বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান। বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনা শুধু উৎসবকেই ম্লান করেনি, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকেও লজ্জায় ফেলেছে। কুমিল্লার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে।
প্রয়াত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একবার খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, পাকিস্তান জমানায় রাষ্ট্রটি ছিল সাম্প্রদায়িক, কিন্তু সমাজটি ছিল অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশ আমলে রাষ্ট্র ও সমাজ— দুটিই সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছে। অথচ, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম দুটোই বহাল রয়েছে। বাংলাদেশের গণআন্দোলনের নায়ক মৌলানা ভাসানি বলতেন, নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না। সাম্প্রদায়িকতাও তেমনই। মুখে দাবি করলেই কেউ অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। কাজে এর প্রমাণ দিতে হয়। সোহরাব হাসান ঠিক প্রশ্নই তুলেছেন! কুমিল্লার নানুয়াদীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কে বা কারা কোরান রেখে গিয়েছে, সেটা কি কখনও জানা যাবে? হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনও মানুষ কেন সেখানে কোরান নিয়ে যাবেন? আবার কোনও ধর্মপ্রাণ মুসলিমও এই কাজ করবেন না। অথচ, সেই রামু থেকে নাসিরনগর এবং সর্বশেষ কুমিল্লায় একই ধরনের সস্তা চালই চালা হয়েছে। কুমিল্লায় দুর্গা মণ্ডপে হামলার পর দুষ্কৃতীদের নিশানা হয়েছে নোয়াখালির ইসকন মন্দিরও। কেন এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক? প্রশ্ন উঠেছে, চাঁদপুরে হাজিগঞ্জের মতো এত ছোট্ট জায়গায় ‘তৌহিদি জনতা’-র ব্যানারে এত লোক মিছিল করে মন্দিরে হামলা করল কীভাবে? কারা ছিল এই মিছিলে? প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, মিছিলে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত, হেফাজতের পাশাপাশি ছাত্রলিগের নেতা-কর্মীরাও ছিল। নিশ্চিতভাবেই, যারা এই কাজ করছে, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। সেই বিকৃতমনস্করা নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবকে। তারা বেছে নিয়েছে এমন একটি সময়কে, যখন বাংলাদেশ সবে কোভিডের ভয়ঙ্কর ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসছে।
বাংলাদেশের কুমিল্লা পরিচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শহর হিসেবেই। এই শহরই শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মভূমি। এই শহরেই শচীন দেববর্মনের ভিটেমাটি। ১৯২২-এ এই শহরেই বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম কাঁধে হারমোনিয়াম নিয়ে গেয়েছিলেন, ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!/ ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,/ সন্তান দ্বারে উপবাসী,/ দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!’ আজ সেই শহরে মানবতার লাঞ্ছনা লজ্জায় ফেলেছে ওপার বাংলাকে।
কুমিল্লায় নানুয়ার দিঘির পাড়ে অস্থায়ী মণ্ডপে প্রতি বছর পুজো হয়। ১০ দিনের জন্য নির্মিত মণ্ডপ পুজোর পরই ভেঙে ফেলা হয়। এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য অত্যন্ত গভীর। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের সময় নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে যে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ বা কুড়িগ্রামে বিভিন্ন সময়ে যে সাম্প্রদায়িক উসকানি বা অস্থিরতার ঘটনা ঘটেছে, তখনও কুমিল্লার নানুয়া অঞ্চলে অস্থিরতার ছাপ পড়েনি। এখানকার পূজা-পার্বণে কখনওই প্রশাসনের সাহায্য নিতে হয়নি। বরং এবারই প্রথম পুলিসকে টহল দিতে দেখা গিয়েছে, তা-ও ঘটনার আগের দিন। তাহলে কি পুলিসের কাছে কোনও আগাম আশঙ্কার খবর ছিল? তাহলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি কেন? এই ব্যর্থতার দায় গোয়েন্দা বাহিনী এড়াবে কীভাবে?
