যে কোনও কর্মেই একটু বাধা থাকবে। তবে উপার্জন মন্দ হবে না। ললিতকলায় ব্যুৎপত্তি ও স্বীকৃতি। ... বিশদ
উত্তমবাবু সব সময় মানুষের পাশে থাকার কথা বলতেন
মাধবী মুখোপাধ্যায়
‘কী কন্যে ভয় লাগছে? তাহলে আমি এখানে থাকব।’— আমার বিয়ের দিন সকালবেলা। হঠাৎই আমাকে একথা বললেন উত্তমকুমার। তখন নতুন কনে আমি। বললাম, ‘না ভয় লাগছে না।’ বললেন, ‘তাহলে আমি বরকর্তা হয়ে আসি?’ আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সারাদিন শ্যুটিং করলেন। রাতে বিয়ের সময় এলেন বরকর্তা হয়ে। ধুতি, পাঞ্জাবি পরে একেবারে বিয়েবাড়ির সাজ। সঙ্গী সুপ্রিয়া দেবী। কী খাবেন সেটাও আবার আগে থেকে বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘লুচি খাব।’ কিন্তু লুচিটা সরষের তেল দিয়ে ভাজা। আমরা এখন অনেকেই সরষের তেল এড়িয়ে চলি। কিন্তু উনি সরষের তেলে ভাজা লুচি খেতে পছন্দ করতেন। আমাকে একটা শাড়ি আর নির্মলকে সোনার বোতাম দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন।
আমার সঙ্গে উত্তমবাবুর প্রথম আলাপ একটু অদ্ভুতভাবে। কত সাল এখন আর মনে নেই। ৩১ ডিসেম্বর রাতে আমি আর আমার দিদি পার্কস্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁয় গিয়েছিলাম। আমরা যেতাম ম্যাকডোলিয়ায়। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে দেখি উত্তমকুমার। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে শ্যামল মিত্রও ছিলেন। ওঁরা কোথায় গিয়েছিলেন সেটা বলতে পারব না। উত্তমকুমার আমাকে ডাকলেন, ‘শুনুন, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।’ আমি তো হকচকিয়ে গেলাম। বললেন, ‘আপনার সুবর্ণরেখা ভীষণ ভালো হয়েছে।’ আমি কনফিউজড। বুঝতেই পারছি না। কারণ ‘সুবর্ণরেখা’ তখনও রিলিজই হয়নি। উনি কী করে দেখলেন? ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেও যে দেখা যায়, সেটা জানতাম না। যখন পরবর্তীকালে একের পর এক ছবি করেছি, তখন দেখেছি আমাদের স্টুডিওতে আগে থেকে স্ক্রিনিং করা যায়। দেখা যায়। সেখানেই উনি দেখেছিলেন। ওঁর ভালো লেগেছিল।
উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি সম্ভবত ‘থানা থেকে আসছি’। সেখানে ওঁর সঙ্গে আমার কোনও দৃশ্য ছিল না। কিন্তু পরিচালক যেতে বলেছিলেন ওঁর শ্যুটিংয়ে, তাই গিয়েছিলাম। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে উনি উঠে দাঁড়ালেন। সেটাই ভদ্রতা। বললেন, ‘বসুন ম্যাডাম, বসুন।’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘একটা অনুরোধ আপনাকে করতে পারি? ম্যাডাম শব্দটা আমাদের এখানকার নয়। আর ম্যাডাম হওয়ার উপযুক্তও আমি নই। আমার একটা নাম আছে, মাধবী বলে ডাকলেই হবে।’ বললেন, ‘হবে, হবে। সবই হবে।’ এটুকুই কথা। তারপর শটে চলে গেলেন। আমিও সেদিন আর থাকিনি বেশিক্ষণ। চলে এসেছিলাম। তারপর থেকে আমার নাম ধরেই ডাকতেন। আমি উত্তমবাবু বলতাম।
তারপর মনে হয় ‘শঙ্খবেলা’ করেছিলাম। সে সময় সোমা মানে সুপ্রিয়া দেবীর মেয়ে, খুবই ছোট। মর্নিং ওয়াক করতেন উত্তমবাবু। ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ হাঁটা ওঁর রুটিন ছিল। সুপ্রিয়া দেবী একদিন আমাকে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি। সোমা উঠলে তুই একটু খাইয়ে দিবি?’ সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে আমার এরকমই সম্পর্ক ছিল। ‘তুই’ বলতেন। আমি বললাম, ‘তুমি যাও। আমি ঠিক খাইয়ে দেব।’ সোমাকে গল্প করে খাইয়ে দিতাম। এখন সেই সোমার ছেলে (শন বন্দ্যোপাধ্যায়) হিরো হয়ে গিয়েছে। খুব সুন্দর অভিনয় করছে।
