সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
সেন্ট জনস ইন দ্য উইল্ডনেস গির্জায় ঘুরতে এসেছিলাম হিমাচলপ্রদেশের ম্যাকলয়েডগঞ্জ পৌঁছনোর দ্বিতীয় দিন সকালে। প্রথম দিন ডালহৌসির কয়েকটা দর্শনীয় জায়গা ঘুরে দেখতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তাই পরের দিন সকালে প্রথমেই গিয়েছিলাম ধরমশালার বিখ্যাত ‘ডাল লেক’ দেখতে। এই লেক কিন্তু কাশ্মীরের ডাল লেকের মতো একদমই নয়। খুবই ছোট আর ঘোলা জলে ভর্তি একটা বড় পুকুর মনে হল দেখে। মন ভালো করতে একটু অন্য কিছু দেখা দরকার। আর সেই তাগিদেই রওনা হলাম ম্যাকলয়েডগঞ্জের ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত পুরনো গির্জা দেখতে। গির্জার চারপাশের এলাকা ঘন দেবদারু গাছের জঙ্গলে ভরা। এই কারণেই নাকি এই গির্জাকে ‘সেন্ট জনস ইন দ্য উইল্ডারনেস’ বলা হয়। গির্জাটি ১৮৫২ সালে স্থাপিত হয়েছিল। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে সড়কপথে এই গির্জা মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এই গির্জা খোলা থাকে। লোকে বলে এই গির্জা নাকি ‘হন্টেড’ অর্থাৎ ভুতুড়ে!
ভেতরে ঢুকতেই নজর কাড়ল গির্জার অপূর্ব স্থাপত্য শিল্পের কারুকার্য। গির্জার দেওয়াল তৈরি হয়েছে মোটা মোটা পাথরের খণ্ড দিয়ে। পুরনো আমলের কাঠের তৈরি ছাদ এমনভাবে গড়া, যাতে বৃষ্টির জল কোনওভাবেই ছাদে না জমে। গির্জার ভিতরের ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলি মোটা মোটা কাঠের লগ দিয়ে ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিম দেওয়া হয়েছে। মেঝে জুড়ে মোটা লাল কার্পেট পাতা। পায়ের আওয়াজ হচ্ছে না চলার সময়। ঘরের দু’-পাশে কাঠের তৈরি প্রার্থনা বেঞ্চ। ইংরেজিতে এগুলোকে বলে ‘পিউ’। যাঁরা প্রার্থনা করতে আসেন তাঁরা এখানে বসে যিশুর কাছে মনের কথা জানান। আমাদের চোখ টানল গির্জার দেওয়ালে কাচ দিয়ে তৈরি প্রভু যিশুর প্রতিকৃতি। কাচের পিছনে দিনের সূর্যের আলো এসে পড়ায় সেই রঙিন কাচের প্রতিকৃতি জ্বলজ্বল করছে। ঘরের উঁচু ছাদ থেকে ঝুলছে বাহারি সব আলো। গির্জার ভিতরে আরও কয়েকটি জানালাও একই রকমের রঙিন কাচের টুকরো দিয়ে তৈরি। সেখানে রয়েছে যিশুর জীবনের নানা দৃশ্যের ঘটনাবলি, মা মেরির ছবি।
প্রভু যিশুর রঙিন প্রতিকৃতির ঠিক আগেই কাঠের রেলিং লাগানো। যিশুর পাদদেশ পর্যন্ত প্রার্থনাকারীদের পৌঁছনোর উপায় নেই। এই কাঠে ঘেরা রেলিংয়ের একধারে রয়েছে কনফেশন বক্স। গির্জার পুরোহিতের (ফাদার) সাহায্যে যিশুর কাছে নিজের অন্যায় স্বীকার করার ঘর। খ্রিস্টানরা প্রভুর কাছে এইভাবেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। গির্জার অন্যপাশে রাখা রয়েছে কাঠের তৈরি দুটো টেবিল। লাল রঙের কাপড় দিয়ে সেই টেবিল ঢাকা। তার উপরে কয়েকটি পাত্র। একটি কাঠের তৈরি একফুট উঁচু প্রভু যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি। চারপাশে বিরাজ করছে অখণ্ড নীরবতা। অসম্ভব শান্তিতে ভরে যাচ্ছে আমাদের মন। বেশ কিছুক্ষণ এই গির্জার ভিতরে প্রার্থনা করার বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দিলাম। আমি আলাদা করে ঈশ্বরপ্রেমী নই, তবু মনে এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে গির্জা ঘরের বাইরে এলাম। বাইরে এসে চোখে পড়ল গির্জার আশপাশের গাছগুলিতে ঝোলানো রয়েছে পাখিদের থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর। বার্ড হাউস।
এবার আমরা গির্জার আশপাশের এলাকা একটু ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। আমাদের মতো অনেক বাঙালি পর্যটক ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন এই গির্জায়। তাঁরাও ঘুরছেন, গির্জা ঘরের ভিতরেও যাচ্ছেন। সবাই কিন্তু চুপচাপ। কারও মুখে কথা নেই। বাঙালির স্বভাবসিদ্ধ কলরব কোথাও শোনা যাচ্ছে না। সাধারণত বাঙালি পর্যটকদের উচ্চস্বরে কথায় যে কোনও জায়গা ভরে থাকে। এখানে দেখলাম বাঙালি ট্যুরিস্টরা নিজেদের স্বভাবকে দূরে সরিয়ে অদ্ভুত এক নীরবতা পালন করে চলেছেন। গির্জার পরিবেশই বোধহয় তাঁদের দিয়ে এই আচরণ করিয়ে নিচ্ছে।
গির্জার পিছনদিকে যখন এলাম, চোখে পড়ল একটি পাথরের তৈরি লম্বা স্মারকস্তম্ভ। সাদা পাথরের তৈরি। তার চারপাশে লোহার রেলিং লাগানো। এই স্মারকস্তম্ভের পরেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছে দেবদারু গাছের ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের নিবিড় পরিবেশকে আরও মনোরম করে তুলেছে গির্জাটি। ম্যাকলয়েডগঞ্জে এসে যা না দেখলে এখানকার পরিবেশের খানিক অংশ অদেখাই থেকে যেত। যাই হোক, ধরমশালায় তখনও অনেক দ্রষ্টব্য দেখা বাকি রয়েছে। তাই আর দেরি না করে এই পুরনো গির্জাকে পিছনে ফেলে ফিরে এলাম ধরমশালায়।
কীভাবে যাবেন: পাঞ্জাব থেকে সড়কপথে যাওয়া যায় ধরমশালায়। এছাড়া ধরমশালায় এয়ারপোর্টও রয়েছে। সরাসরি ফ্লাইটেও যেতে পারেন। ধরমশালায় নানা মান ও দামের হোটেল রয়েছে থাকার জন্য।