বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
সেদিনের নেতাদের আর যোগ্য বলে মনে করি না। নেতাদের সম্পর্কে আমাদের এই সম্ভ্রম ছিল যে তাঁরা ক্ষমতা যোগ্যতায় ঈশ্বরের সমান। তাঁদের অসাধ্য কিছু নেই। অথচ তাঁরা ভারতভাগ আটকাতে পারেননি, বরং এই অভিযোগটি আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে তাঁদেরই কারও কারও উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য ভারতভাগ হয়েছিল। চিকিৎসাশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি যে সম্পূর্ণ অক্ষত দুটি অঙ্গকে ব্যবচ্ছিন্ন করেছিলেন সেদিনের কিছু হাতুড়ে ডাক্তার। তাতে রোগ সারেনি, উল্টে ক্রনিক কিছু ব্যাধির পত্তন হয়েছে। সবচেয়ে বড়টার নাম উপমহাদেশ জুড়ে ধর্মে ধর্মে বিভেদ বৃদ্ধি। একটি দেশে (ভারতে) অহিন্দুরা সংখ্যালঘু ছিল। জিন্নার কৃতিত্ব একটাই—তিনি দুটি দেশে (পাকিস্তান এবং অতঃপর বাংলাদেশে) হিন্দুদের সংখ্যালঘু বানাতে পেরেছেন। তিন তিনটি দেশের কোথাও সুখী হতে পারল না হিন্দু, মুসলমানের কেউই।
তিনটি দেশেই ধর্মান্ধরা যাবতীয় গন্ডগোল করে থাকে স্বদেশ প্রেমের নামে। কিন্তু তা খাঁটি হলে কখনওই হিংসামূলক কর্মে যুক্ত হওয়া যায় না। তাতে যে অখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তার প্রত্যক্ষ দায় হিংস্র লোকটার উপরেই বর্তায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের যে বদনাম হল তা কোনও দিন পূরণ হওয়ার নয়। শুধু কি কিছু হিন্দুর বাড়ি আর মণ্ডপ/মন্দির ভাঙা হল? না, চুরমার করা হল আসলে বাংলাদেশের সম্প্রীতির ভাবমূর্তিটা। একটা জিনিস এই উন্মাদরা জানে না, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গকে আসলে যা হারাতে হয়েছে সেটা মানবসম্পদ। ১৯৪৭ পরবরর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতে নানা ক্ষেত্রে যে বিরাট অগ্রগতি ঘটেছিল তাতে অপরিমেয় অবদান রেখেছেন পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসা একঝাঁক প্রতিভাবান মানুষ। পূর্ববঙ্গে সম্প্রীতির অভাব না ঘটলে এই মানুষগুলি ওই দেশেরই নানা স্থানে থেকে যেতে পারতেন। অনেকে হয়তো যুক্তি সাজাবেন, কেন, তার পরেও কি বাংলাদেশ উন্নতি করেনি? নিশ্চয় করেছে। তবে এইসব প্রতিভা প্রত্যাখ্যাত না-হলে উন্নতি আরও ত্বরান্বিত এবং বেশি হতো। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিবঙ্গ তথা ভারতও। বাঙালির মিলিত শক্তিই হয়তো একদিন সারা ভারত বা এই গোটা উপমহাদেশকেই নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা ও শক্তি অর্জন করত। সেই ট্রেন সাড়ে সাত দশক আগে মিস করেছি আমরা। কিন্তু এই দীর্ঘ অবসর কি শুধুই বিস্মৃতির? এটাকে তো শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে তোলা যেত। অখ্যাত অরাজনৈতিক সাইফুলের ভূমিকায় আমি সেই বিচক্ষণতার পরিচয় পেলাম।
ইসকন, হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের একাধিক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদ করেছেন ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেক অখ্যাত জনপদেরও অসংখ্য মানুষ। আছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, কবি, শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের মধ্যে অবশ্যই আছেন মুসলিমরা এবং যথেষ্ট বেশি সংখ্যায়। সবার নিরাপত্তার দাবিতে সরব হয়েছেন তাঁরা। সরকার আশ্বস্ত করেছে। প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে। সরাসরি নিন্দা করেছে আমেরিকাও। আওয়ামি লিগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অনুপম সেন ফের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান দাবি করেছেন। হাসিনা সরকারের তথ্যমন্ত্রী মুরাদ হাসানের গলাতেও মুজিবের সংবিধান ফেরানোর অঙ্গীকার বজ্রকঠিন শোনাল। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেল সাইফুল ভাইয়ের একক প্রয়াস।
ভারতে সিএএ একটি অন্যায্য আইন। যে আইনে মুসলিম বাদে অন্য কয়েকটি ধর্মের মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে। আইনটিতে হিন্দু আবেগ থাকলেও কোনও সম্প্রদায়ের কল্যাণ লেখা নেই। এই আইনের পরতে পরতে একটা জিনিসই নিশ্চিত করা হয়েছে, তার নাম ক্ষমতার স্বার্থ। আইনটির মূল প্রতিপাদ্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি প্রতিবেশী/নিকটবর্তী দেশগুলিতে বিপন্ন অমুসলিমদের ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। আরএসএসের এই রাজনৈতিক অস্ত্র ভোঁতা করার একটাই উপায় উপর্যুক্ত দেশগুলিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সেটা অবশ্য কোনও কোনও প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসের মশকারা নয়। যেমন ইমরান খান একবার নরেন্দ্র মোদিকে কটাক্ষ করতে গিয়ে দাবি করেছিলেন, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত, পাকিস্তানের কাছ থেকে শিখুন মোদি! আসল মন্ত্র হল, গোটা উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয়। অনেকের অভিযোগ, মোদি জমানা সংবিধানের এই নীতিগুলির রূপায়ণে আন্তরিক নয়, বরং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে। তীব্র সমালোচনা হচ্ছে বটে এই অনাচার পুরোপুরি রুখে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রগতিশীল প্রতিবাদীদের যুক্তি ভোঁতা করে দিচ্ছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি। এই তিন দেশের কোথাওই ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান নেই। আফগানিস্তানে চেপে বসেছে তালিবানি শাসন। