যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
৩ জুন ১৯৪৭
ইন্ডিয়ান লিডারদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক। একবার মিস্টার জিন্না বলছেন, তিনি ক্যালকাটাকে ছেড়ে দিতে রাজি নন। এমনকী বেঙ্গলের পার্টিশনও যেন না হয়। আবার পণ্ডিত নেহরু বলছেন, তাঁদের আপত্তি আছে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসে। তাছাড়া কমনওয়েলথে থাকার ব্যাপারটা যেন কোনও জোরজবরদস্তি না হয়। মহাত্মা গান্ধী তো যে কোনওভাবেই পার্টিশন হোক মেনে নেবেনই না। এই তো ৬ মে শেষবার গান্ধীজি আর জিন্নাকে মিটিংয়ে ডাকা হল ভাইসরিগাল হাউসে। যাতে তাঁরা দু’জনে মুখোমুখি বসে সরাসরি কথা বলেন। তিন ঘণ্টা টানা কথা হল। কোথায় কী? দু’জনেই থমথমে মুখে বেরিয়ে এলেন এবং মাথা নাড়লেন। বোঝা গেল লাভ হয়নি। প্রচণ্ড ক্লান্ত লুই মাউন্টব্যাটেন। এদিকে লন্ডন থেকে প্রাইম মিনিস্টার বারংবার তাড়া দিচ্ছেন কিছু একটা ফাইনাল প্ল্যান পাঠাতে হবে। ক্যাবিনেট চাইছে দ্রুত হস্তান্তর। কিন্তু প্ল্যানই তো স্থির করা যাচ্ছে না। কেউই একমত হচ্ছে না। স্ত্রী এডুইনা বললেন, ‘চল ডিকি কিছুদিন সিমলায় যাই। তোমাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত লাগছে।’ একই কথা ভেবেছেন মাউন্টব্যাটেনও। তাই ঠিক হল আপাতত ফাইলপত্র নিয়ে দিল্লির এই মারাত্মক গরম ও টেনশন থেকে বাঁচতে যাওয়া হোক সিমলা।
মাউন্টব্যাটেন আর স্ত্রী এডুইনা এবং তাঁদের মেয়ে পামেলা গেলেন সিমলা। কয়েকদিনের মধ্যেই মাউন্টব্যাটেন আমন্ত্রণ করলেন পণ্ডিত নেহরুকে। নেহরুর সঙ্গে এসেছে তাঁর একমাত্র কন্যা। পামেলার বন্ধু হয়ে গিয়েছেন সেই মেয়েটি। নাম ইন্দিরা। এদিকে ইতিমধ্যে ভাইসরয় লুই মাউন্টব্যাটেনের অফিসের চিফ অফ স্টাফ লর্ড ইজমে লন্ডন চলে গিয়েছেন একটা খসড়া প্ল্যান নিয়ে। প্ল্যানটা ১৬ এপ্রিল থেকে তৈরি করা শুরু হয়েছিল। সেটা লন্ডনে গিয়ে অনুমোদন করানো দরকার। যত দ্রুত সম্ভব। এর মধ্যেই ইজমে একাধিক টেলিগ্রাম করেছেন মাউন্টব্যাটেনকে। বলেছেন, ব্যাপারটা ঠিকমতোই অগ্রসর হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, অনুমোদিত হয়ে যাবে। কারণ, ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের বার্মা আর ইন্ডিয়ান কমিটি তো বেশ খুশি।
মাউন্টব্যাটেন স্বস্তি পেলেন। যাক! টেনশনটা এবার কমবে মনে হচ্ছে। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, এরকম চললে আশা করা যায়, ১০ দিনের মধ্যে লর্ড ইজমে প্ল্যান অ্যাপ্রুভ করিয়ে ফিরে আসছেন। তাহলে ২০ মে’র মধ্যে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, শিখ প্রতিনিধিদের ডেকে একটা প্রাথমিক আর একটা চূড়ান্ত মিটিং করে জানিয়ে দেওয়া যাবে। তাঁদের মতামতও চাওয়া হবে। নতুন খসড়া লন্ডন থেকে চলে এল কয়েকদিনের মধ্যে। স্টাফদের সঙ্গে মিটিং করে নিলেন