সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগে সস্ত্রীক এক গ্রুপ ট্যুরে ইউরোপ ঘুরছি। লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস, আইন্ডহোভেন হয়ে নেদারল্যান্ডস-এর রাজধানী পৌঁছলাম। পরদিন আমস্টারডামের কিছু আইকনিক ল্যান্ডমার্ক দেখে আমরা ক্যানাল ক্রুজে এলাম। সে ছিল এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। খুব সুন্দর এক বোটে আমস্টারডামের বিভিন্ন রূপ দেখছি। ইংলিশ ও ডাচ কমেন্ট্রি চলছে জায়গাগুলো চিনিয়ে দেওয়ার জন্য। এক সময় ডানদিকে দেখতে পেলাম অ্যান ফ্র্যাঙ্ক হাউস। নামটি শুনেই মনে পড়ে গেল অনেক কিছু। এবছর তার ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অ্যান ফ্র্যাঙ্কের নামটি আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল পৃথিবী জুড়ে।
পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯, পোল্যান্ড আক্রমণ করে অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলেন। বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর লেখালিখি ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু হিটলারের এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার পিছনে লুকিয়ে ছিল ‘গ্রেট ডিক্টেটর’-এর কৈশোরের কিছু ঘটনা। তখন হিটলার বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ এক যুবক যিনি আঁকতে ভালবাসেন। পোস্টকার্ড পেন্টিং ও বিজ্ঞাপনের কাজ করে রোজগার করেন। বিখ্যাত জার্মান জিওগ্রাফার ফ্রেডরিশ রাৎজেল হয়তো হিটলারকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিলেন বলে মনে করা হয়। রাৎজেল এমন এক তাত্ত্বিক ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, যেটা ছিল ভয়ানক। তিনি বলেছিলেন, দেশ বা রাষ্ট্র হল একটি জীব বা প্রাণীর মতো। প্রাণীকে বাঁচতে হলে যেমন খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়, তেমনই বহরে বাড়তে হলে বড় রাষ্ট্রগুলোকেও ছোট ছোট দখল করতে হবে। হিটলার শুধুমাত্র ইউরোপের দেশগুলো দখল করতে চেয়েছিলেন ভাবলে ভুল হবে। আসল উদ্দেশ্য ছিল ইহুদি জাতির বিনাশ। আর তাই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে ছ’কোটি ইহুদিকে নিকেশ করা হয়েছিল।
ফিরে আসি অ্যান ফ্র্যাঙ্কের কথায়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ জন্ম। আদতে সেও এক ইহুদি কিশোরী। জন্ম ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ হলেও অ্যানের ১৫ বছর বয়সের বেশিরভাগই কেটেছে আমস্টারডামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে অ্যানের বাবা ওটো ফ্র্যাঙ্ক জার্মানি ছেড়ে একদিন চলে এলেন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে। নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ওটো ফ্রাঙ্ক আমস্টারডামে এসে ব্যবসা করতে শুরু করলেন। অ্যানের জার্মান নাগরিকত্ব চলে যায়। ডাচরা নিরপেক্ষ থাকা সত্ত্বেও নাৎসি বাহিনী ১৯৪০ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস আক্রমণ করে বসল। শুরু হল কমবয়সি ডাচ ইহুদী যুবকদের ধরপাকড় ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে চালান। অত্যাচারের কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু ইহুদিরাই। ভয়ের বাতাবরণে দিন কাটছে সবার। এরই মধ্যে অ্যান তার ১৩ তম জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে উপহার হিসেবে একটা ডায়েরি পেল। কিশোরী ডায়েরিটির নাম রাখল, ‘কিটি’। ডায়েরিতে শুরু হল তার রোজনামচা লেখা। মেয়েটির জানা ছিল না, সেই ডায়েরি একদিন বই হিসেবে প্রকাশিত হবে। আর সেটি সর্বাধিক পঠিত বই হিসেবে জায়গা করে নেবে ইতিহাসের পাতায়।
নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে ওটো ফ্র্যাঙ্কের পরিবার বিজনেস কমপ্লেক্সের গুদামের গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেয়। ফ্রাঙ্ক পরিবার ও আরও চার ডাচ ইহুদিকে মিয়েপ গিয়েস নামে এক অস্ট্রিয়ান মহিলা ওই গোপন কুঠুরিতে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেটা ছিল ১৯৪২-এর ৫ জুলাই। মিয়েপ গিয়েস ছিলেন ওটো ফ্র্যাঙ্কের সহকারী।
তবে ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের এই অজ্ঞাতবাস আর গোপন রইল না। এক ইনফরমার নাৎসি বাহিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল গোপন বাসস্থানের খবর। গেস্টাপো (নাৎসি জার্মানির গোপন পুলিস) এই আস্তানায় হানা দেয়। পুরো পরিবারকে ধরে নিয়ে যায় তারা। ঘটনাচক্রে অস্ট্রিয়ান সেই মহিলা গোপন কুঠুরিতে ফিরে এসেছিলেন পরে। ফেলে যাওয়া ব্যক্তিগত কোনও জিনিসের সন্ধানে । সেখানে মেঝেতে ছড়ানো-ছেটানো পড়ে থাকা অনেক জিনিসের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন অ্যানের সেই নোটবই। মিয়েপ গিয়েস ডায়েরিটি ডেস্কের ড্রয়ারে সযত্নে রেখে দিলেন এই আশায় যে ফ্র্যাঙ্করা ফিরে এলে ডায়েরিটি তুলে দেবেন তাঁদের হাতে।
অ্যান ও তার বড় বোন মার্গটকে জার্মানির বেরগেন বেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওটো ও তাঁর স্ত্রী এডিথ-এর ঠাঁই হয় পোল্যান্ডের কুখ্যাত আউশউইৎজ ক্যাম্পে। ব্যারাকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান এডিথ। ১৯৪৫-এর ৩ জুন যুদ্ধশেষে ওটো আমস্টারডামে ফিরে এলে মিয়েপ গিয়েস ওঁর হাতে অ্যানের ডায়েরিটি তুলে দেন। ১৯৪৭ সালে ডাচ ভাষায় ডায়েরিটি ‘হেট একটেরহাইস’ (দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স) নামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। ডায়েরিতে ওই সময়কার নাৎসি বাহিনীর নারকীয় অত্যাচারের কথা লিপিবদ্ধ করেছিল এই কিশোরী। এরপর ওটো ডায়েরিটি আমেরিকা থেকে ইংরেজিতে প্রকাশের চেষ্টা করেন। যদিও প্রকাশকরা পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন, শেষপর্যন্ত আমেরিকার ‘ডাবল ডে’ নামে এক প্রকাশক বইটি বের করতে রাজি হয়। ১৯৫২ সালে ডায়েরিটি ‘হেট একটেরহাইস’ বা ‘ডায়েরি অব অ্যান ইয়ং গার্ল’ হিসেবে প্রকাশিত হয়, আলোড়ন পড়ে যায় পৃথিবী জুড়ে। বেস্টসেলার হতে সময় লাগেনি। ৭০টির ও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
মিত্রপক্ষের আমেরিকান সৈন্যরা জার্মানির বেরগেন বেলসেন ক্যাম্প দখল নেওয়ার মাত্র দু’সপ্তাহ আগে ১৫ বছর বয়সে টাইফাসে ভুগে মারা যায় অ্যান। দুই বোন ওখানেই গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত।