সপরিবারে অদূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে আনন্দলাভ। কাজকর্মে কমবেশি ভালো। সাহিত্যচর্চায় আনন্দ। ... বিশদ
মশ সরছে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর্দা। দত্তক সন্তান নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে সমাজে। অথচ একটা সময় ছিল যখন কোনও দম্পতি সন্তান দত্তক নিয়েছেন শোনা গেলে ভ্রু-কুঞ্চিত হতো। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। অনেক দম্পতিই বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় অর্থ ও সময় ব্যয়ের বদলে দত্তক নেওয়ার দিকে এগচ্ছেন। কিন্তু চাইলেই কি দত্তক নেওয়া যায়? উত্তর এক কথায়, না। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। সেই আইন না জেনেই দত্তক গ্রহণের পথে এগলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। সম্প্রতি নিজের গর্ভজাত সন্তানকেও দত্তক নিতে হাইকোর্টে ছুটতে হয়েছিল এক মহিলাকে। ফলে আইনের মারপ্যাঁচ মাথায় রাখতে হবে। দত্তক গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে বিষয় অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। দত্তকের আইনকানুন নিয়ে বিস্তারিত জানালেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহ রায়।
কারা সন্তান দত্তক নিতে পারবেন?
দত্তক নিতে উৎসাহী বাবা-মাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হতে হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকেও হতে হবে স্থিতিশীল। কোনও মারণব্যাধি বা রোগে আক্রান্ত হলে দত্তক নেওয়া যাবে না। ভারতীয় নাগরিক, প্রবাসী ভারতীয় ও অন্য দেশের নাগরিকরাও ভারত থেকে শিশু দত্তক নিতে পারবেন। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে পৃথক নিয়ম রয়েছে। আইন অনুযায়ী, বিবাহিত দম্পতিরা বিয়ের দুই বছর পর থেকে দত্তক নেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এবং দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সম্মতি প্রয়োজন। অবিবাহিত পুরুষ বা নারী যে কেউই দত্তক নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে অবিবাহিত বা বিবাহবিচ্ছিন্ন নারী ছেলে বা মেয়ে, যে কোনও শিশুকেই দত্তক নিতে পারবেন। কিন্তু অবিবাহিত পুরুষ কোনও কন্যাসন্তানকে দত্তক নিতে পারবেন না।
দত্তক গ্রহণের জন্য কীভাবে ও কোথায় আবেদন জানাবেন:
এখন চাইলেই টাকা দিয়ে কোনও মিশন, হোম বা হাসপাতাল থেকে সরাসরি দত্তক নেওয়া যায় না। দত্তক সংক্রান্ত বিষয়টি ‘জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অ্যাক্ট’ ও ‘মডেল রুলস’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইনি পথে দত্তক নেওয়ার জন্য প্রথমেই ভারত সরকারের শিশু ও নারী কল্যাণ দপ্তরের অন্তর্গত ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’ (কারা)-র পোর্টালে গিয়ে অনলাইনে আবেদন জানাতে হয়। কারা-র ওয়েব অ্যাড্রেস cara.nic.in -এ আবেদন করতে হবে। অনলাইনে আবেদনের সময় প্যান কার্ড, ছবি, বিবাহের শংসাপত্র, বাসস্থানের শংসাপত্র, জন্মতারিখের প্রমাণপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনীয় নথি দত্তক গ্রহণে ইচ্ছুক দম্পতি/ব্যক্তিকে আপলোড করতে হবে। আবেদনের তথ্য খুঁটিয়ে দেখে তা মঞ্জুর বা খারিজ করা হয়।
দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বয়সের বিধিনিষেধ:
দম্পতির দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বয়সের কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। ৪ বছর বয়স পর্যন্ত কোনও শিশুকে দত্তক নিতে চাইলে কোনও দম্পতির বয়সের সমষ্টি ৯০ বছরের বেশি হওয়া চলবে না। ৪ থেকে ৮ বছর বয়সি শিশু দত্তক নিতে চাইলে, দম্পতির বয়সের সমষ্টির সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বছর। ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে এই সীমা যথাক্রমে ১১০। দত্তক নেওয়া শিশুর সঙ্গে প্রত্যাশিত মা-বাবার উভয়েরই বয়সের পার্থক্য অন্তত ২৫ বছরের হতে হবে। দত্তক নেওয়ার জন্য নাম নথিভুক্ত করার দিন থেকে বয়সের হিসেব করা হবে। তিন বা তার বেশি সন্তান থাকলে নেওয়া যাবে না দত্তক। তবে এই নিয়মটির বেশ কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। ৪ বছর বয়স পর্যন্ত কোনও শিশুকে একা কোনও ব্যক্তি দত্তক নিতে চাইলে তাঁর বয়স হতে হবে ৪৫ বছরের কম। ৪ থেকে ৮ বছর বয়সি শিশু দত্তকের ক্ষেত্রে একক ব্যক্তির বয়সের সর্বোচ্চ সীমা ৫০ বছর। ৮ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সন্তানকে দত্তক নিতে গেলে একক ব্যক্তির বয়সের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৫৫ বছর। তবে কোনও আত্মীয় ও সৎ বাবা-মা দত্তক নিতে চাইলে বয়সের কোনও বিধিনিষেধ নেই।
কোন শিশুকে দত্তক নেওয়া যাবে?