মাউন্টব্যাটেন। কিন্তু একইসঙ্গে তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে, একবার খসড়া প্ল্যানটা নেহরুকে দেখিয়ে নেওয়া ভালো। কারণ তিনি দেখছেন খসড়ায় বেশ কিছু বদল আছে। কিছু বদল তিনিই করেছিলেন। যা নেহরুরা জানতেন না। কিছু লন্ডনে হয়েছে। তাই একবার দেখানো উচিত। কিন্তু তৎক্ষণাৎ উপস্থিত বাকি অফিসাররা আপত্তি তুললেন। সকলেই বললেন, এটা কীভাবে হয়? একাধিক পার্টি আছে। আর তার মধ্যে বেছে বেছে একজনকেই শুধু সিক্রেট ড্রাফট দেখানো হবে, এটা তো নীতিহীন ব্যাপার।
মাউন্টব্যাটেন সেটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু কী করা যাবে। তাঁর মনের মধ্যে একটা তাগিদ এসেছে যে, একবার অন্তত নেহরুকে দেখিয়ে নেওয়া দরকার। আসলে নেহরুর সঙ্গে একটা পৃথক বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে তাঁর। তাই ১০ মে নেহরুকে ডিনারের পর আলাদাভাবে ডেকে মাউন্টব্যাটেন বললেন, আপনাকে এই ড্রাফট দিচ্ছি। আজ একবার দেখে নিন। এটাই লন্ডনে ফাইনাল হয়েছে। আপনার কী মনে হয় বলুন। তাহলে আমরা অগ্রসর হব মোটামুটি এটা নিয়েই। গুড নাইট!
১১ মে সকাল। ব্রেকফাস্ট টেবলে পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ইভান জেনকিন্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন মাউন্টব্যাটেন। স্যার জেনকিন্স অতিরিক্ত কিছু ফোর্স চাইছেন পাঞ্জাবের জন্য। পরিস্থিতি যেদিকে এগচ্ছে আর সামলানো যাচ্ছে না। জেনকিন্স আরও বললেন, সব পার্টিকে ডেকে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিন। পার্টিশন হবে কি না সেটা তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিলে আমরা সেভাবেই ফোর্স ডেপ্লয় করতে পারব। এরপর কিন্তু অলমোস্ট লার্জ স্কেল দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। দু’পক্ষই যেভাবে চোরাগোপ্তা হানাহানি চালাচ্ছে আর পারা যাচ্ছে না। মাউন্টব্যাটেন চিন্তিত। তিনিও বুঝতে পারছেন। একই ভাবনা বেঙ্গল নিয়েও।
ঠিক তখনই একটা চিঠি এল। নেহরুর। মাউন্টব্যাটেন জানেন, সেই চিঠিতে রয়েছে নিশ্চয়ই ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নেহরুকে দেওয়া সেই খসড়ার প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এ কী? এটা চিঠি? নাকি বোমা! নেহরু রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। চিঠিতে নেহরু লিখছেন, এটা কী হচ্ছে? আপনার সঙ্গে আমাদের শেষ যে বৈঠক হয়েছিল এই প্ল্যান তো সম্পূর্ণ আলাদা! এই প্ল্যান যদি কার্যকর হয়, তাহলে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আপনারা কি চাইছেন ভারতের বলকানাইজেশন? অসংখ্য ভাগে বিভাজিত হয়ে যাক! আমি নিজেই এত বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ যে আপনি ভাবুন আমার সহযোগী কংগ্রেস নেতৃত্ব এটা জানলে তাঁদের রিঅ্যাকশন কী হবে!
