সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
গাড়োয়াল ও কুমায়ুন হিমালয়ের শুভ্রশিখরের দু’টি পালক। গাড়োয়াল যেমন সৌন্দর্যের সঙ্গে দেবত্ব, বিশালত্ব ও মহানুভবতার মূর্তি, উপর দিকে মোহময়ী পর্বতশৃঙ্গে আবৃত কুমায়ুন— হিমালয়ের এক অপরূপ সুন্দর রূপকথার দেশ।
কুমায়ুন হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার প্রতিটি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। আঁকাবাঁকা নিস্তব্ধ পাহাড়ি পথে শোনা যায় শুধু বাতাসের গান আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝরনার কলকল লাজুক শব্দ। প্রতিটি বাঁকের অধরা মাধুরী আনমনে নিয়ে চলে এক রূপকথার দেশে। তুষারকিরীট হিমালয়, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি, পাখির কাকলি ও সরল এক গ্রাম্যজীবন নিয়েই কুমায়ুনের দেশ ।
কুমায়ুনের প্রবেশদ্বার কাঠগোদাম থেকেই সাধারণত কুমায়ুন ভ্রমণের সূচনা হয় এবং সেখান থেকে গাড়ির পথে আলমোড়া, বাগেশ্বর, থল, বিরথি হয়ে মুন্সিয়ারি। দ্বিতীয় পথটি টনকপুর থেকে গাড়ি পথে লোহাঘাট হয়ে পিথোরাগড় ও তারপর একইভাবে থল বিরথি হয়ে মুন্সিয়ারি। দুটো পথই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। আমাদের কুমায়ুন ভ্রমণের প্রধান গন্তব্য ছিল শৈবতীর্থ পাতাল ভুবনেশ্বর। হাওড়া থেকে বাঘ এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম পৌঁছে ওখান থেকে গাড়িতে আসি পৃথিবীর বিখ্যাত হ্রদের শহর নৈনিতাল। শহরের বুকেই পান্না সবুজ নৈনিলেক, হ্রদের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের কত নৌকা, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। হ্রদের পাশেই নয়না দেবীর মন্দির, সন্ধ্যা হতেই আরতির ধ্বনিতে মুখরিত হল ছোট্ট হ্রদের শহর। জোনাকি পোকার মতো জ্বলে উঠল পাহাড়ের কোলে বাড়িঘর, শহরে যেন তখন এক অন্য দীপাবলি।
নৈনিতালে দু’রাত কাটিয়ে পা বাড়াই আলমোড়া হয়ে ১২০ কিমি দূরত্বে বিনসরে। নৈনিতাল থেকে বিনসরের পথটি অসাধারণ সুন্দর, পথের দু’ধারে কোথাও সবুজে জড়ানো প্রান্তর, কোথাও ঘন সবুজ বনবীথির ঘেরাটোপ, কোথাও আবার সমুন্নত পাহাড়শ্রেণির বুকে সযত্নে আগলে রাখা আকাশছোঁয়া পাইনের সারি। প্রকৃতি যেন তার নিজের মায়াজালে নিজেই নিশ্চুপ।
জনবসতিহীন জঙ্গলে এগারো কিমি পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম কেএমভিএন-এর (কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগম) বিনসরের আবাসনে, সূর্য তখন পশ্চিম গগনে, পাইনের ঘন পাতার আড়ালে শেষ বিকেলের রক্তিম আলোয় লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত। বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত গভীর জঙ্গলে ঘেরা পর্যটক আবাস থেকে হিমালয়ের শোভা দেখার জন্য বিনসরের মতো জায়গা আর দ্বিতীয়টি আছে কি না আমার সন্দেহ আছে। রাতে ঘন জঙ্গলে আবৃত বিনসরের আবাসনে এক রাত কাটানোর স্মরণীয় অভিজ্ঞতা বহুদিন মনে থাকবে। পরদিন ভোর হতেই বেরিয়ে পড়লাম প্রায় ৬৫ কিমি দূরত্বে অবস্থিত কুমায়ুনের গুহামন্দির পাতাল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে। বিনসর থেকে চৌকারি যাওয়ার পথে উদিয়ারি বেন্ড-এর কিছু পূর্বে বাঁ হাতের রাস্তায় বাঁক নিতেই শুরু হল গুহামন্দিরের পথ। পাহাড়কোলে ১৩৫০ মিটার উচ্চতায় পাতাল ভুবনেশ্বরের চারপাশে ঘিরে আছে সবুজ পাহাড় ও নিস্তব্ধতা। দূর পাহাড়ের ফাঁকে বইছে রামগঙ্গা নদী। চারদিক দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গুহা মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। কুমায়ুনের এই পবিত্র ও প্রসিদ্ধ শৈবতীর্থে ৩৩ কোটি দেবতার বাস। প্রচলিত বিশ্বাস, বনবাসকালে পঞ্চপাণ্ডবও থেকেছেন এখানে। সূর্যবংশীয় রাজা ঋতুপর্ণ এই গুহার আবিষ্কারক। গুহার ভিতরে চুনাপাথরের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক অপরূপ ভাস্কর্য। গুহামন্দিরের পাহাড়টা যেন ফণা তোলা সর্প, দু’তিন ফুটের সরু প্রবেশপথ গভীরে নেমে গিয়েছে। অন্ধকার এই গুহাপথে কখনও শিকল ধরে কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখি এক আশ্চর্য জগত। এই গুহামন্দিরের প্রধান দেবতা এক প্রাচীন শিবলিঙ্গ যার ক্রমবর্ধমান গতি পৃথিবী তথা কলিযুগের শেষ রচনা করবে। গুহামন্দিরে পাহাড়ের গায়ে অলৌকিকভাবে সৃষ্ট কেদারনাথ, বদ্রীনাথ ও অমরনাথ, কালভৈরবের জিহ্বা, ঐরাবত ও ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বাসুকীনাথ। এখানে দর্শন মেলে বিষ্ণুর বাহন গরুড়, কামধেনু, জন্মেজয়ের সর্পমেধ যজ্ঞের প্রতিমূর্তি ।
অন্ধকার গুহাপথের পিছল সিঁড়ি ও প্রায় ১৬০ মিটার গভীরে অক্সিজেনের অভাব থাকায় অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রবেশ করতে পারেন না। তাই গুহামন্দির থেকে বেরিয়ে নিজেকে যেন মনে হচ্ছিল শৃঙ্গজয়ী। মন্দিরের ভিতর ক্যামেরা, মোবাইল নিষেধ, তাই ভিতরকার ছবি মনেই রইল।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে এবার চলেছি চৌকারির পথে, গাড়ির জানালা দিয়ে আসা হিমেল বাতাস যেন হঠাৎই পেল শীতের তীব্রতা, দেখতে পেলাম সবুজে মোড়া কুমায়ুনের আদিবাসী গ্রাম একে একে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বাঁকে, পাইন, চির, দেবদারু সব কেমন হু হু করে পিছনে ছুটে পালাচ্ছে! পিছন ফিরে মনে হল ওরা যেন উদাস নয়নে বলছে ‘আবার এসো।’
কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে বাঘ এক্সপ্রেসে কাঠগোদাম। লালকুয়া এক্সপ্রেস প্রতি শুক্রবার হাওড়া থেকে পরদিন পৌঁছয় লালকুয়া। সেখান থেকে গাড়িতে আসা যায় নৈনিতাল।