উত্তমকুমার যেমন অভিনেতা ছিলেন, মানুষ হিসেবেও ছিলেন সকলের ঊর্ধ্বেই। তাঁর মানসিকতাই অন্যরকম ছিল। প্রত্যেকের জন্য তাঁর মনে ছিল সহানুভূতি। একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। একদিন মেকআপম্যান উত্তমবাবুর মেকআপ করছে। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী রে, কী হয়েছে তোর? কিছু গোলমাল হয়েছে মনে হচ্ছে?’ সে বলল, ‘না দাদা। কিছু গোলমাল নেই সব ঠিক আছে।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে বললে তো হবে না। কারণ আমরা যে কাজ করি, অনুভব করি যেটা, সেখান থেকেই এক্সপ্রেশন তৈরি হয়। সেই কারণে মুখ দেখলে, এক্সপ্রেশন দেখলে বুঝতে পারি। তোর কী হয়েছে বল।’ তখন সে বলল, ‘আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সব ঠিকই আছে। খাট, আলমারি আরও যা যা আমাদের দেওয়ার সামর্থ্য দিচ্ছি। কিন্তু তার সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা নগদ দিতে হবে। সেটা জোগাড় করতে পারিনি।’ আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা বলছি। তখন পাঁচ হাজার টাকা কিন্তু কম নয়। উত্তমবাবু বললেন, ‘সব জোগাড় করেছিস যখন পাঁচ হাজার টাকাও জোগাড় হয়ে যাবে।’ সে বলল, ‘না দাদা, কী করে হবে? যা যা যেখান থেকে জোগাড় করার ছিল সব করেছি।’ তখনও উত্তমকুমার বলছেন, ‘ও ঠিক হয়ে যাবে।’ সেই মেকআপম্যানের মেয়ের বিয়ের একমাস আগের কথোপকথন এটা। একমাস পর যেদিন মেয়েটির বিয়ে হল, সেদিন উত্তমকুমার তার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। ওই পাঁচ হাজার টাকাটা ওকে দিয়ে এসেছিলেন। এরকম ছোট ছোট অনেক ঘটনা মানুষ জানেনই না।
কখনও উত্তমবাবুকে রাগতে দেখিনি। তবে একটা ঘটনা ঘটেছিল। উনি অভিনেতৃ সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন একটা অ্যান্টিগ্রুপ তৈরি হয়। কে তৈরি করেছিলেন, তাঁর নাম আমি বলব না। তাঁরা একটা জায়গায় লিখে দিলেন, উত্তমকুমার চোর। সেটা শুনে ওঁর খুব খারাপ লেগেছিল। কেঁদেই ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাকে এমন বদনাম কেউ কখনও দেয়নি।’ তখন অভিনেতা বিকাশ রায় বললেন, ‘তুই ভাবছিস কেন?’ বিকাশ রায় ছিলেন আইনজীবী। উনি আইনি দিকটার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন ব্যবস্থা করেছিলেন, যা প্রেসিডেন্ট রুলের মতো। তখন সেটার নাম হল শিল্পী সংসদ। উত্তমবাবু যতদিন বেঁচেছিলেন, একের পর এক ছবি করেছেন। তার থেকে একটা অংশের টাকা দিয়ে একটা ফান্ড করা আছে। আজও সেখান থেকে দুঃস্থ শিল্পীরা সাহায্য পান। উনি অনুভব করেছিলেন শিল্পীদের কাজ করার ক্ষমতা চলে গেলে অর্থাভাবের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সুষ্ঠভাবে চালানো দুর্বিষহ হয়ে পড়বে। তাঁদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ১৯৬৮ সালে শিল্পী সংসদ গড়ে তুলেছিলেন। যাতে এই সংগঠনের সহযোগিতা দুঃস্থ শিল্পীরা পান। ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘দুই পৃথিবী’, ‘রুদ্রবীণা’র মতো ছবি তৈরি করে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন উনি। সেখান থেকে যাত্রাশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী সব স্তরের শিল্পীরা সাহায্য পেতেন।