মাউন্টব্যাটেন স্তম্ভিত! নেহরু মেনে না নিলে প্ল্যান কার্যকর করা অসম্ভব! কংগ্রেসের ঐকমত্য সর্বাগ্রে দরকার। কিন্তু তাহলে উপায়? নেহরুর রাগের কারণ এই খসড়ায় বলা হয়েছে ম্যাড্রাস, বম্বে, সংযুক্ত প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা এসব রাজ্যগুলি নিজেদের বিধানসভায় স্থির করবে তারা কী করবে। প্রদেশগুলিই গড়বে ইউনিয়ন। ভারতে কেন্দ্রীয় গণপরিষদের তো কোনও ভূমিকাই থাকছে না। আর বেঙ্গল নিয়ে কংগ্রেস প্রথম থেকে বলে আসছে যে স্বাধীন বাংলা তারা চায় না। কারণ আজ নয় কাল, এই স্বাধীন বাংলা চলে যাবে পাকিস্তানেই। মুসলিম লিগের প্রভাবে। সেই কারণে জিন্নার আপত্তি ছিল না। স্বাধীন বাংলা ব্যাপারটা কী? মুসলিম লিগের হোসেন সুরাবর্দি, কংগ্রেসের কিরণশঙ্কর রায়, শরৎচন্দ্র বসুরা চাইছিলেন বাংলা কোনওদিকেই থাকবে না। ভারত অথবা পাকিস্তান। সে হবে স্বাধীন। এই প্ল্যানে সায় ছিল বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজেরও। তবে তিনি বিশেষ জোর দিচ্ছেন ক্যালকাটা যেন পৃথক একটা স্বাধীন বন্দর শহর হয়। তাই এই নিয়ে টানাপোড়েন ছিলই। এবার এই প্ল্যানে সেই ব্যবস্থার প্রতি অনেকটাই সুযোগ করে দেওয়া হবে। আর সব দেশীয় রাজ্যকেই আলাদা হয়ে যাওয়ার পূর্ণ প্ররোচনা আছে। সুতরাং আমরা এই প্ল্যান মানছি না। নেহরুর সাফ কথা।
রিফর্ম কমিশনার ভি পি মেনন ছিলেন শিমলায়। তাঁকে ডাকা হল। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি জানি। কাল রাত দুটোয় নেহরু আমার ঘরে এসে বার্স্ট করেছেন। আমাদের একটা বিকল্প ড্রাফট দিতে হবে। পুরনো খসড়ায় ফিরে যাওয়াই উচিত। ১৩ মে নতুন খসড়া তৈরি হল। কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলির কাছে কোনও বিকল্প নেই। তাদের যোগ দিতেই হবে ভারতীয় ইউনিয়নে। সীমান্ত প্রদেশ নিজেরা ঠিক করবে ভোটাভুটির মাধ্যমে যে, তারা কী করবে। বেঙ্গল ও পাঞ্জাবের বিধানসভায় ভোটাভুটি হবে। প্রধানত দু’টি বিষয়ে। তারা কি ঐক্যবদ্ধ থাকতে চায়? তারা ভারত নাকি পাকিস্তান কোন অংশে যেতে চায়?
নতুন প্ল্যান লন্ডনে পাঠানো হলে প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ইন্ডিয়া অফিসের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, এখনই মাউন্টব্যাটেনের আসা দরকার লন্ডনে। মুখোমুখি বসে চূড়ান্ত করা হবে। যাতে আর কোনও জটিলতা না হয়। ১৮ মে রিফর্ম কমিশনার ভি পি মেননকে সঙ্গে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হলেন। এখনও পর্যন্ত স্থির আছে ১৯৪৮ সালের জুন মাসে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। মাউন্টব্যাটেন অবশ্য ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, তিনি অত দেরি করতে চান না। সমস্যা তো একটাই। কংগ্রেস এখনও যেন মনস্থির করতে পারছে না যে, ভারত কমনওয়েলথে থাকবে কি না। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেটাই চায়। বিরোধী নেতা উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে দু’বার দেখা করে মাউন্টব্যাটেন বুঝলেন উইনস্টনের যেন শর্তই তাই। অর্থাৎ ভারত আর পাকিস্তান কমনওয়েলথে থাকলে তবেই এই প্ল্যান তারা পার্লামেন্টে পাশ করতে সমর্থন দেবে।
কিন্তু লন্ডনে ক্যাবিনেট কমিটির সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই মাউন্টব্যাটেন টেলিগ্রামে জানতে পারলেন, অবাস্তব কিছু কথাবার্তা শুরু করেছেন জিন্না। ভাইসরয় হাউসের ভারপ্রাপ্ত চিফ অব স্টাফ স্যার এরিক মিভেল জানিয়েছেন, জিন্না বলেছেন বেঙ্গলের কোনও পার্টিশন তিনি মানবেন না। উল্টে পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত একটি করিডর চাই তাঁর। ওই করিডর যোগসূত্র হবে পাকিস্তানের সঙ্গে বেঙ্গলের। নেহরু প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিলেন, এসব কী অবাস্তব দাবি! এগুলো আমরা ভাবতে রাজি নয়। মাউন্টব্যাটেনও বিরক্ত। কথাটা তিনি তুললেন উইনস্টনের কানে। আলোচনার সময়। উইনস্টন চার্চিল সেদিন বাড়িতেই বেডরুমে। একটা উইক হুইস্কি আর সিগার হাতে নিয়ে তিনি মাউন্টব্যাটেনকে আশ্বাস দিলেন প্ল্যান সমর্থনের। আর একটু পর দিলেন একটা কাগজ। বললেন, এটা জিন্নাকে দিও! সেই কাগজে লেখা ‘দিস ইজ আ ম্যাটার অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ ফর পাকিস্তান, ইফ ইউ ডু নট অ্যাকসেপ্ট দিস অফার উইথ বোথ হ্যান্ডস!’ জিন্নার শেষ ভরসা চার্চিলেরও আর বেশি কিছু করার নেই।
দিল্লি ফিরলেন মাউন্টব্যাটেন চূড়ান্ত প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে। সব দলের নেতাদের ডাকলেন ২ জুন ভাইসরয় হাউসে। কিন্তু আগের দিন ভোর। পয়লা জুন। সারা রাত ঘুম হয়নি মহাত্মা গান্ধীর। ভোরেই প্রার্থনার পর মৃদুস্বরে যেন ফিসফিস করে নিজেকে বললেন, সর্দার ও জওহরলাল মনে করে আমার পরিস্থিতি বুঝতে ভুল হচ্ছে। দেশ ভাগ হলে নাকি শান্তি আসবে...ওরা মনে করে বয়সের সঙ্গে আমাকে ভীমরতিতে ধরেছে...কিন্তু...কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সমস্যার সমাধানে আমরা ভুল পথে এগচ্ছি...।
মাউন্টব্যাটেন ঠিক সেই সময় ভাবছেন সর্বাগ্রে একজনের অনুমতি দরকার। যিনি যেকোনও সময় সব প্ল্যান ভেস্তে দিতে পারেন। অতএব মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন। সোমবার। এদিন মহাত্মা গান্ধীর স্তব্ধতা দিবস। অর্থাৎ সোমবার তিনি কোনও কথা বলেন না। কাগজে লিখে জানালেন, আজ তো কথা বলি না। যদি আবার কথা হয় আমার কয়েকটি বক্তব্য জানাব। তবে আমি এখনও পর্যন্ত আপনার সম্পর্কে কোথাও বিরুদ্ধাচরণ করিনি। তাই সংশয় করবেন না।
ভাইসরয় হাউসে একে একে ঢুকলেন নেতারা। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নেহরু, প্যাটেল, জে বি কৃপালনী। মুসলিম লিগের প্রতিনিধি জিন্না, লিয়াকত আলি খান ও আবদুর রব নিস্তার। শিখ সমাজের হয়ে বলদেব সিং। মাউন্টব্যাটেন বেশি কথাবার্তা চাইছেন না। কারণ যত কথা হবে, ততই ঝগড়ায় পর্যবসিত হবে। তাই তিনি সাফ জানালেন, এই নিন প্ল্যান। আমাকে আজ মধ্যরাতের মধ্যে জানাবেন আপনাদের ফিডব্যাক। জিন্না বললেন, আমি আবার রাত ১১টায় আসছি। কংগ্রেস আভাস দিয়েছে তারা রাজি। যদিও পূর্ণ সমর্থন করে না এই প্ল্যান। তবে গান্ধীজি...। সকলেই চুপ। কারণ গান্ধীজি দেশভাগে সায় দিচ্ছেন না। কিন্তু আর পিছনে ফেরার অবকাশ নেই। এখন এটাই চূড়ান্ত প্ল্যান।
জিন্না এলেন রাতে। বললেন, দেখুন আগামী কাল যে প্ল্যানের ফাইনাল মিটিং, সেখানে আমার একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই আমাকে দলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
মাউন্টব্যাটেন বললেন, মিস্টার জিন্না, আপনি এই প্ল্যানেই সন্তুষ্ট না হলে এরপর কংগ্রেস কোনওভাবেই আর কোনও দাবি কিংবা প্ল্যান মানবে না। আপনি চিরতরে একটা জিনিস হারাবেন আগাম বলে রাখলাম। সেটি হল পাকিস্তান!
