গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘকে বাঁয়ে রেখে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে সামান্য হাঁটাপথ... গম্ভীরা।
ওড়িয়া ভাষায় মন্দিরের মাঝখানে অবস্থিত নির্জন ছোট ঘরকে বলে ‘গম্ভীরা’। কেউ কেউ বলেন, ‘ঘরের মধ্যে ঘর’। ওড়িশার প্রাচীন বাড়িগুলির চাতালের পর যে দালান থাকে, সেই দালানের ভিতরের ছোট ঘরগুলিই এই নামে পরিচিত।
শুধু পুরী নয়, সারা ওড়িশায় এমন হাজারো গম্ভীরা দেখতে পাবেন আপনি। কিন্তু ‘পুরীর গম্ভীরা’ বলতে একটিই পুণ্যস্থল। জগন্নাথ মন্দিরের কাছে বালি শাহীর একটি বিশেষ বাড়ি। বাড়িটি ছিল ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্র দেবের কুলগুরু কাশীশ্বর মিশ্রের। আর সেখানেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু কাটিয়েছিলেন জীবনের শেষ আঠারোটা বছর। অন্তর্ধানের আগে শেষবারের মতো বের হয়েছিলেন এই গম্ভীরা থেকেই।
গম্ভীরার এই বাড়িটি আজও শ্রীচৈতন্যর আবাসভূমি হিসেবে ভক্তদের কাছে বিশেষ পরিচিত। যদিও সেখানকার দায়িত্বে থাকা অবাঙালি ম্যানেজার অনেকটাই ‘মালিক-সুলভ’। ফটো তোলা নিষিদ্ধ!
শ্রীচৈতন্যের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর দেখা মেলে এই গম্ভীরায়। রয়েছে মহাপ্রভুর ব্যবহৃত পাদুকা, কাঁথা আর কমণ্ডলু। কাঁথাটিকে ঘিরে দু’টি কাহিনি বহুল প্রচলিত। একটি হল, ছেলের জন্য স্বহস্তে বানানো কাঁথাটি সুদূর নবদ্বীপ থেকে পাঠিয়ে ছিলেন মহাপ্রভুর মা শচীদেবী স্বয়ং। দ্বিতীয় কাহিনিটি অবশ্য অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। কলার খোল চিরে চৈতন্যদেবকে এই কাঁথা বুনে দিয়েছিলেন ভক্ত জগদানন্দ পণ্ডিত। মহাপ্রভু তখন গম্ভীরায় পাথরের শক্ত মেঝেতে শুতেন। ‘হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ’ বলে গড়াগড়ি দিতেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে। সেই কষ্ট চোখে দেখা যায় না। সইতে পারেননি জগদানন্দও। তাই তড়িঘড়ি এই কাঁথা বুনে উপহার দিয়েছিলেন। ভক্তের ভালোবাসা সাদরে গ্রহণও করেছিলেন মহাপ্রভু। বালি শাহীর এই বিশেষ বাড়িতেই রয়েছে একটি অখণ্ড প্রদীপ। ভক্তদের বিশ্বাস, তার শিখা শ্রীচৈতন্যের আমল থেকে আজ পর্যন্ত কখনও নেভেনি।
ওড়িশাবাসীর কাছে ‘রাধাকান্ত মঠ’ নামেও পরিচিত এই গম্ভীরা। এখানে আজও পূজিত হন ‘রাধাকান্ত দেব’। এই রাধাকান্ত দেবকে গম্ভীরায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওড়িশার গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রের পিতা পুরুষোত্তম দেব। দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চী রাজ্য জয় করে রাধাকান্ত দেবকে নিয়ে এসেছিলেন রাজা পুরুষোত্তমদেব।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অবশ্য প্রথম থেকেই যে গম্ভীরায় থাকতেন, এমনটা নয়। এর আগে তিনি ছিলেন কুঞ্জ মঠে। আর প্রথমবার নীলাচলে খুব বেশিদিন থাকেনওনি মহাপ্রভু। দিন কয়েক কাটিয়েই রওনা হয়ে যান দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে। মহাপ্রভুর জগন্নাথ দর্শন এবং পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের সঙ্গে আলাপ-পর্ব ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রথমবার জগন্নাথ দর্শনের সময় মূর্ছিত হয়ে পড়েন শ্রীচৈতন্য। তড়িঘড়ি তাঁকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান বাসুদেব সার্বভৌম। দিগ্বিজয়ী নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌমের নাম তখন দেশজোড়া। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ থেকে জানা যায়, চৈতন্যের জন্মের পূর্বে যখন হুসেন শাহ বাংলার মসনদে বসেননি, সেই সময় বাসুদেব সার্বভৌমের পিতা বৃদ্ধ মহাপণ্ডিত নরহরি বিশারদ নবদ্বীপের আবাস ছেড়ে কাশী চলে যান। পুত্র বাসুদেব সার্বভৌম হাজির হন পুরীতে। উৎকলাধিপতি প্রতাপরুদ্রের পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করেন। তিনি ছিলেন প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত এবং পরামর্শদাতা।
শিশিরকুমার ঘোষ ‘অমিয় নিমাই চরিত’ গ্রন্থে বাসুদেব সার্বভৌম সম্পর্কে বলছেন—বাসুদেব সার্বভৌম সমস্ত ন্যায়শাস্ত্র কণ্ঠস্থ করে এনেছিলেন মিথিলা থেকে। কারণ মিথিলার পণ্ডিতরা গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের মেধায় আশঙ্কিত হয়ে কোনও পুঁথি মিথিলা থেকে নিয়ে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। বাসুদেব সার্বভৌম দেশে ফিরে টোল খুলেছিলেন। আর সেই টোলের ছাত্র ছিলেন নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি, স্মার্ত রঘুনন্দন এবং নিমাই পণ্ডিত ওরফে চৈতন্য মহাপ্রভু। কোলব্রুক সাহেব এই তিনজনের সঙ্গে ছাত্র হিসেবে তান্ত্রিক-শিরোমণি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের নামও উল্লেখ করছেন। এই দিগ্বিজয়ী নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌম একটা সময়ের পর মহাপ্রভুর ‘ভক্তি’ মার্গের ভাবধারাকে নতমস্তকে গ্রহণ করেন।
এবার আসা যাক ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে মহাপ্রভুর আলাপ প্রসঙ্গে। দু’জনের আলাপ প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠির জানা ওরফে মালিবুড়ো ‘শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য’ গ্রন্থে লিখছেন—একদিন চৈতন্যদেব ভাবাবেশে জগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলেন মূল মণ্ডপের দিকে অর্থাৎ সিংহাসনের দিকে। সেসময় মন্দিরের বলিষ্ঠ দ্বাররক্ষক মহাপ্রভুকে বাধা দিতে গেলে মহাপ্রভুকে তাঁকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেন। আর তাতেই বলিষ্ঠ দ্বাররক্ষক দূরে ছিটকে পড়ে। এই খবর পৌঁছয় রাজার কানে। রাজা চিন্তায় পড়ে যান। তিনি ভাবেন, কোনও শত্রু সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছে জগন্নাথ মন্দিরে। পরে মহারাজকে আশ্বস্ত করেন সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম।
এদিকে, অল্পদিনেই উৎকলজুড়ে ‘সচল জগন্নাথ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চৈতন্য মহাপ্রভু। এমন একটা সময় আসে যখন ভক্তরা জগন্নাথদেবকে আগে দর্শন আগে না করে মহাপ্রভুকে আগে দর্শন করার জন্য আকুল হয়ে ভিড় জমাতে থাকেন। প্রতাপরুদ্র মহাপ্রভুর এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দাবিয়ে রাখতে চাইলেন জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতবর্গকে, পান্ডাদের। আর এই বিষয়টি ঘিরে জগন্নাথ মন্দির অভ্যন্তরে মহাপ্রভু এবং পান্ডাদের মধ্যে শুরু হয়েছিল এক ঠান্ডা যুদ্ধ।কেউ কেউ এই ঠান্ডা যুদ্ধকেই চৈতন্য অন্তর্ধানের কারণ হিসেবে মনে করেন! যদিও এবিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণ আজও মেলেনি।
