সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
কলকাতায় ঝড় মানেই সে এক ভয়াবহ অবস্থা। সাহেবরা কলকাতার ম্যালেরিয়া, আমাশয়ের সঙ্গে যে অন্য বিষয়টা বেজায় ভয় পেতেন, তা হল এই ঝড়ের প্রকোপ।
আর আগেও দু’-তিনটে ঝড় কলকাতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এক তো সেই ১৭৩৭ সালের ভয়ানক ঝড়। কলকাতা তখন সবে গড়ে উঠছে। ব্ল্যাক টাউনে গুটিকয় কাঁচা বাড়ি। পাকা বলতে হোয়াইট টাউন। সন্ধে থেকে শুরু হল ঝড়। ইস্ট ইন্ডিয়া কুঠির ফ্রান্সিস রাসেল তাঁর নোটবইতে লিখছেন, ‘মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় জল বেড়েছিল ১৫ ইঞ্চি। মিসেস ওয়াস্টেল আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আচমকা সশব্দে ভেঙে পড়ল সেই ঘরের দরজা জানলা। পরের দিন প্রায় বিশ হাজার নৌকা, জাহাজ, ডিঙ্গি, বজরা ডোবার খবর পাওয়া গেল। জলে ভাসছিল অগুনতি পশু। তাঁদের মধ্যে গরু, মহিষের সঙ্গে বাঘ আর গণ্ডারও ছিল।’ ঝড় শেষ হতে সাহেব ভাঙা জাহাজে মাল উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেন, বিরাট এক কুমির বসে আছে।
এই ঝড়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বদলে গেছিল কলকাতার ভূগোল। এর আগে ভাগীরথী থেকে বিদ্যাধরী অবধি এক খাল ছিল, যা দিয়ে পণ্য পরিবহণ হতো। এই ঝড়ে তার এমন দুর্দশা হয় যে, কোম্পানি খালই বুজিয়ে ফেলে। ফলে বিদ্যাধরী হেজে মজে যায়। অশোকনগরে এলে এখনও সেই মরা নদী ও খাল দেখতে পাবেন। আর কলকাতার মধ্যে ওই খাল বুজিয়ে হল রাস্তা। নাম ক্রিক রো।
সেই ধাক্কা যেতে না যেতেই পরের ধাক্কা। ১৭৭৩ সালে একসঙ্গে ভূমিকম্প আর ঝড়। সে এমন ঝড় সন্ধ্যা থেকে সারা রাত চলল। গোবিন্দরাম মিত্তিরের নবরত্ন মন্দিরের চূড়ো পড়ল ভেঙে। সাতখানা ডিঙ্গি নৌকা উলটে গেল কলকাতার কাছেই। সে জায়গার নাম এখন উলটো ডিঙ্গা বা উলটোডাঙ্গা।
উইলিয়াম হিকি যখন আইনজীবী হিসেবে ভারতে আসেন, তখন ১৭৭৮ সালের শুরুর দিক। গিয়েছিলেন এক বন্ধুর বাড়ি খানাপিনা করতে। সেই সময় উঠল ঝড়। উত্তর-পুব দিক থেকে। আর ওই দিকেই যে হিকির বাড়ি! ঝড়ের মধ্যেই দৌড়ালেন বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখলেন সাধের বাড়ি ধুলোয় গড়াগড়ি। পরে আছে শুধু বাড়ির কঙ্কালটা!
গল্প শেষ করি আর এক ইতিহাস বদলে দেওয়া ঝড়ের কাহিনি দিয়ে। বাংলায় সাহেবদের কুঠি কোথায় হবে, তা নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের ধারেই এক জায়গা খুঁজে বের করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। ঠিক করলেন, এখানেই বন্দর গেঁড়ে বসতি স্থাপন করা হবে। গালভরা নামও দিলেন— পোর্ট ক্যানিং। সবাই খুশি, শুধু এক মাতাল সাহেব হেনরি পিডিংটন ছাড়া। তিনি বললেন, ‘সর্বনাশ! এমন কাজ করবেন না। যত ঝড় হয়, সব ওখানেই এসে পড়ে।’ কোম্পানি মাতালের কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না। পোর্ট ক্যানিং হল। আর তারপরেই এল ভয়ানক কালবৈশাখী ঝড়। পোর্ট ক্যানিং তৈরি হতে যা সময় লেগেছিল, রাতারাতি সব শেষ। সাহেবরা ঠিক করলেন, হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে। বন্দর বানানো হল সমুদ্র থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে কলকাতা নামের এক গ্রামের ধারে। তারপরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা।