উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
এই ঘটনার সমালোচনা করে ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘The Brahmo Public Opinion’ পত্রিকার সম্পাদক ভুবনমোহন দাস (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা) ১৮৮৩ সালের ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় বেশ খানিকটা লেখেন। এরপর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা ‘The Bengalee’তে এর পাঁচদিন পর ২৪ এপ্রিল ভুবনমোহন দাসের লেখার প্রেক্ষিতে আরও কিছু লেখেন। ফলে এই শালগ্রাম বিষয়ক লেখা থামল না। ভুবনমোহন দাস ওই একই বিষয়ে আবার লিখলেন ২৬ এপ্রিল তাঁর পত্রিকায়। এরপর সুরেন্দ্রনাথও পবিত্র শালগ্রাম শিলাকে কোর্ট চত্বরে আনার ঘটনাকে তীব্র সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লিখলেন ২৮ এপ্রিলের সংখ্যায়। যার অংশবিশেষ হল, ‘What are we to think of Judge who is so ignorant of the feeling of the people and so disrcspectful of their cherished conviction, as to drag into court and then to inspect, an object of worship which only Brahmins are allowed to approach?’ আর এই মন্তব্যেই শুরু হয়ে গেল আদালত অবমাননার মামলা। ২ মে, ১৮৮৩ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ‘The Bengalee’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুদ্রাকার-প্রকাশক রামকুমার দে’র নামে রুল জারি করার নির্দেশ দিল এবং পরের দিন তা কার্যে পরিণত হল। বলা হল— ‘আদালত অবমাননা করার অপরাধে কেন জেলে যাইবেন না, তাহার কারণ প্রদর্শন করুন।’
এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। বেশ কিছু মিটিং-মিছিল সংগঠিত হল। স্টার থিয়েটারের সভাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সুরেন্দ্রনাথের জীবনীকার সূর্যকুমার ঘোষাল লিখছেন—‘অভিযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ও রামকুমার দে’র সম্বন্ধে কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য স্থিরীকরণের নিমিত্ত ৩রা মে বৃহস্পতিবার সুরেন্দ্রনাথের সুহৃদমিলনরূপ পরামর্শ-সভা বসিল। আনন্দমোহন বসু, মনোমোহন ঘোষ, শ্রীযুক্ত মন্মথনাথ মল্লিক, শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিত, এই চারিজন বিশিষ্ট আইনাভিজ্ঞ পণ্ডিত তালতলার বেঙ্গলি অফিসে সম্মিলিত হইলেন।’
তখনকার দিনে নামকরা সাহেব ব্যারিস্টার জ্যাকসন সাহেব, গ্রিফিত এভানস্ সাহেব, ট্রিভিলিয়ান সাহেব, রবার্ট এ্যালেন সাহেবদের কাছে আর্জি জানানো হল সুরেন্দ্রনাথের পক্ষে দাঁড়াতে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এঁরা কেউই রাজি হলেন না। অবশেষে সুরেন্দ্রনাথের পক্ষে দাঁড়ালেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গণেশচন্দ্র চন্দ্র (ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রর ঠাকুর্দার বাবা)।
৩ মে, রাতটা সুরেন্দ্রনাথ ও রামকুমার দে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের খিদিরপুরের বাড়িতে কাটালেন। সেখানেই মামলাটি নিয়ে গভীর আলাপ-আলোচনাও হল। ৪ মে, সকলেই হাইকোর্টে হাজির হলেন। এই মামলায় ছিলেন পাঁচজন বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি রিচার্ড গার্থ, আর অন্যেরা হলেন, ম্যাকডোনেল সাহেব, কানিংহ্যাম সাহেব, নরিস সাহেব এবং রমেশচন্দ্র মিত্র। সরকারের পক্ষে দাঁড়ালেন ব্যারিস্টার চার্লস, পল এবং টিয়াপকার সাহেব।
রামকুমার দে বললেন, ‘আমি ইংরেজি লেখাপড়া জানি না; সম্পাদকের দায়িত্বে ও আদেশে ছাপার কার্য্য করিয়া থাকি।’
সুরেন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমারই আদেশে রামকুমার দে কার্য্য করিয়া থাকে। অতএব উহার দায়িত্বের জন্য আমিই সম্পূর্ণ দায়ী... আমি আমার কৃত সমালোচনা অকপটে প্রত্যাহারপূর্ব্বক আদালতের নিকট ভ্রান্তিদোষ স্বীকার করিতেছি এবং তজ্জনিত দণ্ডবিধান হইতে নিষ্কৃতি চাহিতেছি।’ সেদিনের মতো মামলা মুলতুবি রইল।
৫ মে, শনিবার রায় দানের দিন। এদিন আদালত চত্বরে লোকে লোকারণ্য। কোর্টের বাইরেও হাজার হাজার মানুষ, বহু ছাত্র এসেছেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালের স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি তখন বিএ ক্লাসের ছাত্র। এমনকী পাইকপাড়ার ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ এক লক্ষ টাকা নিয়ে আদালতে উপস্থিত, উদ্দেশ্য— যদি সুরেন্দ্রনাথের জরিমানা হয়, তাহলে টাকাটা তিনিই দিয়ে দেবেন।
রায়ে রামকুমার দে মুক্তি পেলেন, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের দু’মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হল। পাঁচ বিচারপতির মধ্যে চারজন ইংরেজ বিচারপতি যখন কারাদণ্ডের পক্ষে মত দিলেন, তখন একমাত্র ভারতীয় বিচারপতি রমেশচন্দ্র মিত্র বলেছিলেন—আসামীর শুধুমাত্র জরিমানা করলেই আইনের উদ্দেশ্য সাধিত হবে। না, তাঁর কথা শোনা হয়নি, বরং তাঁকে কারাবাসের পক্ষেই মত প্রকাশ করতে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি রাজি হননি।
সুতরাং সুরেন্দ্রনাথের জেল হয়ে গেল। আদালতের বাইরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল জনতা। সুরেন্দ্রনাথ গেলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। উল্লেখ করতেই হবে— সাহেবদের পত্রিকা ‘The Statesman’ কিন্তু এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিল। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও কালো ফিতে ধারণ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ‘The Indian Mirror’ সহ বহু সংবাদপত্র সুরেন্দ্রনাথের পাশে ছিল। সমগ্র ভারত জুড়ে অসংখ্য মিটিং মিছিল হয়েছিল।
সুরেন্দ্রনাথের কারামুক্তি ঘটে ৪ জুলাই, ১৮৮৩ সালে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৯২৫ সালে স্মৃতিচারণ করলেন—‘সেকালে সুরেন্দ্রনাথ কিরূপ লোকপ্রিয় ছিলেন, তাঁহার মুক্তির সময় আবার পরিচয় পাওয়া যায়। যেদিন তাঁর খালাস পাইবার কথা, সেই দিন অতি প্রত্যুষে হাজার হাজার লোক প্রেসিডেন্সি জেলের অভিমুখে যাত্রা করে। উহা তখন হরিণবাড়ি জেল নামে অভিহিত ছিল। এখন গড়ের মাঠে যেখানে ভিক্টোরিয়া স্মৃতি মন্দির অবস্থিত, উহা তাহার নিকট ছিল। সেদিন শেষ রাত্রি হইতে মুষলধারে বৃষ্টি হইতে থাকে। আমরা ভিজিতে ভিজিতে জেলের ফটকের নিকট পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ পরে জানিতে পারিলাম যে, তাঁহাকে রাত্রি থাকিতেই মুক্তি দিয়া গাড়ি করিয়া তালতলায় তাঁহার পৈতৃক বাটিতে পৌঁছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। তখন আবার জনতা তালতলা অভিমুখে রওনা হইল। সেখানে গিয়া দেখিলাম, সুরেন্দ্রনাথের গৃহ জনাকীর্ণ, আর স্থান নাই; তাঁহার বন্ধু আনন্দমোহন বসু মহাশয় বক্তৃতা করিতেছেন।’
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সাংবাদিক রামগোপাল সান্যাল মশাই ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই ‘A General Biography of Bengal Celebrities’-এ সুরেন্দ্রনাথের কারামুক্তির দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন— ‘চার জুলাই তাঁকে (সুরেন্দ্রনাথ) অভিনব উপায়ে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল কর্তৃপক্ষ জানতেন যে, তাঁর সম্মানে বিরাট জনপ্রিয় সমাবেশ হবে, তাই তাঁকে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক নজিরবিহীন, পথ অবলম্বন করলেন। জেলার সাহেব তাঁকে ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে তুলে দিলেন এবং একটি হ্যাকনি গাড়িতে চাপিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে চালাবার নির্দেশ দিলেন, কেন না জেলার সাহেব জানতেন এই রাস্তায় জনসাধারণ জমায়েত হবেন না। আর এইভাবেই তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।’ (বঙ্গানুবাদ)
সূর্য্যকুমার ঘোষাল লিখছেন—‘সুরেন্দ্রনাথ যদিও গর্ভধারিণীর নিকট তালতলায় থাকিতেন না, কিন্তু প্রতিদিনই প্রায় জননীর সহিত সাক্ষাৎ করিতেন... কারামুক্ত সুরেন্দ্রনাথ জননীকে প্রণামাদি করিয়া, সমাগত বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতিকে যথোপযুক্ত অভিবাদন করিলেন। তৎপরে জানিতে পারিলেন যে, জেলের নিকট অসংখ্য লোক তাঁহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছেন। কাজেই আবার তিনি জেলখানার নিকট গমন করিলেন। সুরেন্দ্রনাথকে পাইয়া সকলে আনন্দ সহকারে তাঁহাকে পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করিলেন। অনন্তর সকলেই তাঁহার সহিত তালতলায় আসিলেন। বেলা দশটার সময় সুরেন্দ্রনাথ সকলকে আদর আপ্যায়ণে ও বন্ধুবান্ধবগণকে প্রীতিভোজে পরিতুষ্ট করিলেন।’
সুরেন্দ্রনাথের এই কারাবাসের পরবর্তীকালে সুদূরপ্রসারী ফল হয়েছিল। জাতীয় সংহতি এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষে ইন্ধন জুগিয়েছিল সমগ্র ভারতেই। পথ প্রশস্ত হয়েছিল ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’ এবং ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠারও।
স্কেচ লেখক