এত কাজ করতেন, কিন্তু কখনও ওঁকে ক্লান্ত মনে হতো না। কতগুলো ঘটনা শুধু মনে পড়ে। একসময় নিজের বাড়ি ছেড়ে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে চলে যান। সেই ঘটনার পর একদিন শ্যুটিং চলছে। খাবার এসেছে দু-বাড়ি থেকেই। সুপ্রিয়া দেবী খাবার পাঠিয়েছেন। আবার গৌরী দেবীও খাবার পাঠিয়েছেন। সেদিন কোনও খাবারই উনি খেলেন না। চা আর বিস্কুট খেয়ে সারাদিন শ্যুটিং করলেন। আসলে এসব নিয়ে কখনও কথা বলিনি। ব্যক্তিগত জীবন এবং কাজের জগৎ আমি আলাদা রাখতাম। আজও সেটা করি। উত্তমবাবুর ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগতই থাকত। একটা দাঁড়ি টানা থাকত সবসময়।
তবে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ছোট ছোট মুহূর্তও তৈরি হতো। আমার মনে পড়ে, যখন আউটডোরে যেতাম, তখন উনি তো সুইটে থাকতেন। আর সুপ্রিয়া দেবীকে বলতেন, ‘বেণু, মাধবীকে বল, এখানে আমাদের সঙ্গে থাকতে।’ আমি বলতাম, ‘একেবারেই না। আমি একলা থাকতেই ভালোবাসি।’ সিঙ্গল রুমে থাকতাম আমি। তখন বলতেন, ‘ঠিক আছে, একলা থাক। কিন্তু একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করবে।’ সুপ্রিয়া দেবী এত খাওয়াতেন আমার তো একবার পেট খারাপ হয়ে গেল! ওঁদের সঙ্গে আউটডোরে অনেক জায়গায় গিয়েছি। মনে পড়ে, তোপচাঁচি ওঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিল। সেখানে ‘অগ্নিশ্বর’-এর শ্যুটিং করতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে সুপ্রিয়া দেবী রান্না করতেন। আর আমরা তিনজন খেতাম।
শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতাও উত্তমবাবুর থেকে শেখার মতো। তখন সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ছ’টা-সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত শ্যুটিং হতো। তার বেশি হতো না। আর এক্সটেনশন হলে শিল্পীদের আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হতো। উনি সকাল ১০টায় স্টুডিওয় আসতেন। শেষ পর্যন্ত থেকে ৬টা-সাড়ে ৬টাতেই বেরতেন। এত ছবি করতেন, প্রতিদিনই শ্যুটিং থাকত। শুধু রবিবার বাদ। রবিবার ওঁর বাড়িতে গান আর ইংরেজি ও হিন্দির একজন করে শিক্ষক আসতেন। বাড়িতেই তালিম নিতেন।
বাঙালির জীবনে উত্তমকুমার একজনই। আসলে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন— এই জুটি আমরা কোনওদিনই ভুলতে পারব না। দু’জনের ভাবনাচিন্তা দু’রকমের ছিল। উত্তমবাবু মানুষ নিয়ে ভাবতেন। আর সুচিত্রা সেন ভাবতেন আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে। ওঁর বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের গুরুভাইয়েরা আসতেন। তার বাইরে সুচিত্রা সেন কোনওদিনই খুব লোকজন নিয়ে থাকতেন না। কিন্তু উত্তমবাবুর আবার আলাদা ব্যাপার। মনে আছে আমার, যখন বন্যা হতো, তখন কিছু শিল্পীকে নিয়ে সাহায্য করতে বেরতেন। বুঝতেন, নিজের যা টাকা আছে, তা দিয়ে হবে না। বলিউড-টলিউড ক্রিকেট খেলার আয়োজন করে টাকা তুলতেন। তা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হতো। উনি বলতেন, ‘মানুষই তো আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই মানুষগুলোর পাশে থাকা দরকার।’