চমকে তাকালেন জিন্না। শূন্য দৃষ্টি। তিনি এই পোকায় খাওয়া পাকিস্তানে রাজি হবেন কীভাবে? এটাই ভাবছিলেন। কলকাতা পাওয়া না গেলে পূর্ব বাংলা পেয়ে লাভ কী? কারণ বাংলাকে যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় পাকিস্তানে রাখা যাবে না সেটা স্পষ্ট। পাঞ্জাবও তাই। কিন্তু সোজাসুজি মাউন্টব্যাটেন জানতে চাইলেন আমি কী ধরে নেব আপনি রাজি? কাল সকালের বৈঠকে আপনার দিকে আমি যখন তাকাব, আপনি তখন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাবেন। ঠিক আছে? জিন্না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ইয়েস!
৩ জুন। সকাল ১০টায় আবার সব নেতারা হাজির হলেন। সকলেই নিজেদের মতামত জানিয়ে সমর্থন বা বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজি হলেন। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়ে গেল প্ল্যান পার্টিশন। একটা বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হবে। তারাই স্থির করবে কোন এলাকা কোন দেশে যাবে। ২০ জুন বাংলা বিধানসভায় ভোটাভুটিতে সিদ্ধান্ত হবে যে, বাংলা কী করবে? ভারত? পাকিস্তান? ঐক্যবদ্ধ? নাকি বিভাজিত? এবার আসল প্রশ্ন। তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তর কবে হবে? হঠাৎ মাউন্টব্যাটেন বললেন, এই ধরুন ১৫ আগস্টের মধ্যেই!
গোটা ঘরে যেন বাজ পড়েছে! ১৫ আগস্ট? আর মাত্র ১০ সপ্তাহ! হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত বদল? এর মধ্যে এত বড় দেশভাগ হওয়া সম্ভব? মাউন্টব্যাটেন বললেন, এটাই বেস্ট সলিউশন! বাংলা ও পাঞ্জাব নামক দু’টি রাজ্যের প্রান্তিক মানুষ সেদিন সন্ধ্যায় অল ইন্ডিয়া রেডিওয় শুনলেন, ঘোষণা। দেশভাগ হয়ে যাচ্ছে! জন্ম নিতে চলেছে নতুন দু’টি স্বাধীন দেশ। ভারত। পাকিস্তান। বাংলা ও পাঞ্জাবে জন্ম নিতে চলেছে একটি নতুন শব্দ! উদ্বাস্তু! বদলে যাবে দেশের ভূগোল। বদলে যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভাগ্যও। আসবে স্বাধীনতা। অথচ কত লক্ষ মানুষের কাছে হারিয়ে যাবে তাদের দেশ! এবং ঘর!
এল মুক্তির দিন
এখন রাত ১১টা। ১৪ আগস্ট। ১৯৪৭। দিল্লির রাজপথে এত রাতেও বেশ ভিড়। সকলেই সংবিধান সভা ভবনের দিকে যাচ্ছে। সেখানে ইতিমধ্যেই একটি বিশেষ অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঘোষণার সভা যেন সেটি। সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ বললেন, আমাদের প্রথম কর্মসূচি বন্দে মাতরম গাওয়া। আসুন আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই। আর গলা মেলাই। আমি আহ্বান করছি শ্রীমতী সুচেতা কৃপালনীকে। সুচেতা কৃপালনী এগিয়ে এলেন। সভাপতির আসনের ঠিক নীচের জায়গাটায় রাখা আছে মাইক্রোফোন। সেখানে দাঁড়িয়ে বন্দে মাতরম সঙ্গীত গাইলেন তিনি।
সকলে উপবিষ্ট হওয়ার পর রাজেন্দ্র প্রসাদ এক অসামান্য বক্তৃতায় স্মরণ করলেন আত্মবলিদান দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। এই পবিত্র ক্ষণে বহু সংগ্রামের পর আমরা অবশেষে এই দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাহেন্দ্রক্ষণে হাজির হয়েছি। যাঁরা হেঁটে গিয়েছেন হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চের দিকে, যাঁরা বুকে নিয়েছেন বুলেট, আমরা তাঁদের স্মরণ করি... আসুন স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সেই মহৎ আত্মাদের জন্য শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি...।
দু’মিনিট নীরবতা পালনের পর রাজেন্দ্র প্রসাদ ডেকে নিলেন জওহরলাল নেহরুকে। প্রাথমিক ভাষণের পর পণ্ডিত নেহরু পেশ করলেন একটি প্রস্তাব। যা আসলে সেই অমোঘ বিখ্যাত ভাষণ। ভারতবর্ষ নামক একটি দেশের নিয়তির সঙ্গে অভিসারের এক অভিযাত্রার বিবরণ। নেহরুর ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ বক্তৃতার পর মধ্যরাতের সেই ঐতিহাসিক সভায় ডাকা হল সংযুক্ত প্রদেশের চৌধুরী খলিকুজ্জামানকে। তাঁর বক্তৃতার শেষাংশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বললেন, আজ থেকে আমরা এমন একটি কর্তব্য পালনের দায়িত্ব নিতে চলেছি, যা একটিও ভারতবাসীকে বৈষম্যের চোখে দেখবে না। ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণাণ জোর দিলেন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বিভাজনের থেকেও অনেক বেশি গভীর দ্বিখণ্ডিত এই দেশের মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন। আধ্যাত্মিক আত্মীয়তা, সাংস্কৃতিক ঐক্য বজায় রাখা। রাধাকৃষ্ণাণ যেন দৈববাণী করলেন একটি বাক্যে, যখন তিনি বললেন, ‘আমি সকলকে সতর্ক করতে চাই যে, যখনই ক্ষমতা যোগ্যতাকে ছাপিয়ে যায়, তখনই আমরা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে প্রবেশ করি। আমরা এখন আর সব দোষ ব্রিটিশদের ঘাড়ে চাপাতে পারব না। আমাদের নিজেদের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। মুক্ত ভারত যেন তাঁর অস্তিত্ব ও পরিচিতি খুঁজে পায় সাধারণ মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমেই।’
১২টার ঘড়ির কাঁটা স্পর্শ করতে সামান্য দেরি আছে। রাজেন্দ্র প্রসাদ সংবিধান সভার সদস্যদের বললেন, মধ্যরাতের ঠিক প্রাক্কালে আমরা একটি শপথ গ্রহণ করব। আপনারা পাঠ করবেন। তারপর হবে ভোটাভুটি। সেই শপথ প্রস্তাবের পক্ষে। তিনি এবং ভারতের সংবিধান সভার সদস্যরা উচ্চারণ করলেন সেই শপথ: ‘বহু আত্মবলিদান বেদনার মাধ্যমে ভারত আজ যে স্বাধীনতা অর্জন করল, আমি সংবিধান সভার এক সদস্য সেই ভারতবর্ষ এবং তাঁর নাগরিকদের সেবার কাজে নিজেকে অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত মানবিকতার সঙ্গে সমর্পণ করছি। যতক্ষণ না পর্যন্ত এই মহান প্রাচীন ভূমি বিশ্বসংসারে এক উচ্চস্থান লাভ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার সার্বিক সদিচ্ছা যেন মানবকল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে।’
শপথবাক্য পাঠ সমাপ্ত হতেই ঠিক ১২টা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ বললেন, এবার আমরা ভাইসরয়কে এই বার্তা প্রদান করলাম যে, ভারতের সংবিধান সভা ভারতের শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে গ্রহণ করেছে। আজ থেকেই অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে মনোনীত করার সুপারিশ করছে।
সকলের চোখ এবার একটি কাপড়ের দিকে। তেরঙ্গা। এই হল ভারতের নতুন আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। জাতীয় পতাকা। শ্রীমতী হংস মেহতা এগিয়ে এলেন। তাঁর হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা। বললেন, আমি দেশের নারীজাতির পক্ষ থেকে আজ স্বাধীন ভারতের হাতে তুলে দিলাম জাতীয় পতাকা। এই পতাকা আজ থেকে গোটা বিশ্বকে প্রদান করুক অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার এক দৃপ্ত প্রতিজ্ঞা।
গোটা সংবিধান সভা করতালি এবং হর্ষধ্বনিতে স্বাগত জানাল এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে। সর্বশেষ অনুষ্ঠান কী? ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ গানের প্রথম স্তবক এবং তারপর সমবেতভাবে গাইবেন সকলে ‘জনগণমন’। ভেসে গেল মধ্যরাত জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে শ্লোকে। শুধু সংবিধান সভার অভ্যন্তর নয়। গোটা ভারত গাইছে তখন সেই গান। মধ্যরাতে যেন একটি সূর্য উদিত হল।
স্বাধীন হল ভারত!