যে শিশুর আইনি বাবা-মা বা অভিভাবক নেই, অথবা যার বাবা-মা কিংবা অভিভাবক তার দেখভালে সমর্থ নন, সেসব শিশুকে ‘অনাথ’ হিসাবে গণ্য করে দত্তক দেওয়া হয়। যে শিশুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে (বাবা মা হিসাবে কোনও দাবিদার নেই) এবং সে শিশুকল্যাণ কমিটির অধীনে রয়েছে, তাকেও আইনসঙ্গতভাবে দত্তক দেওয়া হয়। সাধারণত, কয়েক মাস বয়স থেকে থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের দত্তক নেওয়া যায়। শিশুকল্যাণ কমিটি নির্ধারণ করে কোন শিশু অনাথ, পরিত্যক্ত (কুড়িয়ে পাওয়া) বা সারেন্ডার করা হয়েছে। সৎ ছেলে-মেয়ে বা আত্মীয়ের সন্তানকেও দত্তক নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে শিশুটির জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) বাবা-মায়ের সম্মতি প্রয়োজন। শিশুর বয়স পাঁচ বছরের উপরে হলে তাঁরও সম্মতি নিতে হবে।
দত্তক গ্রহণের আবেদন মঞ্জুর হলে পরের প্রক্রিয়া:
‘কারা’-র তরফে আবেদন মঞ্জুর হলে, তাদের তরফে সমাজসেবী বা আধিকারিক দত্তক নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি বা দম্পতির বাড়ি এসে তাঁর বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করবেন। সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্য, প্রতিবেশী ও কর্মক্ষেত্রেও তিনি যোগাযোগ করবেন। সবকিছু ঠিকঠাক মিটে গেলে কয়েকটি অ্যাডপশন সেন্টারের তথ্য ও শিশুর প্রোফাইল ইমেল মারফত জানানো হবে আবেদনকারী দম্পতি বা একক ব্যক্তি বা মহিলাকে। দত্তক শিশুটির মেডিক্যাল রিপোর্ট পাঠানো হবে। প্রয়োজনে শিশুটির সঙ্গে সময় কাটানোরও সুযোগ দেওয়া হবে।
দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে শিশুর যেসব তথ্য রাখা জরুরি:
শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট ও তার ফোটোকপি। শিশুর সমীক্ষার রিপোর্টের ফোটোকপি। প্রতিপালন সংক্রান্ত চুক্তির ফোটোকপি। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত দত্তকের জন্য আইনত বৈধ শংসাপত্রের ফোটোকপি।
দত্তক গ্রহণের পর:
আইন অনুযায়ী শিশুটি বাড়িতে আসার পরেও এজেন্সির কর্মী পরিবারটির সঙ্গে অন্তত দু’বছর যোগাযোগ রেখে চলবে। বাবা-মায়ের কাছে দত্তক সন্তানটির জীবনযাত্রা কেমন, পড়াশোনা কেমন হচ্ছে বা তার দেখভালে কোনও ত্রুটি থেকে যাচ্ছে কি না, তা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যাচাই করা হবে। যদি পালক বাবা-মা কোনও কারণে বাড়ি বদল করেন, তা অবশ্যই এজেন্সিকে জানাতে হবে।
আইন সংশোধনের পর
প্রক্রিয়ায় সরলতা:
এর আগে শিশু দত্তক গ্রহণের গোটা প্রক্রিয়াটি ‘জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অ্যাক্ট (২০১৫)’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। আইনের আওতায় গোটা প্রক্রিয়াটিতে আদালত ছাড়পত্র দিত। ফলে আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লেগে যেত। যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিল দেশের শীর্ষ আদালত। এরপর ২০২১ সালে আইনে সংশোধন হয়। এখন দত্তকের ছাড়পত্রের বিষয়টি জেলাশাসক পর্যায়েই নিষ্পত্তি হচ্ছে।
তবে আইন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বেশি অর্থ দিয়ে অনেকে বেআইনিভাবে দত্তকের পথে হাঁটেন। তেমনটা করলে কিন্তু বিপদ আসন্ন। আইনের সংস্থান অনুযায়ী তিন বছর পর্যন্ত হাজতবাস ও এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে। সুতরাং সম্পূর্ণ সরকারিভাবে এবং সরকার অনুমোদিত দত্তক প্রদানকারী সংস্থার থেকেই দত্তক নেওয়া শ্রেয়। সরকারি নির্দেশ অনুসারে সন্তান দত্তক গ্রহণ প্রক্রিয়ার জন্য মোট খরচ ৫৪ হাজার টাকা।