অভিনয় নিয়ে খুঁতখুঁতেমিই ওঁকে উত্তমকুমার বানিয়েছিল
রঞ্জিত মল্লিক
শ্যুটিং চলছে। ছবি ‘শ্রীকান্তের উইল’। উত্তমকুমারের শট। একটা দৃশ্যে দেখা যাবে সিঁড়িতে এসে মাথা ঘুরে গিয়ে পড়ে যাবেন উনি। আমার শট নেই। ওটা ওঁরই শট। আমি তো ভাবলাম, এটা সাংঘাতিক রিস্কি শট। সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবেন! কী করে পড়বেন! সেটা দেখার জন্য ওখানে আমি চুপ করে বসেছিলাম। ক্যামেরা রোল করতে শুরু করল। ডিরেক্টর বললেন, অ্যাকশন...। দেখলাম, উনি সিঁড়িতে এলেন, যেখানে মাথা ঘোরার কথা ওঁর, মাথা ঘুরল। তারপর পড়লেন! একেবারে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লেন। আমি তো আঁতকে উঠেছি, বাবা কী করে হল! তারপর দেখি ‘কাট’ হওয়ার পর আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লেন। কৌতূহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এই শটটা কেমন করে দিলেন, যদি আমাকে বলেন।’ প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। বলছিলেন, এটা এমন কিছু নয়। তারপর বললেন, ‘যেখানে এসে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে হবে, সেখানে পৌঁছে হাঁটুটা শক্ত করে রাখবে। একটু চেপে রাখবে। অল অব আ সাডেন হাঁটুটা আলগা করে দেবে। তাহলে ব্যালেন্সটা চলে যাবে। ব্যালেন্স চলে গেলে পড়ে যাবে।’ এও বললেন, ‘শুধু পড়ে গেলেই হবে না। বেকায়দায় পড়লে তো লেগে যেতে পারে। সেটা আগে থেকে জেনে রাখবে, দেখে রাখবে। যে মুহূর্তে পড়বে একটা হাত দিয়ে মুখটা গার্ড করে নেবে।’ মুখে না লেগে যায়, তার জন্য এই ব্যবস্থা। কোমরটা কোথায় লাগবে, সেই পজিশনটাও আগে থেকে দেখে নিতে হবে। পড়ে গেলাম, আর মাথা ফাটল তা করে তো লাভ নেই।’ আমার কৌতূহলের সুন্দর উত্তর পেয়ে গেলাম। এই হলেন উত্তমকুমার। আমার উত্তমদা। এই সব টেকনিক্যাল ব্যাপার বুঝিয়ে দিতেন সুন্দর করে।
বরাবর ‘উত্তমদা’ বলেই সম্বোধন করতাম ওঁকে। আমাকে প্রথম প্রথম আপনি বলতেন উনি। আমি বলেছিলাম, ‘একদম আপনি বলবেন না। আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। প্লিজ তুমি করে কথা বলবেন।’ ওঁর অভ্যেস ছিল সকলকে ‘আপনি’ সম্বোধন করার। তারপর অনুরোধ করে তুমিতে নামানো হয়েছিল। আমি যেহেতু সে সময় নতুন এবং কাজ না শিখে অভিনয়ে ঢুকেছিলাম, ফলে যখনই ওঁর শট থাকত, আমি দেখতাম। ধরুন, আমার শট নেই, ওঁরই আছে। আমি ফ্লোরে ওঁর কাজ দেখবার জন্য বসে থাকতাম। ওঁদের কাজ দেখে দেখেই আমাকে শিখতে হয়েছে। কারণ আমার কোনও ট্রেনিং ছিল না। কিছু জানতে চাইলে অবশ্যই বলে দিতেন। এমনিতে দেখে বলতেন, সব ঠিকই আছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দিতেন। জিজ্ঞেস না করলে গায়ে পড়ে কিচ্ছু বলতেন না।
আমার এখনও মনে আছে একটা জায়গা ছিল ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে— একটা হাসি। উনি আমাকে একটা হাসি দেখিয়েছিলেন। হাসি তো অনেক রকমের হয়। কিন্তু একজনকে খোঁচা মেরে কেমনভাবে হাসতে হয়, সেটা উনিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যেমনভাবে আমি ভেবেছিলাম, তেমনভাবে না করে উনি যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আমি শটে সেভাবে হেসেছিলাম। সেটা দারুণ হয়েছিল। ফলে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিতেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অভিনেতা হিসেবে ভীষণ কো-অপারেটিভ ছিলেন উত্তমকুমার। ওঁর সঙ্গে তো আমি গোটা পাঁচেক ছবিতে অভিনয় করেছি। প্রথম ছবি করেছিলাম ‘মৌচাক’। ৪৫ বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয় সে ছবি। এখনও টিভিতে দিলে দর্শক দেখতে বসে যান। ওই সময় উনি অত জনপ্রিয় নায়ক, আর আমি তখন সবে নতুন। নিউকামার যাকে বলে। ওঁর সঙ্গে পার্ট করব বলে একটু ঘাবড়ে ছিলাম। কিন্তু উনি এত ভালো ব্যবহার করে আমাকে এত সহজ করে দিলেন, আপন দাদা-ভাইয়ের যেমন সম্পর্ক হয়, তেমন আচরণ করলেন। মনে জোর এনে দিলেন। এমন সুন্দরভাবে হল সবটা যে তারপর ওঁর সঙ্গে অভিনয় করাটা আমার কাছে অনেক সহজ হয়ে গেল। এমন উদার মানসিকতা ছিল ওঁর।
একটা চরিত্র কীভাবে তুলতে হয়, অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী যাতে সমানভাবে নিজের অংশ ফুটিয়ে তুলতে পারেন, ঠিকমতো রিঅ্যাকশন দিতে পারেন— সে সব জায়গায় অসম্ভব সাহায্য করতেন। ওঁর নিজের পারফরম্যান্স ওই পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সাহায্য করতেন। আর ছিল সাংঘাতিক ডেডিকেশন। উনি উত্তমকুমার হয়েছেন একাগ্রতা, নিষ্ঠার জন্য। কখনও নিজের পার্টে খুশি হতেন না। আমি অন্তত ওঁকে নিজের অভিনয় দেখে খুশি হতে দেখিনি। ১০০-র মধ্যে ১০০ খুশি হয়ে গেলেন শট দিয়ে সেটা ওঁর মধ্যে ছিল না। আরও একটা বিষয়ে আমাদের লজ্জায় ফেলে দিতেন। উনি অত বড় অভিনেতা হয়েও একটা শট দেওয়ার পর পরিচালককে তো বটেই সহশিল্পীদেরও জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী রে, ঠিক লাগল তো?’ আমাকে যখন জিজ্ঞেস করতেন, তখন প্রচণ্ড লজ্জা লাগত। উত্তমকুমার শট দিচ্ছেন, আর আমি তার ভুল-ঠিক বিচার করব! আসলে এই খুঁতখুঁতেমিই তাঁকে উত্তমকুমার তৈরি করেছিল। কখনও রেগে যেতে দেখিনি ওঁকে। ফ্লোরে তো আউট অব কোয়েশ্চেন। ভীষণ যত্ন করে অভিনয় করতেন। ক্যাজুয়ালি অভিনয় করে দিলেন, তা নয়। অভিনয়ের পিছনে যে ভাবনাচিন্তাগুলো ছিল, সেগুলো খুব সিরিয়াসলি ভেবে রাখতেন।
ফ্লোরে যখন আলো হতো, তখন এটা ওটা গল্প করতেন। কী কী ছবি করছি না করছি, জানতে চাইতেন। পিনাকী মুখোপাধ্যায় একটা ছবি করেছিলেন, ‘প্রতিশ্রুতি’। পিনাকীদার সঙ্গে উত্তমদা অনেকগুলো ছবি করেছিলেন। ‘প্রতিশ্রুতি’ দেখার জন্য উনি উত্তমদাকে ডেকেছিলেন। ছবিটা দেখার পর আমার পিঠে হাত রেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন। নতুন হিসেবে ভালো অভিনয় হয়েছে বলেছিলেন। আর পরিচালককে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটির দিকে নজর রাখবেন। এর মধ্যে সাংঘাতিক সম্ভাবনা রয়েছে।’ সেটা পিনাকীদা আমাকে পরে বলেছিলেন।
শিল্পী হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। হিরো বলতে যা বোঝায় উনি ছিলেন তাই। বাংলার অল টাইম বেস্ট হিরো উনিই। উত্তমকুমারই বাঙালির একমাত্র ম্যাটিনি আইডল। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নন, মানুষ হিসেবেও ছিলেন একইভাবে ভালো। সকলের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন। সহকর্মীদের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকতেন। আর যে কোনও মানুষকেই ন্যায্য সম্মান দিতেন। উত্তমদার বিকল্প হবে না।