্ষুব্ধ তৃণমূল ও সিপিএমের হতাশাগ্রস্তদের বিজেপির পতাকার নীচে শামিল করে থানায়, বিডিও অফিসে ডেপুটেশন। কিন্তু, মুসলিম প্রভাবিত এলাকার বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ভুলেও ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিচ্ছে না। যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি গেরুয়া শিবিরের কর্মীদের কাছে মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করে, সেটাও কৌশলগত কারণে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মুসলিম তোষণের জন্যই এরাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত—এমন কথা সিপিএম এবং কংগ্রেসের প্রায় সর্বস্তরের নেতার মুখেই শোনা যায়। তাঁদের বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অত্যধিক মুসলিম তোষণে’র কারণেই এরাজ্যে বিজেপি বেড়েছে এবং ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটেছে। অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে অভিযোগ করেন, তৃণমূলের জন্যই গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্র মুসলিমদের প্রভাব ও দাপট বেড়েছে। আর সেই কারণেই হিন্দুদের একটা বড় অংশ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির কথা না ভেবে আবেগতাড়িত হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।
মুসলিম ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিছু হটেননি। উল্টে তিনি কোনও রকম রাখ ঢাক গুড় গুড় না করেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি মুসলিমদের জন্য কাজ করবেন। কারণ মুসলিম সহ সমস্ত সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাঁর কর্তব্য। অনেকেই মনে করেন, মমতা মুখ ফসকে এমন কথা বলে ফেলেছেন, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং মুসলিম ভোট নিজের দলের অনুকূলে আরও এককাট্টা করার জন্যই এমনটা বলেছেন। কারণ তিনি হয়তো মনে করেছেন, মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে পারলে ২০২১ সালে ফের ক্ষমতা দখলের দৌড়ে তিনি একধাপ এগিয়ে থাকবেন।
তবে বিজেপিও তৃণমূল নেত্রীর এই বক্তব্যকে কাজে লাগিয়ে ভোট রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিজেপি নেতা-কর্মীরা হিন্দু প্রভাবিত এলাকায় গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুসলিম প্রীতি’র কথা অত্যন্ত কৌশলে প্রচার করছেন। এমনকী, এনিয়ে প্রচার করতে গিয়ে তাঁরা ফিরহাদ হাকিমকে কলকাতার মেয়র করার প্রসঙ্গও টেনে আনছেন। বলছেন, ‘কলকাতার মেয়র করার জন্য আর কি কেউ ছিলেন না? সুব্রত মুখোপাধ্যায়ই তো মেয়র হিসেবে কলকাতার কত উন্নয়ন করেছিলেন। তাঁকেও তো দায়িত্ব দেওয়া যেত! আসলে মুসলিমদের খুশি করতেই এই সিদ্ধান্ত।’ চায়ের দোকানে, পাড়ার আড্ডায় বিজেপি এবং আরএসএস কর্মীদের এসব কথা মানুষ শুনছেন। সম্ভবতও তাঁরা ভাবছেনও। বিজেপি বোঝাতে চাইছে, তৃণমূল থাকলে এরাজ্যে হিন্দুদের ‘নিজভূমে পরবাসী’র অবস্থা হবে।
পঞ্চায়েত স্তরে কাটমানি, তৃণমূলের এক শ্রেণীর নেতার ফুলেফেঁপে ওঠা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত দখল, স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ধর্মীয় মেরুকরণ সহ নানা ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পায়ের তলার মাটি অনেকটাই শক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু তাতেও বঙ্গজয়ের ব্যাপারে গেরুয়া শিবিরের সংশয় থেকেই যাচ্ছে। লোকসভা ভোটে কেন্দ্রে স্থায়ী এবং দৃঢ় সরকার গঠনের ইস্যুটি ভীষণভাবে কাজ করেছিল। পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে এবং দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে মোদিজির উপরেই পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষ আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু, মোদিজির দ্বিতীয় ইনিংসের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হতে না হতেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের জোরদার সমালোচনা শুরু হয়েছে।
দেশের আর্থিক অবস্থা যে ক্রমশই খারাপ হচ্ছে, তা বোঝার জন্য অমর্ত্য সেন হওয়ার দরকার হয় না। নতুন করে কর্মসংস্থান দূরঅস্ত, প্রায় সর্বস্তরেই মানুষ কাজ হারাচ্ছে। বিএসএনএল দিন দিন রুগ্ন হচ্ছে, গাড়ির বিক্রি ৩১ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্কটজনক যে মারুতির মতো সংস্থাকেও দু’টি ইউনিটের উৎপাদন দু’দিন বন্ধ রাখতে হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিও ধুঁকছে। ব্যাঙ্কের ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাস্থ্য ফেরাতে ঋণ নেওয়া ও জনগণের গচ্ছিত রাখা টাকার সুদের উপর কোপ পড়ছে। তাতে ব্যাঙ্কের ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হবে কি না, সেটা সময় বলবে। কিন্তু, অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের ক্ষোভ বাড়ছে। কারণ তাঁদের সংসার চলে মূলত সঞ্চিত টাকার সুদের ভরসায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, আর আয় কমছে। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে তাঁরা নাকানি চোবানি খাচ্ছেন।
ব্যাঙ্কের মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য সরকারকে টাকার জোগান দিতে হচ্ছে। আবার সরকারও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ভাণ্ডার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। এসবের পিছনে বিজেপি নেতৃত্ব যে যুক্তিই দেখাক না কেন, অর্থনীতির হাল যে ভালো নয়, সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ সাধারণ মানুষ একটা কথা জানে, রক্ত তখনই দিতে হয়, যখন রোগী সঙ্কটজনক।
কাটমানি ইস্যুতে লাগাতার হেনস্তা হওয়ার পর বেশিরভাগ গ্রামেই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের অবস্থা অনেকটা সাপে কাটা রোগীর মতো হয়ে গিয়েছিল। ভয়েই হার্টফেল করার উপক্রম। সাপ বিষ ঢালতে পেরেছে কি না, সেটা দেখার অবস্থাতেও ছিল না। কিছু একটা কিলবিল করলেই আতঙ্কে তড়াক তড়াক করে লাফাচ্ছিলেন তাঁরা। যে সব দাপুটে প্রধানের ঝাঁঝের চোটে মানুষ কাছে ঘেঁষতে পারত না, লোকসভা ভোটের পর তাঁরাই বাড়িতে সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন এই অবস্থা চলার পর কোথাও কোথাও বিজেপির নেতাকে ‘তোয়াজ’ করে, কোথাও ‘খুশি’ করে, আবার কোথাও পুলিসের ভরসায় তাঁরা এলাকায় ফিরেছেন। শুধু এলাকায় ফিরেই থেমে থাকেননি, মিছিল মিটিংও শুরু করেছেন। সেসব দেখে বহু জায়গায় গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়া পঞ্চায়েত ও পুরসভার সদস্যরা ফের তৃণমূলমুখী হচ্ছেন। ফলে, লোকসভা ভোটের পরপরই হাটে-বাজারে ওঠা ‘গেল গেল’ রবটা কেমন যেন দিন দিন মিইয়ে যেতে বসেছিল। আর ঠিক সেই সময় দুম করে বাজারে এনআরসি চলে আসায় ‘রাজনীতির শেয়ার মার্কেট’ বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
অনেকে মনে করছেন, এনআরসিকে সামনে রেখে বিজেপি এক ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চাইছে। একদিকে, নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসির জুজু দেখিয়ে মুসলিমদের কব্জা করা। অন্যদিকে ‘নিজরাজ্যে পরবাসী’ হয়ে থাকার আক্ষেপ মোচনের স্বপ্ন দেখিয়ে হিন্দুভোট আরও বেশি করে নিজেদের দিকে টানা। তাছাড়া যদি এনআরসি হুজুগে মাতিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তখন রাজ্যবাসীর মাথায় কেন্দ্রের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনও অঙ্কই কাজ করবে না। তাই রাজ্য সরকারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও এরাজ্যে এনআরসি চালু করতে মরিয়া মোদি-অমিত শাহ জুটি।
অনেকেই বলছেন, এনআরসি এরাজ্যে বিজেপির বিপদ বাড়াবে। কারণ অসমে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ এদেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার মধ্যে মাত্র ৬ লক্ষ মুসলিম, বাকিটা হিন্দু সহ অন্য ধর্মের। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। অর্থাৎ এই বিপুল সংখ্যক মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন। তাঁদের পরিণতি কী হবে, সেটা এখনও কেউ জানেন না, বলতেও পারছেন না। কিন্তু, যে দলের সিদ্ধান্তের জন্য এই অনিশ্চয়তা তৈরি হবে তাদের মানুষ ‘আপনজন’ ভাবতে পারে না।
রাজনীতিতে ‘ব্যুমেরাং’ বলে একটি শব্দের ভীষণ চল আছে। আর এই অস্ত্রটি বহুবার তার কার্যক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন দল এবং নেতার ছোঁড়া অস্ত্রেই নিজে ঘায়েল হওয়ার নজির বিস্তর আছে। বঙ্গ রাজনীতিতেও এনআরসি গেরুয়া শিবিরের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে উঠবে না তো? ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত রাজ্যবাসীর কাছে সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।