মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
মুষলধারে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামার কোনও লক্ষণই যেন নেই। কিন্তু গরমটা কিছুতেই যেন কমছে না। মানে বৃষ্টিটা আরও হবে। গোটা বাড়িটাই প্রায় জলে ভরে গেছে। ঘরের ভিতরেও জল ঢুকবে ঢুকবে করছে। আসলে রাস্তার যে নর্দমা দিয়ে জল সরে যাওয়ার কথা, তাও কানায় কানায় পূর্ণ।
লোকেশ বিছানায় যাব যাব করছে। কিন্তু যেতে পারছে না। একটা দুশ্চিন্তা— যদি ঘরের ভিতরে জল ঢুকে যায়!
হঠাৎ সামনের বারান্দায় কোলাপসিবল গেট ধরে নাড়াবার আওয়াজ। প্রথমে আস্তে আস্তে। তারপরে বেশ জোরে।
বাধ্য হয়েই লোকেশ চেয়ার থেকে উঠে বাইরের আলোটা জ্বালায়। কিন্তু দরজা খুলতেই— মা, তুমি এত রাতে এই বৃষ্টির মধ্যে! শিগগির ঘরে আসো। লোকেশ তাড়াতাড়ি তালাটা খুলে দেয়— কীরকম ভিজে গেছ বলো তো।
—থাকতে পারলাম না রে খোকা। যে হারে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাঘাট সব জলের তলায়। আর এদিকটার কথা তো আমার জানা। পূর্তদপ্তরের লোকেরা, ইঞ্জিনিয়াররা যে কী পরিকল্পনা করে, কী কাজ করে তাও আমার অজানা নয়। খালি রাস্তা উঁচু করা। যাতে রাস্তায় জল না জমে। কিন্তু নর্দমাগুলির ঢাল ঠিক রেখে যে গভীর করা প্রয়োজন, তা করে না। ফলে মুষলধারায় বৃষ্টি হলেই নর্দমা দিয়ে অত জল ঠিক মতো সরতে পারে না। আর বাড়িগুলি নিচু হয়ে যাওয়ার ফলে, সেগুলি জলে তলিয়ে যায়। তারপর কাজও ঠিকমতো হয় না।
—তাই বলে, এইরকম বৃষ্টির মধ্যে কি কেউ ঘর থেকে বের হয়। পথে যদি তোমার কোনও বিপদ হতো। লোকেশ ইতিমধ্যে আলমারি খুলে তাকগুলি খুঁজে খুঁজে মায়ের পরার জন্য শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বের করে পরতে দিয়েছে।
— ওই যে বললাম, তোর মুখটা হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দিদিভাই আর বউমাও যেন আমার কথাই বলছে। এই, ওদের গলার আওয়াজ পাচ্ছি না কেন রে? ওরা কি সব ঘুমিয়ে পড়েছে? হুঁ ঘুমিয়ে পড়াটাই তো স্বাভাবিক। রাত তো আর কম হল না। তার ওপর যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে। শেষ কথা কয়েকটি মনে মনে বলে ওঠে লাবণ্যদেবী।
—ওরা কেউ নেই মা।
—এটা তুই কী বলছিস, নেই মানে!
—ওরা এখানে থাকে না।
—দিদিভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। বউমা নিশ্চয়ই ওকে দেখতে ওর শ্বশুরবাড়ি ক’দিনের জন্য গেছে। বউমা তো আবার ফিরেও আসবে।
—ওরা কেউ আর এ বাড়িতে ফিরে আসবে না।
—তুই নিশ্চয়ই তাহলে ওদের সঙ্গে খুব অশান্তি করেছিস। দিদিভাইয়ের বর বা শ্বশুরবাড়ির লোক হয়তো তোর পছন্দের হয়নি। তুই দিদিভাইয়ের এই বিয়েটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারিসনি। কেন না, দিদিভাই তোর একমাত্র সন্তান। তোর অন্যরকম আশা ছিল। শুধুমাত্র বউমাই বোধহয় এই বিয়েটা চেয়েছিল। আর তুই অশান্তির ভয়ে তা মানতে বাধ্যও হয়েছিলি। কিন্তু পরে বউমাকে সব সময় কথা শুনিয়েছিস। এটা তো ঠিক নয়। তাই বউমা তোকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। আমি তো তোকে চিনি লোকেশ।
—না মা, তুমি যেমনটা বলছ, তা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। তবে হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম, পর্ণার জীবনটা যেন আমার মতো যন্ত্রণার না হয়। ছোটবেলায় ওর ভিতর যে জিনিসগুলি আমি লক্ষ করেছিলাম, বা ওর মাস্টারমশাইরা ওর সম্পর্কে তাঁদের যে ধারণার কথা আমাকে বলেছিলেন, তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ও জীবনে একটা জায়গায় নিশ্চয়ই পৌঁছাতে পারবে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো ওর জীবনটা সাদামাটা হবে না।
—কেন ওকি জীবনে কিছুই করতে পারেনি। শুধু বিয়েটাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আর সেই বিয়েটাও পরে ওর জীবনে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
—না, তা ঠিক নয়। ও বর্তমানে একটা কোম্পানির আইটি সেক্টরে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে আছে। মাস গেলে একটা ভালো অঙ্কের টাকাও পায়। ওর বরও তাই।
—তাহলে?