মহাপ্রভু অবশ্য এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। এমনকী রাজার সঙ্গে প্রথমদিকে তিনি দেখাও করতে চাননি। অবশেষে একদিন সভাপণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম, রাজগুরু কাশী মিশ্র, পার্ষদ রামানন্দ প্রমুখের তত্ত্বাবধানে প্রতাপরুদ্র ও চৈতন্য মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম দর্শনেই রাজা প্রতাপরুদ্র মহাপ্রভুকে ‘গুরু’ হিসেবে বরণ করে নেন। মহারাজের পরিবারের পাশাপাশি মন্ত্রী রামানন্দ চৈতন্যদেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী হওয়ার জন্য মন্ত্রিত্ব থেকেও সরে আসেন।
রাজগুরু কাশী মিশ্র নিজের বাসভবনটি মহাপ্রভুকে বসবাসের জন্য ছেড়ে দেন। তাঁর পার্ষদ ও ঘনিষ্ঠদের থাকার ব্যবস্থাও করেন। এই বাড়িটিই ইতিহাসে ‘গম্ভীরা’ নামে পরিচিত। মহাপ্রভুর সঙ্গী হন কাশী মিশ্র স্বয়ং। এই কাশী মিশ্র ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সখ্যতা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন দিকপাল বৈষ্ণব পদকর্তা লিখছেন—দ্বাপর যুগে এই কাশী মিশ্র ছিলেন এক কুব্জা দাসী। যিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। বৃন্দাবনে একদিন তাঁর মনে অদ্ভুত এক ইচ্ছে জেগে উঠল। তিনি ভাবলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ তো সব জায়গায় বিরাজমান। আর প্রভু তো সমস্ত গোপীদের কাছেই থাকেন। আমার কাছেও যদি প্রভু একরাত থাকতেন, তাহলে কী ভালোই না হতো!’ দাসী তাঁর ভাবনার কথা শ্রীকৃষ্ণকে জানালেন। সেকথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ বললেন—‘তোমার বাসনা পূর্ণ হবে, কিন্তু এখন নয়—কলিযুগে।’ আর সেই হিসেবে কলিযুগে কুব্জা দাসী জন্মগ্রহণ করলেন কাশী মিশ্র হয়ে। আর শ্রীকৃষ্ণের অবতার চৈতন্য মহাপ্রভু আশ্রয় নিলেন কাশী মিশ্রের বাড়ি গম্ভীরায়। এক-দু’দিন বা কয়েক বছরের জন্য নয়, পুরো আঠারো বছরের জন্য!
কাশী মিশ্রের বাড়ির ভিতরে ঢুকে রাধাকান্তদেবকে বাঁয়ে রেখে ভিতরের দালানে ঢুকলেই দেখা মিলবে চৈতন্য মহাপ্রভুর সাধন কক্ষটির। গম্ভীরাজুড়ে ওড়িশা রীতির সামান্য গঠনশৈলীই চোখে পড়ে। তার কারণ অবশ্য আধুনিকীকরণ! শ্রীচৈতন্যের সাধন কক্ষটি ছাড়াও গম্ভীরায় মাটির তলায় আরও কয়েকটি গুপ্ত সাধনকক্ষ ও ধ্যানঘর রয়েছে। যা অবশ্য বর্তমানে তালাবন্ধ।
বৈষ্ণব ভাবুক পদকর্তাদের ভাবনায়, মহাপ্রভু ‘অন্তরঙ্গে রাধা এবং বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।’ এক দিব্য ভাবোন্মাদ অবস্থায় বিরহে কাতর মহাপ্রভু গম্ভীরার গুপ্ত সাধনকক্ষেই গড়াগড়ি দিতেন, এই কক্ষে কেউ কেউ একসময় মহাপ্রভুর হাতের ছাপ দর্শন করতে আসতেন বাংলা থেকে! এই গম্ভীরায় চৈতন্য পার্ষদের অনেকেই থাকতেন। কিন্তু গম্ভীরায় আশ্রয় হয়নি হরিদাস ঠাকুরের।
