বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
হুগলি জেলার খানাকুল-১ নং ব্লকের তাঁতিশাল গ্রামের এক অভাবী সংসারে এমনই এক প্রতিভার খোঁজ মিলেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যাঁর প্রতিভায় কোনও খামতি নেই। সেই মেয়েটির নাম কঙ্কাবতী মালিক। ডাকনাম মানু। জন্ম থেকেই তাঁর দু’টি হাত অকেজো, একটি পা কাজের অনুপযুক্ত। হাত দিয়ে তিনি লিখতে পারেন না। তাই পায়ের সাহায্য নিতে হয়। ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। তাই বলে তিনি সহজে হাল ছেড়ে দেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করার মানসিকতাকে পাথেয় করে তিনি হয়ে উঠেছেন লড়াকু ও সংগ্রামী। এভাবেই দারিদ্র ও আর্থিক অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০১৩ সালে তাঁতিশাল গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ২০১৪-১৫ বর্ষে খানাকুল কৃষ্ণভবানী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ২০১৭ সালে আরামবাগ গার্লস কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে আপাতত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি। ইচ্ছে আইনজীবী হওয়ার। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট তাঁর আইন পড়ার ক্ষেত্রে তাঁকে এক অনিশ্চিত প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
মাটির উঠোনে বসে কঙ্কাবতীর মা ভাগীরথী মালিক তাঁর যন্ত্রণাময় দুঃখের করুণ কাহিনি তুলে ধরলেন। বললেন—কঙ্কাবতীর বয়স যখন ১ বছর ৪ মাস তখন তার বাবা (পরেশ মালিক) মারা যান। তারপর স্বামীর ভিটেকে আঁকড়ে ধরে তিনি দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে শক্ত হাতে সংসার সামলাতে থাকেন। ঘরে তিন মেয়ে। কঙ্কাবতী সবার ছোট। পেটের দায়ে তিনি লোকের বাড়িতে কাজ করতে বাধ্য হন। আবার কখনও বা জমিতে জনমজুরের কাজ করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেনি। এইভাবেই সংসার সামলেছেন। এখনও তাই করছেন। শুধুমাত্র মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে তাদের মুখে এক মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার তাগিদে আগেও যেমন দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর দিন কেটেছে, এখনও তাই কাটে। জীবন যুদ্ধে তাঁর এই কঠিন লড়াই এখনও অব্যাহত।
চালচুলোহীন ভাঙাচোরা মাটির ঘরে এখনও বিদ্যুৎ ঢোকেনি। তাই হ্যারিকেনের আলোয় মেয়ে কঙ্কাবতী লেখাপড়া করে চলেছেন। তাঁর জেদ, তিনি বিজয়নী হবেনই। মানুষের মতো মানুষ হবেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট তাঁর অভাবী পরিবারকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। অভাব তাঁকে কুরে কুরে খায়। তাঁর এই চরমতম দুঃখের দিনে একমাত্র গোপালনগর নিবাসী সমাজকর্মী শেখ জসীমউদ্দিন তার পাশে দাঁড়িয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কঙ্কাবতীর আইন পড়ার খরচ সর্বসাকুল্যে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখনও পর্যন্ত কঙ্কাবতীর মা কষ্টেসৃষ্টে ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়েছেন। আরও ৮০ হাজার টাকা বাকি। এই ৮০ হাজার টাকা কীভাবে তিনি জমা দেবেন, তা ভেবেও কুলকিনারা পাচ্ছেন না। চোখে তাই ঘুম নেই তাঁর। চিন্তায় মগ্ন থাকেন দিনরাত। চাপের কাছে নতি স্বীকার করা ভাগীরথী মালিক জানালেন, ‘আমার দুঃখের দিনে গ্রামের মানুষ, পাড়াপড়শিরা আমার কাছে নেই। একমাত্র শেখ জসীমউদ্দিন যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ।’
আইনের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী কঙ্কাবতীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় পঞ্চায়েত এমনকী ব্লক প্রশাসন আমার পড়াশোনার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সহযোগিতা করেনি। আরামবাগের সাংসদ ম্যাডামের কাছে দরবার করে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছি। কেউ আশ্বাসের বাণী শোনায়নি। আর্থিক সাহায্য তো দূরের কথা। আমার এই দুর্দিনে কেউ আমাকে একটুও উৎসাহ বা উদ্দীপনা অথবা প্রেরণা জুগিয়েও আমার মনোবল বাড়ায়নি।
এখন প্রধান ও একমাত্র বাধা ৮০ হাজার টাকা জোগাড় করা। এই টাকা জোগাড় করতে না পারলে আমার আইন পড়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। সেই ভাবনায় আমি আকুল।’ খানিক ভেবে স্মৃতিচারণ করে কঙ্কাবতী আরও জানালেন, জসীমউদ্দিন স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও প্রচেষ্টায় তিনি প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তাতে তাঁর পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক উপকার হয়। তবু চিন্তার অন্ত নেই তাঁর মনে। শান্তিও নেই এতটুকু। এখন তাঁর মন জুড়ে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কীভাবে ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে? আর কীভাবেই বা সেই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা হবে। সম্প্রতি খানাকুলের ‘নীরবে আমরা’ ফেসবুক গ্রুপের সদস্যেরা কঙ্কাবতীকে তাঁর পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ও কিছু খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। এমন একটি গ্রুপের কাছে সাহায্য পেয়ে সামান্য একটু আশার আলো দেখেছিলেন কঙ্কবতী।
তিনি বললেন, ‘আমার প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় হেলান দিশারী ক্লাব আমাকে হুইল চেয়ার (প্যাডেল দেওয়া ঠেলা গাড়ি) দেয়। রামনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ ইকবাল, রাধাবল্লভপুর পাঠাগারের কর্মী নাজিমুদ্দিন হাজারি, মদনপুর প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রয়াত প্রণব কুমার ভট্টাচার্য, আরামবাগ নেতাজী মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা তৃপ্তি মুখোপাধ্যায়, মদনপুর গ্রামের সহৃদয় তাপস সামন্ত, শান্তি সামন্ত, সুভাষ সামন্ত, তাঁতিশালের সুশান্ত সাঁতরা মহাশয়েরা আমার পড়াশোনার জন্য সর্বতোভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া খানাকুলের রীনা মণ্ডল ম্যাম আমার শারীরিক চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও একটি স্মার্ট ফোন দিয়ে আমার পড়াশোনায় সাহায্য ও উৎসাহিত করেছেন। এঁদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।’
এখন দুঃস্থ ও সহায়সম্বলহীন কঙ্কাবতীর আইন পড়ার জন্য কোনও সহৃদয় ব্যক্তি যদি আর্থিক সহযোগিতা করেন তাহলে তাঁর আগামীর লড়াই সহজ হবে। আর্থিক সাহায্য পেলে কঙ্কাবতী যে আইনজীবী হতে পারবেন, তিনি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত। যোগাযোগ: ৯০৮৩৫০৮৯৪৪।