শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
হ্যাঁ, এমন ঘটনাও ঘটে। যেমন, সম্প্রতি খবরের শিরোনামে এসেছেন শ্রাবণ কুমার। পাটনার ছেলে। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটি বম্বে থেকে বি টেক এবং এম টেক পাশ করেছেন শ্রাবণ। এখন তিনি চাকরি করতে ঢুকেছেন ধানবাদ রেলওয়ে ডিভিশনে। চন্দ্রপুরাতে। গ্রুপ ‘ডি’ কর্মী হিসেবে। সেখানে তাঁর কাজ ট্র্যাকম্যান হিসেবে। চন্দ্রপুরা এবং তেলো বিভাগের মধ্যে ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের দেখাশোনা করার কাজ।
আইআইটি বম্বের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার কেন রেলের গ্রুপ ডি কর্মী হিসেবে বছরে মাত্র তিন লাখ টাকার চাকরিতে যোগ দিলেন, সে এক বিস্ময়কর জিজ্ঞাসা অবশ্যই। যেখানে ২০১৮-তেই আইআইটি বম্বের ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রযুক্তির ছাত্রদের প্লেসমেন্টে গড় মাইনে বছরে সাড়ে আঠেরো লক্ষ টাকা। তাই অবাক সকলেই। অবাক ধানবাদ রেল বিভাগের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তাও। তাঁরা কখনও ভাবেননি যে, আইআইটির ডিগ্রিধারী কোনও ইঞ্জিনিয়ার বেছে নিতে পারেন কোনও গ্রুপ ডি’র পদ, যার জন্য আবশ্যিক যোগ্যতা মান দশম বোর্ডের পরীক্ষা পাশ করা। শ্রাবণ কুমার নিজে অবশ্য তাঁর এই চাকরিতে ঢোকার কারণ হিসেবে বলেছেন, সরকারি চাকরির সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কথা। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত তাঁর আইআইটির বন্ধুরাও তাঁকে টলাতে পারেনি। শ্রাবণ কুমার নিজে অবশ্য শিগগিরই সরকারি চাকরিতেই ‘অফিসার পর্যায়ে’ উন্নতির ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
সে যাই হোক না কেন, সরকারি চাকরির প্রতি এই মোহ কিন্তু আমাদের সমাজ-জীবনে একেবারে গা-সওয়া ঘটনা। যে কোনও কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনেই এর প্রমাণ মিলবে। যেখানে সদর্পে ঘোষণা করা হয় যে, পাত্র সঃ চাঃ, কিংবা কেবলমাত্র সরকারি চাকুরে পাত্রের তরফেই যেন যোগাযোগ করা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবশ্য সাধারণত একটা মস্ত বড় ভুল করা হয় এসব ক্ষেত্রে। ‘সরকারি’ চাকরি বলতে এখানে ‘সরকারি’ আর ‘পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিং’ বা সরকারি ক্ষেত্রের উদ্যোগের চাকরিগুলোকেও ধরা হয়। এই দু’ধরনের চাকরির চরিত্র আর নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা কিন্তু এক রকমের নয় একেবারেই।
সে যাই হোক না কেন, সেই কবে আমাদের ছাত্রজীবনেও দেখেছি তথাকথিত সরকারি চাকরির প্রতি প্রবল মোহ, গোটা সমাজ-ব্যবস্থাটারই। সেটা বিশ শতকের আটের এবং নয়ের দশকের কথা। বেশিরভাগ ছাত্রই তখন পড়াশুনার শেষে, বা তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, রেল, এলআইসি, ইত্যাদি নানা চাকরির পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। যাঁরা আরও ভালো, তাঁদের অনেকের আবার পছন্দ আইএএস কিংবা ডব্লুবিসিএস-এর মতো প্রশাসনিক চাকরি, যার গ্ল্যামার, ক্ষমতা এবং মাইনে বেশ উপরের দিকে। সে যুগে বেসরকারি চাকরির সুযোগও ছিল কম, আর ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ম্যানেজমেন্টের মতো কিছু ক্ষেত্র ছাড়া অন্য ছাত্ররা গোড়াতেই সেসব চাকরির কথা বড় একটা ভাবতেন না। এমনকী বহু সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রও চেষ্টা করতেন সরকারি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। অবশ্য এটা ঠিক যে, সরকারি চাকরির মাইনে, মাইনের বাৎসরিক বৃদ্ধি, পদোন্নতি, দশ বছর পরপর পে কমিশন, সবই বাঁধাধরা ছক ধরে এগোয়। কর্মীর যোগ্যতা অনেকটা বেশি হলেও তাঁর বাঁধনছাড়া বেশি মাইনে পাবার কোনও সুযোগ নেই। তবে এমনিতে সরকারি চাকরির মাইনে আকাশ-ছোঁয়া সাঙ্ঘাতিক কিছু না-হলেও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার নিরিখে বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু আসল কথা ছিল তার নিরাপত্তা, নিশ্চিন্ততা, চিকিৎসা এবং অবসরকালীন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আর সেই সঙ্গে অগণিত মানুষ মনে করত, সরকারি চাকরি যেন পাওয়াটাই কঠিন, পেয়ে গেলে কাজ বিশেষ না করলেও চলে।
তারপর নয়ের দশকের গোড়ায় এক মনমোহিনী জাদুতে ভেসে গেল ভারতবর্ষ। মুক্ত অর্থনীতি কিন্তু সঙ্গে করে আনে মুক্ত চিন্তার স্রোতও। গোটা বিশ্বের জীবনস্রোত আর তার প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে একাত্ম হয় ভারতবাসী। সেই সঙ্গে এক টেকনোলজিক্যাল বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে তার ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হয় গোটা দুনিয়া, স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে। তারপর সময়ের স্রোতে ক্রমে স্মার্ট মুঠোফোনের মাধ্যমে পৃথিবীটা হয়ে যায় আরও ছোট, আর দুনিয়ার সমস্ত খবর আর জীবনশৈলীর চালচিত্র ঢুকে গেছে তার পকেটে। ভারতবাসী অবাক হয়ে দেখে, পশ্চিমি দেশগুলিতে চাকরির নিরাপত্তা কিন্তু বেশ কম। অধিকাংশ চাকরিই সেখানে অস্থায়ী। কিন্তু সে সমস্ত দেশ চলছে বেশ। তাদের সাধারণ জনগণের হাতে অর্থের অভাব নেই, খাবারের অভাব নেই। আর, মজার কথা হল, বড় একটা নেই চাকরি হারাবার ভয়ও। (সাম্প্রতিক অতীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দাপটে অবশ্য চাকরি হারানোর ভয় ঢুকেছে পশ্চিমের। সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।) আসলে চাকরি সেখানে প্রচুর। নানা ধরনের। হোক না বেসরকারি। তাই নিয়োগকর্তা যেমন কর্মীকে ছাঁটাই করে দিতে পারে সহজে, কর্মীর মাথাতেও আকাশ ভেঙে পড়ে না চাকরি চলে গেলে। এমনকী চাকরির সুযোগের এই আধিক্য কর্মীকেও সুযোগ দিয়েছে সহজে চাকরি বদল করার। তাই কর্মী এবং নিয়োগকর্তা উভয়ের হাতে পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে পারিশ্রমিক এবং চাকরির শর্তাবলি নিয়ে দরাদরির। অর্থনীতির নবজাগরণের সুতো ধরে ভারতের বাজারেও অচিরে এসে গেল বিভিন্ন ধরনের চাকরি। তার সবই যে খুব বেশি মাইনের চাকরি, তা অবশ্য নয়। তবু, অবাক হয়ে দেখি, আজকের ছাত্রসমাজ তাদের ছাত্রজীবনের শেষলগ্নে এসে সরকারি চাকরির মোহের আবর্তে আর ঘুরপাক খায় না তিন দশক আগেকার তাদের অনন্যোপায় আগের প্রজন্মের মতো। তারা এখন বিনা দ্বিধায় বেসরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। আবার খুব সহজেই এক চাকরি ছেড়ে বেছে নেয় অন্য চাকরি। কখনও আবার চাকরি থেকে ‘ব্রেক’ নেয় এক-দু’বছরের জন্য। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কোর্স করতে, কিংবা ব্যাকপ্যাক নিয়ে দুনিয়ার একটা অংশ ঘুরে দেখতে। যে মানসিকতা পশ্চিমি দেশের ছেলেমেয়েদেরই ছিল বলে আমরা জানতাম আমাদের ছাত্রজীবনে। এই পরিবর্তনটা কিন্তু ঘটে গিয়েছে আমাদের সমাজেও। ইতিমধ্যেই। তবু, তার মধ্যেও, সরকারি চাকরির প্রতি এক মহিমান্বিত আকর্ষণ, এক মোহের অন্তঃস্রোত, অবশ্যই বয়ে চলেছে কোথাও। এখনও। শ্রাবণ কুমাররা চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেন।
শ্রাবণ কুমার আইআইটি-তে পড়তে ঢোকেন ২০১০ সালে, আর পাশ করে বেরন ২০১৫-তে। তারপর এতদিন তিনি কী করেছেন, সে খবর অবশ্য পাওয়া যায়নি মিডিয়া থেকে। আবার আইআইটির আর পাঁচজন ছাত্রের মতো কোনও বেসরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মোটা মাইনের চাকরিতে যোগ দিলে, দু-এক বছরের মধ্যেই তিনি হয়তো আয় করে ফেলতে পারতেন তাঁর রেলের দশ-বিশ বছরের মাইনে। তাই তথাকথিত যে ‘সুরক্ষা’ এবং ‘নিরাপত্তা’র কথা তিনি বলেছেন, সেটা এক্ষেত্রে কষ্টকল্পনা বলেই মনে হয়।
তবে, সমাজ বদলাবে আরও। আমি বা আপনি চাইলেও, কিংবা গভীরভাবে বিরোধিতা করলেও। সরকারি বা আধা-সরকারি চাকরির নিরাপত্তার চক্রব্যূহ ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়বে আরও অনেকটা। এবং দ্রুতগতিতে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ এক প্রকারের ভবিতব্যই। একসময় আমরা দেখব, চাকরি বাঁচাতে গড়পড়তা সরকারি চাকুরেদেরও খাটতে হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের মতো। সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের নিরাপত্তার ‘মিথ’ ভেঙে চুরচুর হয়ে পড়বে। এবং সে-পথ ধরেই ক্রমে বিদায় নেবে পাত্রপাত্রী চাই-য়ের বিজ্ঞাপন থেকে ‘সঃ চাঃ’ নামক অ্যাক্রোনিম।
এই সামাজিক পরিবর্তনগুলি ভালো না মন্দ, সে প্রসঙ্গ অবশ্য ভিন্ন।