—শোনো, আইটি সেক্টরের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ বলতে সেরকম একটা কিছু নেই। কোম্পানি ইচ্ছে করলে যখন-তখন ছাড়িয়ে দিতে পারে। তারপর অন্য নতুন কোনও কোম্পানিতে চাকরি পেলে তো ভালো। নাহলে কিছুই করার নেই। যতদিন কাজ করতে পারবে, মানে কোম্পানি খুশি হয়ে তোমাকে রাখবে, সেই সময়ে যেটুকু সঞ্চয় করতে পারবে, তাই তোমার কাছে থাকবে। কিন্তু তা আর কতটুকু। আর ওদের জীবনযাত্রার যে ধরন। বছরে একবার করে বেড়ানো চাই। এরপর যেখানে থাকে, সেখানকার বাজারদর। ছেলের পড়াশোনা। কাজেই বুঝতে পারছ।
—সত্যিই লোকেশ, তুই আজও আগের মতো রয়ে গেলি। সেই পুরনো ভাবধারায় বিশ্বাসী। আর থাকবি নাই বা কেন। তুই তো আমারই ছেলে। আমারও সবসময় এক অনিশ্চয়তার ভয়। অনেক কিছু কল্পনা। কিন্তু বাস্তবটা যে অন্যরকম, সেটা বুঝতে পারি না। মেনে নিতে চাই না। শোন, দিদিভাইয়ের ভবিষ্যৎটা সুখেরই হবে। ওকে তো আমি জানি। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বাস্তববাদী। তবে আমার আর তোর মতো কিছুটা হলেও, একটা আবেগ আছে। এটাই ভয়ের কারণ। তবে দুশ্চিন্তা করিস না। ওর ওপর তোর বাবার ও আমার আশীর্বাদ সবসময় আছে। ভাগ্য করেই তুই দিদিভাইয়ের মতো একটা মেয়ে পেয়েছিস। আর বউমাও ভালো রে। আসলে বউমার রাগটা আর জেদটা বড্ড বেশি। যেটা দিদিভাইও মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। বউমার এই রাগ ও জেদের পিছনে অবশ্য কারণও আছে। আসলে ও বাবার বাড়ি থেকে সেরকম কিছুই একটা পায়নি। যা প্রতিটি মেয়েই পেতে আশা করে। সেটাই ও আমাদের কাছ থেকে পেতে চেয়েছিল। আমরাও হয়তো তা ওকে ঠিকমতো দিতে পারিনি। তাই অশান্তি হতো। আমিও ওকে ভুল বুঝে চলে গেলাম।
দুই
সেদিনও একত্রিশে ভাদ্র ছিল। বিশ্বকর্মা পুজো। লোকেশ ওদের একটা বড় ঠিকাদারি সংস্থার পুজোর অনুষ্ঠান থেকে আর সব সহকর্মীর মতো বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছিল। সকলে মিলে আনন্দ করে করে খাবে বলে। বৃষ্টি তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বাড়ি ফিরে কোলাপসিবল গেট ধরে নাড়াতেও কেউ দরজা খুলে সামনের বারান্দায় আসে না। তখনও চেঁচিয়ে ডাকা শুরু করে। পর্ণা এসে তালাটা খুলে দেয়।
—কী করছিলি? মা-মেয়েতে মিলে ঘুমোচ্ছিলি নিশ্চয়ই? মেয়ে কোনও কথা বলে না।
—এই মিষ্টির প্যাকেটটা ধর। তোর পছন্দের মিষ্টি ক্ষীরকদম্ব আছে। লোকেশ ছাতা বন্ধ করতে করতে মিষ্টির প্যাকেটা মেয়ের হতে ধরিয়ে দিতে যায়।
—তোমার আদরের মাকে গিয়ে দাও। বলতে বলতে পর্ণা ঘরের ভিতর ঢুকে যায়।
লোকেশ ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারে। পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট। ও অবশ্য এই ব্যাপারে অভ্যস্ত। প্যাকেটটা নিয়ে তাই সোজা মায়ের কাছে চলে যায়— কী হয়েছে মা?