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানে ইসলামি শাসন গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রচলন করেও শেষরক্ষা করতে পারেননি। তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধান বদল করে দেশবাসীর উপর ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ চাপিয়ে দেন। সেটাই চলছে। এই অন্যায় সংশোধনের আন্তরিক চেষ্টা হয়নি। বরং কাবুলের পতনের পর ধর্মান্ধরা বাংলাদেশেও তালিবানি শাসন কায়েমের দাবিতে গলা চড়িয়েছে। সোজা কথায়, পাকিস্তানের স্বপ্নপূরণে মরিয়া শক্তি চায় বাংলাদেশের মেয়েদের আর সংখ্যালঘুদের মধ্যযুগীয় আঁধারে নিমজ্জিত করতে। এই তিন দেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার একটাই উপায় সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা। বহুত্ববাদকে সশ্রদ্ধায় গ্রহণ করা, যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন নয়। কারণ শেখ হাসিনার দলই সর্বেসর্বা। বিএনপি, জামাত মৃতপ্রায়। হেফাজতে ইসলামও রুগ্ন। এখন আসল দরকার শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তিনি তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিলেন। পিতার হত্যাকারীদের একে একে শাস্তি দিয়েছেন। তাহলে পিতার তৈরি সংবিধান ফিরিয়ে আনতে বাধা কোথায়?
তাঁর দল ও সরকারের এ ব্যাপারে গড়িমসি দেখে এই প্রশ্নটাই উঁকি দেয় যে, তাহলে শেখ হাসিনাও কি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে বাস্তবে শ্রদ্ধা করেন না? ধর্মনিরপেক্ষতা এক রাজনৈতিক কৌশল মাত্র! দেশের বৃহত্তম দলের ছাত্র সংগঠনকে প্রতিবাদের ময়দানে প্রত্যাশিতভাবে দেখা গেল না কেন? হাসিনা সত্যিই আন্তরিক হলে জাতীয় সংসদে বিল আনুন অবিলম্বে। দ্রুত ফিরিয়ে আনুন মুজিবের সেই ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, স্বাধীনতার মাত্র দশমাসের ভিতরে মুজিব যেটা উপহার দিয়েছিলেন। হাসিনা বুঝিয়ে দিন, বাঙালি আজও সঙ্কীর্ণ নয়। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতভাগের বাস্তবতা নস্যাৎ করেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। নেপথ্য শক্তি ছিল শুধুই বাঙালি জাতীয়তা। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী প্রভৃতি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল। তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে নির্দিষ্ট একটি রাষ্ট্রধর্ম অন্যায় নয় কি? এই ঘোষণায় অমুসলিমরা সেদেশে নিশ্চিত করেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে রূপান্তরিত হয়েছেন।
এইভাবেই ভারতের হিন্দু মৌলবাদী শক্তির হাত শক্ত করেছে তিন প্রতিবেশী। তারা তো এই যুক্তিই দিচ্ছে, ভারত ভেঙে তিনটি দেশ হল। মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তারা মুসলিম রাষ্ট্র/রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম গ্রহণ করল। অন্যদিকে, হিন্দুদের বিপুল গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ—এ কেমন নীতি? তার মানে, মুসলিমরা যেখানে সংখ্যালঘু শুধু সেখানেই তারা ধর্মনিরপেক্ষ! এর ফল ভারতীয় মুসলিমদের জন্য ভালো হয়নি। অন্য তিন দেশের ধর্মান্ধতা এবং সেখানকার দেড়-দুই কোটি হিন্দু/অমুসলিমকে দাবিয়ে রাখার নীতিই প্রায় ২২ কোটি ভারতীয় মুসলিমের ক্ষতির কারণ হয়েছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির হাত আরও শক্ত করতে অন্য তিন দেশেও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উত্থান কাম্য।
বাংলাদেশ দিয়েই এটা শুরু হোক। মুজিব তনয়ার উপর গভীর আস্থা আছে। তিনি এইভাবে তাঁর নামটা স্বর্ণাক্ষরে লিখে যান। আমি ভীষণ আশাবাদী যে, সাধারণ নাগরিকের কুণ্ঠাহীন সমর্থন ও সাধুবাদ পাবে সরকার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম যথেষ্ট বিচক্ষণ; সাধারণ মানুষ এবার অভূতপূর্ব চেতনার পরিচয় দিল। অনেকে হয়তো হাসবেন, তবু আমি আস্থা রাখব পাকিস্তানের উপরেও। সুদূর কোনওকালে হয়তো সেখানেও ধর্মনিরপেক্ষতার জয় পতাকা উড়তে থাকবে। বাংলাদেশ দিক বদল করলে পাকিস্তান, আফগানিস্তানও আধুনিক হয়ে ওঠার কথা ভাবতে থাকবে। ধর্ম ধর্ম করে সঙ্কীর্ণতার কীর্তন একদিন ক্লান্ত হবেই, হতেই হবে, প্রকৃতির নিয়মে। গোটা উপমহাদেশের অন্তর থেকে এই দাবি ক্রমে জোরালো হোক।