হিন্দু ঘরে জন্ম হলেও ঠাকুর হরিদাস বড় হয়েছিলেন মুসলমানের ঘরে। শুধুমাত্র সেই কারণে চৈতন্যদেবের শিষ্য হওয়া সত্ত্বেও পুরীতে তাঁর সঙ্গে একত্রে থাকার সুযোগ হয়নি। হরিদাস থাকতেন একটি অন্য কুটিরে। অন্যদিকে, হুসেন শাহের রাজকর্মচারী হওয়ার সুবাদে রূপ ও সনাতনেরও ঠাঁই হয়নি গম্ভীরায়। হরিদাসের কুটিরের কাছেই রয়েছে পাঁচশো বছরেরও প্রাচীন একটি বকুল গাছ। তা ‘সিদ্ধ বকুল’ নামে পরিচিত। বর্তমানে সেই বকুলগাছের মূল অংশটি ঘেরা হয়েছে। ভক্তেরা অবশ্য মনস্কামনা পূরণের আশায় ওই বকুলগাছের ডালে ঢিল-কাপড় বাঁধেন আজও।
মহাপ্রভু যখন গম্ভীরার গুপ্ত কক্ষ থেকে জনসমক্ষে বের হতেন, তখন শয়ে শয়ে ভক্ত অপেক্ষা করতেন নীলাচলের ‘সচল জগন্নাথে’র জন্য। মহাপ্রভুকে মাত্র একবার চোখের দেখার জন্য সারা ভারতবর্ষ থেকে মানুষের ঢল নামত। শোনা যায়, মীরাবাঈ পর্যন্ত এসেছিলেন মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য।
সারা বছরই ভক্তদের ঢল থাকলেও ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে যেত রথযাত্রার সময়। প্রতিবছর রথের সময় মহাপ্রভুকে এক অন্য মহিমায় দেখতে পেতেন ভক্তরা। রথের সামনে নৃত্যরত গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ত এই বিশেষ দিনে। কৃষ্ণনাম করতে করতে মহাপ্রভু এগিয়ে যেতেন গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে।
রথযাত্রার সময় বাংলা থেকে বহু মানুষ পুরীতে যেতেন। তাঁরা আবার সাতটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে মহাপ্রভুর সঙ্গে কীর্তনে মেতে উঠতেন। এই সাত সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতেন যথাক্রমে—স্বরূপ দামোদর, শ্রীবাস, মুকুন্দ দত্ত, গোবিন্দ ঘোষ, কুলীন গ্রামের রামানন্দ এবং সত্যরাজ, শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার (তিনি ছিলেন লোচনদাসের গুরু), শান্তিপুরের শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের পুত্র অচ্যুতানন্দ। এই সাত সম্প্রদায়ের মধ্যে চার সম্প্রদায়ের মানুষরা যেতেন রথের আগে, দুই সম্প্রদায়ভুক্তরা যেতেন রথের পাশে, অপর এক সম্প্রদায়ের মানুষরা থাকতেন রথের পিছনে।
১৫৩৩ সাল। গবেষকদের মতে, ‘চৈতন্য অন্তর্ধানের বছর।’ আজও যে অন্তর্ধানের সঠিক কিনারা হয়নি। কারও মতে, তিনি ভাব উন্মত্ত অবস্থায় সমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন, কারও মতে আবার টোটা গোপীনাথের অঙ্গে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন মহাপ্রভু। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক তত্ত্বকে সামনে এনে চৈতন্য অন্তর্ধানের কারণ বিশ্লেষণ করে থাকেন। এমনকী গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, গম্ভীরার যে গোপন পথ জগন্নাথ মন্দির অবধি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে যুক্ত ছিল, মহাপ্রভু সেই পথ ধরেই হারিয়ে হন। আসলে চৈতন্যদেবের পার্থিব শরীর না মেলার কারণে ‘হাজারো অনুমানের খেলা’ চলে আজও।
‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস আচার্য মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমীর দিন বাংলা থেকে পুরীর পথে রওনা দিয়েছিলেন। পুরীর কাছাকাছি পৌঁছে তিনি চৈতন্যদেবের অন্তর্ধানের খবর পান।
তবে সব মিলিয়ে অন্তর্ধানের আগের মুহূর্তে মহাপ্রভু যে এই গম্ভীরা থেকে বের হয়েছিলেন, সেই বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। আমরা যদি চৈতন্য পার্ষদ এবং সমকালীন পদকর্তাদের লেখা পড়ি, তাহলে দু’টি বিষয় সামনে আসে— রথের দিন মহাপ্রভু একটি গম্ভীরা থেকে বের হয়েছিলেন এবং সেদিনই জগন্নাথদেহে বিলীন হয়ে যান মহাপ্রভু। তবে তা কিন্তু গুণ্ডিচা বাড়ি থেকে। অর্থাৎ জগন্নাথের মাসির বাড়ি থেকেই অন্তর্ধান মহাপ্রভুর। আর দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হল, নাম-সংকীর্তন করার সময় নৃত্যরত মহাপ্রভুর পায়ে ইটের টুকরো বিঁধে যায়। মহাপ্রভু জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করেন এবং দেহ রাখেন। লক্ষাধিক ভক্ত, তৎকালীন ওড়িশার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে রাজা প্রতাপরুদ্র, বাসুদেব সার্বভৌমের মতো মানুষজনের তত্ত্বাবধানে মহাপ্রভুকে সমাধিস্থ করা হয় ‘কোহলি বৈকুণ্ঠে’। সেখানে প্রতি ১২ বছর অন্তর ‘নব কলেবর’ উৎসবের সময় জগন্নাথের প্রাচীন দারুব্রহ্মমূর্তিগুলি সমাধিস্থ করা হয়। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে রাজা, রাজগুরু এবং সভাপণ্ডিত ‘জগন্নাথ দেহে লীন’ হওয়ার তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করেন। সহজ সরল ভক্তরা মহাপ্রভুকে শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসেবেই ভাবতেন। সেই কারণে এই বিষয়টি নিয়ে সেসময় আর কোনও প্রশ্ন ওঠেনি!
ওড়িয়া গ্রন্থগুলিতেও এই বিগ্রহে লীন হওয়ার তত্ত্বই সমর্থিত হয়েছে। ঈশ্বরদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ অনুসারে সেকালের একজন মাত্র মানুষ, বাসুদেব তীর্থ, এই তত্ত্বের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, সন্দিহান হয়ে প্রকাশ্যে জগন্নাথ মন্দিরের মুক্তিমণ্ডপে এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেছিলেন। অবশ্য তখন চৈতন্য তিরোভাবের পর অন্তত ‘একশো’ বছর কেটে গিয়েছে। অতএব এটা স্পষ্ট যে, মহাপ্রভুর মৃত্যুর অন্তত পঞ্চাশ থেকে একশো বছর পর্যন্ত সময়কালে তাঁর মৃত্যুর কারণ খুঁজতে কেউই বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।
মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর দীর্ঘদিন কাতারে কাতারে ভক্ত এসেছেন গম্ভীরায়। গম্ভীরার প্রধান আচার্য রাজগুরু কাশী মিশ্র নিঃসন্তান হওয়ার কারণে গোপালগুরুকে রাধাকান্তদেবের সেবায় নিযুক্ত করেন। গোপালগুরু ছিলেন মহাপ্রভুর অত্যন্ত কাছের মানুষ। তিনি রাধাকান্তের বামদিকে শ্রীরাধা ও ডানদিকে ললিতা দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নাম করা যায় বক্রেশ্বর পণ্ডিতের। তিনি দীর্ঘদিন রাধাকান্ত মঠের দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য তিনি নিজে কখনও গম্ভীরার প্রধান মোহন্ত বা প্রধান আচার্য হননি। উল্টে তিনি গোপালগুরুর মতো সাধকদের তৈরি করেছিলেন। সেই সাধকরাই এই মঠকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন যুগের পর যুগ ধরে...।