—কী আবার হবে। শোন, তুমি এখন তোমার আদরের মেয়ে পেয়েছ। বউ পেয়েছ। কাজেই আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করবে না। তোমার কাছে এখন আমার কোনও মূল্যই নেই। নিছক তোমার বাবার দৌলতে আমার মাসিক পেনশনের টাকাটা আছে। আর এই বাড়িটা তোমার বাবা করে গেছেন। তাই এই বাড়িতে এখনও চারটি খেয়ে-পরে থাকতে পারছি। না হলে, এতদিনে তোমরা সকলে মিলে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে।
—এসব তুমি কী বলছ মা! তোমায় ছাড়া আজও আমি ভালোভাবে বাঁচতে পারব না। লোকেশ বলে ওঠে।
—বাজে কথা। তবে হ্যাঁ, একটা সময় মুহূর্তের জন্য হলেও, তুমি আমার মুখটা না দেখে কিছুতেই থাকতে পারতে না। যাই হোক, আমি আর কিছুতেই তোমাদের কাছে থাকব না। তুমি তোমার বউ-মেয়েকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকো। আমার পাস-বইটা দিয়ে দাও। এই জন্যই এতক্ষণ তোমার অপেক্ষা করেছি। বউমার কাছে চেয়েছিলাম। ও তোমার কথা বলেছে।
তিন
মায়ের বাঁধানো ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সমানে পূর্বস্মৃতি রোমন্থন করে চলেছে লোকেশ। ওর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা পড়ছে।
ক্ষোভে দুঃখেই মা সেদিন ওর কাছ থেকে চলে গেছিল। তাই আজ মাকে সামনাসামনি পেয়ে ও বলে ফেলল— মা আজ যেটা তুমি বুঝতে পারছ, সেদিন সেটা কেন পারলে না গো। তাহলে তো এত কষ্ট এত যন্ত্রণা এতদিন ধরে আমাকে পেতে হতো না। তুমি আমাকে ছেড়ে না গিয়ে তোমার বউমা দিদিভাইয়ের সঙ্গে আনন্দেই থাকতে পারতে। তুমি তো আমাকে ভালো করেই জানো মা। আর পাঁচটা ছেলের মতো আমি নই। আমি মোটেও যুগোপযোগী নই। তোমার আর বাবার ধাতটাই তো পেয়েছি।
—ভুল করেছিলাম রে। বড্ড ভুল করেছিলাম। আসলে আমি বুঝতে চাইনি, দুটো মানুষ মানসিক দিক থেকে কখনওই হুবহু এক হতে পারে না। তারা যতই পরস্পর আপনজন হোক না কেন। তারপর বউমা অন্য একটা বাড়ি থেকে এসেছে। যথেষ্ট বয়সেই এসেছে। বাচ্চা বয়সে আসলে না হয় একটা কথা ছিল। আমি ওর ভিতর আমাকেই যেন দেখতে চেয়েছিলাম। যেটা অবাস্তব। তাই ওইদিন বউমা, বিশেষ করে দিদিভাই তোর সম্পর্কে আজে-বাজে কথা যখন আমাকে শুনিয়ে বলতে লাগল, আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। আমরা নাকি বিনা পয়সায় শুধুমাত্র বাড়ির কাজের জন্য রান্নার জন্য তোর বিয়ে দিয়েছি। বউমার জীবনটা নষ্ট করেছি। দিদিভাইয়ের জীবনটাও আমাদের জন্য নষ্ট হয়েছে।
—যাক, এসব কথা এখন থাক মা। আজ যখন অনেকদিন বাদে তুমি স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছ, আর তোমাকে কিছুতেই ছাড়ব না। আমি এখনই, না এখন তো অনেক রাত হয়ে গেছে। ওরা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল, কাল সকালেই তোমার ফিরে আসার কথাটা তোমার দিদিভাই, বউমাকে ফোনে জানিয়ে দেব। দেখবে, ওরা ক’দিনের জন্য হলেও চলে আসবে। তখন ভীষণ মজা হবে। বলা যায় না, তোমাকেও ওরা এবার ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে। নাতনির পুতিকে প্রথম দেখতে পাবে। ওর মুখটা একেবারে তোমার দিদিভাইয়ের মতো। বাচ্চটা যে কী দুষ্টু হয়েছে, কী বলব!
একটা এসি ট্যাক্সি এসে চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়াল। দরজা খুলে একে একে বেরিয়ে আসে প্রতিমা, পর্ণা, অয়ন ও ওদের ছ’বছরের বাচ্চা পুগুন। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে সকলে দেখতে পায়, কাজের দিদি সামনের বারান্দায় একটা চেয়ারের ওপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ দুটি যেন ভেজা।
—বাবা! পর্ণা চেঁচিয়ে ডেকে উঠেই ঘরের ভিতর ঢোকে।
—দাদান, তুমি কী করছ! পুগুনও চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতেই ঘরে ঢুকে যায়।
সকলে ঘরের ভিতর ঢুকে দেখতে পায়— টেবিলের ওপর একটা ডায়েরি খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সামনেই একটা চেয়ার। ডায়েরির পাতার ওপর বাঁদিকে তারিখটা লেখা আছে— একত্রিশে ভাদ্র, চোদ্দোশো ছাব্বিশ।
—মাম মাম, দাদান কি স্টার হয়ে গেছে? পুগুন পর্ণাকে জিজ্ঞেস করে ওঠে।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী