শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
সেই অপরাধে ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হত্যা করা হয় গোপালচন্দ্র সেনকে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্য রানা বসুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে উপচার্যকে খুনের। পিছন থেকে ছুরির আঘাতে ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান গোপালচন্দ্র সেন। আর ধনী ডাক্তার বাবার ক্ষমতার কারসাজিতে কানাডায় পালিয়ে যান অতি বিপ্লবী রানা বসু। আচ্ছা, রানা যে নিকৃষ্টতম কাজটি করেছিলেন সেটা কি কেবল তাঁর অল্প বয়সের হঠকারিতা? না কি কেউ পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় প্ররোচনা দিয়ে ধীরে ধীরে তাঁর মাথায় বিষ ঢুকিয়েছিল? তার নাম ‘অসহিষ্ণুতা’!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ সাল। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) বিশ্ববিদ্যালয়ের কে পি বসু সভাগৃহে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেইসঙ্গে বক্তৃতামালা—‘স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের স্বরূপ’। আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলীপকুমার দুবে, শিল্পী অগ্নিমিত্রা পল এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। এবিভিপি-কে বা বিজেপি-কে কারও অপছন্দ হতেই পারে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তৃতা দেওয়ার অধিকার থাকবে না? তাঁকে ঘিরে ধরে জামাকাপড় ছিঁড়ে দিয়ে হেনস্তা করা হবে? কত বামপন্থী বক্তা ভারতের কত বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, তাঁদের মতামত রাখেন, সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও বামপন্থীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু, বাবুল সুপ্রিয়ের সঙ্গে যে অসভ্যতা যাদবপুরে করা হয়েছে সাম্প্রতিককালে ভূভারতে এর উদাহরণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা এই উচ্ছৃঙ্খল অসহিষ্ণুদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, উপাচার্য বলেছেন, আচার্য স্বয়ং এসেছেন। কিন্তু প্রতিবাদী ছাত্রদের কেউ কথা শোনেননি। তাঁরা বলেছেন, বাবুল সুপ্রিয়কে ক্ষমা চাইতে হবে। কেন? বাবুল কী অপরাধ করেছেন? যাদবপুরে অবামপন্থী মতবাদী হয়ে বক্তব্য রাখতে এসেছেন—এই তাঁর অপরাধ? কারণ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেদিন ৩ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তো এই দল তাঁকে ছেঁকে ধরে। এই চরম অসহিষ্ণুতাকে কেবল ছাত্রসুলভ চপলতা ভাবলে ভুল হবে। কয়েক দশক ধরে ঠান্ডা মাথায় শেখানো হচ্ছে এই অসহিষ্ণুতা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বার বার চোখে পড়েছে এই অসহিষ্ণুতা। কেউ যেন সুনিপুণভাবে শিখিয়েছে এই নিষ্ঠুর আচরণ। সংঘবদ্ধভাবে এই অসহিষ্ণুতার প্রদর্শনী যেন কৃতিত্ব! ১৯৯২ সাল। এপ্রিল মাসের এক দুপুরে সেন্ট্রাল লাইব্রেবির সামনে মাটিতে ফেলে একটি ছেলেকে চোরের মতো পেটাচ্ছে এক বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন। সেই বীরের দল তারপর তাঁকে ‘আশীর্বাদ ক্যান্টিন’-এর পিছনে ‘সায়েন্স ক্লাব’-এর সামনে নিয়ে এল। তখনও ছেলেটিকে পেটে ক্রমাগত লাথি মারা হচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে—‘বল, কোন কলেজ তোর?’ ছেলেটির তখন আর কথা বলার সামর্থ্য নেই। জানা গেল, ছেলেটি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়েন আর এবিভিপি-র পক্ষে রামমন্দির আন্দোলনের উপর আপত্তিকর (?) কিছু লিফলেট বিলি করছিলেন। সেদিন উপাচার্যের অফিসে গিয়ে ছেলেটিকে বাঁচিয়েছিলেন অধ্যাপক ধনঞ্জয় দাস। অধ্যাপক দাস সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন—‘এত নিষ্ঠুরতা কেন? ছেলেটিকে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে এখানে ঢুকেছে বলে? নাকি ও যে লিফলেট বিলি করছিল সেটা দেশের আইনে নিষিদ্ধ?’ উপাচার্যের অফিসে কারও কোনও উত্তর ছিল না। কারণ, উত্তরটা হল—‘আমরা অসহিষ্ণু।’ বিরোধী কোনও মত এখানে প্রকাশ করা যাবে না।
ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির কিছু ছেলে ২০১৬ সালের ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে একটি ছায়াছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছায়াছবিটি সেন্সর বোর্ডের অনুমোদিত একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার-পাওয়া—বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘বুদ্ধ ইন আ ট্রাফিক জ্যাম’। শেষ পর্যন্ত এই অতি বামপন্থীরা কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে ফিল্মটির প্রদর্শন প্রেক্ষাগৃহে করতে দেননি। কিন্তু, ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির স্নাতক স্তরের নাছোড়বান্দা ছাত্ররা ব্লু আর্থ ওয়ার্কশপের সামনে চাদর টাঙিয়ে দেখিয়েছিলেন বুদ্ধ ইন আ ট্রাফিক জ্যাম। ফিল্মের প্রদর্শন বন্ধ করতে না পেরে এই অসহিষ্ণুর দল সেদিন পাগলের মতো আচরণ করেছিল। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর গাড়িতে লাথি মেরে, পরিচালকের গায়ে থুতু দিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল। শেষে বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক দেবাশিস চৌধুরীকে ধরে বেধড়ক মারধর করে। তাঁর অপরাধ ‘থিঙ্ক ইন্ডিয়া’ নামে ছাত্রদের যে সংগঠন এই স্ক্রিনিংয়ের আয়োজন করেছিল তিনি তাদের মেন্টর ছিলেন। সেই অপরাধে ‘বহিরাগত’ অধ্যাপককে একটি মিথ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছিল বলে অভিযোগ। এই অসহিষ্ণু দলের আদর্শের ভিত এতটাই ঠুনকো যে তারা ভয় পায়, যে ছাত্রছাত্রীরা এরকম ছবি দেখলে তাদের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।
সেদিন দেখা গিয়েছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় একদল লোক সেখানে ঢুকল। যাদের সামনে ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব কয়েকজন। একজন পরিণত বয়স্কা একটি হ্যান্ড মাইক হাতে প্রদর্শনস্থলে চিৎকার করছেন। বাবুল সুপ্রিয়কে চুল টানা, জামা ছিঁড়ে দেওয়া কিছু কমবয়সি ছেলের কাজ ভাবলে, তাঁদের মদতদাতাদের পাপকে লঘু করা হবে। হ্যান্ড মাইক হাতে ওই ভদ্রমহিলা—যাঁরা বাম জমানায় নিরন্তর তরুণ মনগুলোকে একটিমাত্র মত ছাড়া সবকিছুকে মেরে থেঁতলে দেওয়ার পাঠ দিয়েছেন, যাঁদের ‘পার্টি ক্লাস’ শুনে রানা বসু তদানীন্তন উপাচার্যকে হত্যা করেছিলেন—সেই পরিণত বুদ্ধির মানুষগুলি সমানভাবে দায়ী। দায়িত্ব থেকে যায় সেইসব সংবাদ মাধ্যমেরও যারা তাদের সুপরিণত বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে এই ‘নুইসেন্স ভ্যালু’কে টিআরপি বাড়ানোর কাজে লাগান।
রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর আবেদনে বলেছিলেন—‘‘অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি/আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহ মোহে ভুলি/ সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে;/কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।’’ ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত স্বার্থে এই মধুমাখা বিষফল হাত থেকে টেনে ফেলে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন অধ্যাপক গোপালচন্দ্র সেন। আজও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের শারীরিক হেনস্তায় যে শতাধিক ছাত্রছাত্রী সমবেত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের মস্তিষ্কেই ওই অদম্য অসহিষ্ণুতা ঢোকাতে পেরেছে ওই অতি বামপন্থীরা। বাকিরা কেউ ভয়ে, কেউ বিপ্লবের স্টেটাস সিম্বল গায়ে লাগাতে আর বেশিরভাগই বন্ধুকৃত্য করতেই এই অশোভন কাজের সঙ্গে ছিলেন। এর জন্য অবশ্যই দায়ী যাদবপুরের মেরুদণ্ডহীন কর্তৃপক্ষ। যে মানুষটির শালগাছের মতো মেরুদণ্ড ছিল সেই উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে সমর্থন করার সাহস হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্বের।
আমার মতো হাজার হাজার প্রাক্তন ছাত্রের কাছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তীর্থক্ষেত্র। প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর থেকে পিএইচ-ডি, সবটুকু পাঠই এখান থেকে। দেবদুর্লভ হৃদয়ের, অসামান্য পণ্ডিত অধ্যাপকদের সান্নিধ্য পেয়েছি। এঁরা কত বড় মাপের মানুষ তা গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছিলাম বলে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। আজও গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রযুক্তিবিদ্যা বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের (সাহিত্য আর সমাজবিজ্ঞানেরও নিশ্চয় আছেন) যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের পৃথিবীর নামকরা প্রতিষ্ঠানে দেখে গর্ব হয়। যে-কোনও জায়গায় যাদবপুরের কোনও প্রাক্তনীকে পেলে পরমাত্মীয় বোধহয়। কিন্তু, বিগত তিন দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে বার বার এই অসহিষ্ণুতা দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়েছে। বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব থেকে চিন্তা মননের মুক্তির জন্যই তো ঋষি অরবিন্দের মতো মনীষীরা ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ তৈরি করেছিলেন, যেখানে সব মতের সব ভাবনার জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হবে। সেই তীর্থক্ষেত্রের আজ এ কী অবস্থা! নিজের মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এ কোন বর্বর পন্থা?
একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন অতি বামপন্থীরা কোনোভাবে ছাত্র সংসদে টিকে আছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়টা তাদের নয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর যারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সংঘবদ্ধভাবে বাবুল সুপ্রিয়কে শারীরিক নির্যাতন করেছেন, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন—যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কেবল তাঁদের সম্পত্তি নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় সম্পত্তি। যেসব ছেলেমেয়ে অনেক কষ্ট করে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল পড়াশোনা করতে এসেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরটা তাঁদেরও। পশ্চিমবঙ্গের যে কৃষক, যে দিন মজুর, যে শ্রমিক কর দেন, যাঁদের ছেলেমেয়েরা কখনও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে না, এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদেরও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, সম্মাননীয় কর্মচারী, গবেষক আর পাঠাগারে আসা সকলের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সকল প্রাক্তন অধ্যাপিকা-অধ্যাপকের, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী—সকলের। যে আলিদা প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চা দিতেন, যে বিজনদা ব্লু আর্থ ওয়ার্কশপে কারিগর ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর তাঁদেরও অধিকার আছে। আমাদের সকলের কাছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মায়ের মতো। মায়ের গায়ে কেউ যদি কালি লাগাতে চায় তবে সকলের বুকেই বেদনা হয়। আজ বোধহয় সময় এসেছে, সমবেতভাবে এই অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ করার। অধ্যাপক গোপালচন্দ্র সেনের ঋণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো কখনও শোধ করতে পারবে না কিন্তু তাঁর পতাকা বহন করার শক্তি আমাদের অর্জন করতেই হবে।