অজুহাতের কোনও অভাব হয় না। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, অন্য ধর্মমতের মানুষকে নির্মূল করে ফেলা কোনও ধর্ম অনুমোদন করে না। তারপরও ঘটনা থেমে নেই। ঘটছে একের পর এক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কুমিল্লা কাণ্ডে ধর্ম দেখব না, দোষীদের খুঁজে খুঁজে শাস্তি দেব। তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটাতে কেউ সাহস না পায়। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। বাংলাদেশে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করবেন। যাঁর যাঁর ধর্ম, তাঁরা পালন করবেন। অর্থাৎ ধর্ম যাঁর যাঁর, কিন্তু উৎসব সকলের। বাংলাদেশে এটা সবসময় ছিল, থাকবেও। প্রত্যেকে সেই উৎসবে শামিল হয়ে একসঙ্গে উপভোগ করেন। কিন্তু মাঝেমাঝে কিছু কিছু দুষ্টচক্র কিছু ঘটনা ঘটিয়ে মানুষের এই চেতনাকে নষ্ট করতে চায়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’ হাসিনার এই বক্তব্য আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের কতটা আশ্বস্ত করেছে, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎ–ই দিতে পারবে।
কুমিল্লার ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদির আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন ধর্মান্ধগোষ্ঠীরা ‘তাকে চাঁদে দেখতে পাওয়া’-র ছবি ছড়ানোর মাধ্যমে দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। ঠিক একইভাবে দুষ্কৃতীরা একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর নামে খোলা ভুয়ো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কোরান অবমাননার ছবি ছড়িয়ে দেয় এবং সংগঠিত হয় ভয়ঙ্কর রামু ট্র্যাজেডি। সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার রাস্তা খুব সহজেই খুঁজে পেয়ে গিয়েছে ধর্মান্ধগোষ্ঠীরা। অতীতে এরকম ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কোনও সাজা হয়নি। অথচ প্রয়োজন ছিল দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। হয়তো তাই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হামলার মাত্রা ছিল এক রকম। আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সাল থেকে থেমে থেমে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে। এর পিছনে যেমন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আছে, তেমনই আছে সরকারি দলের ভিতরে লুকিয়ে থাকা অপশক্তিও। আওয়ামি লিগ সরকার এবং প্রশাসনের মধ্যে পাকিস্তানি ভূত রয়েছে। সংকটের মূল এখানেই।’ এই অনাস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। দিনে দিনে আক্রান্ত হতে হতে তাঁদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে।
আটের দশকে ইসলামের নামে সন্ত্রাস কতটা ব্যাপক ও ভয়াবহ হতে পারে তার সাক্ষী হয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সময় বাংলাদেশের মৌলবাদীরা তথাকথিত জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য দলে দলে আফগানিস্তানে গিয়েছিল। আর দেশে ফিরে তারাই স্লোগান তুলেছিল: ‘আমরা সবাই তালিবান, বাংলা হবে আফগান।’
সেই আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা দখলে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি মৌলবাদীরা আবারও উল্লসিত হয়েছে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মারাত্মক ভাইরাসের মতো বিস্তার লাভ করছে। এই মাধ্যমটি সম্পূর্ণভাবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গুজব ছড়িয়ে দুর্বলের উপর সবলের আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে। ব্যক্তি-আক্রমণ, কুৎসা রটনা এবং মিথ্যা সংবাদ সাজিয়ে মানুষকে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করেছে তার প্রমাণ কুমিল্লা, রামু, বাঁশখালি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভোলা, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়ানো। বাংলাদেশের প্রায় সব ঘরানার ‘ইসলামপন্থী’দের কাছে তালিবানের ক্ষমতা দখলের ঘটনা তাদের রাজনীতির বিজয় বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়া ‘ইসলামপন্থী’রা আঞ্চলিক এবং জাতীয় রাজনীতির সমীকরণের দিকে না তাকিয়ে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। বহু দল এবং উপদলে বিভক্ত ‘ইসলামপন্থী’দের কাছে আজ তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান একটি ‘মডেল রাষ্ট্র’। দলের ম্যানিফেস্টোতে যাই লেখা থাকুক, এই সমস্ত দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের বড় অংশটি তালিবানি শাসনকে মডেল ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং সমাজের ‘শরিয়া-ভিত্তিক’ রূপান্তর ঘটাতে চায়। ভয়টা সেখানেই।
সাম্প্রদায়িক শক্তি যে কোনও জনপদেই লঘুদের উপর চড়াও হয়। এটাই আধিপত্যবাদের ধর্ম। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে তা টের পেয়েছিলেন দিল্লিবাসীরাও। আধুনিক ঝাঁ-চকচকে নাগরিক জীবনের পরতে পরতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, বিদ্বেষের চাষবাস, কিন্তু প্রাণঘাতী হামলাগুলো হয়েছিল শহরের সেই সব প্রান্তিক ঘিঞ্জি এলাকায়। নন-এলিট এলাকায়। খেটে-খাওয়া নিম্নমধ্যবিত্ত, দিন-আনা দিন-খাওয়াদের বসবাস দিল্লির সীলমপুর, যমুনা বিহার, মৌজপুর, ভজনপুরা, জাফরাবাদ, উত্তর-পূর্বে ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। খেটে-খাওয়া, মধ্য-নিম্নবিত্ত রোজগারের যে শহরাঞ্চল, সেখানেই উর্বর জমি পেয়েছিল মারমুখী হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি। আর এর মাঝে খেলা খেলে কিছু ধর্মের ব্যবসায়ী। ঠিক যেমন অসমে। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গে ভোটের সময় ধর্মীয় মেরুকরণের কদর্য প্রকাশ হয়েছিল। এপারে বাংলার মানুষ ভুলবে কীভাবে? এই সবের ভয়াবহ পরিণাম এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকেরা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু ক্ষমতার অঙ্ক তাঁদের শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। হয়তো তাতে কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য প্ররোচিতও করা যায়। দিনের শেষে চরম পরিণতির দায় এড়ানো যায় কি?
আসলে আধিপত্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র হিসেবে যখন ধর্মের ব্যবহার শুরু হয়, তখন থেকেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হতে শুরু করে। বাংলাদেশের নিপীড়িতরাও প্রথম প্রথম কারও কারও প্রতি বিশ্বাস রাখত। কিন্তু তাতে আগুন নেভেনি। সিদুঁর রাঙা মেঘ সর্বত্র তাদের তাড়া করেই বেড়ায়। কারণ, ইতিহাসের শিক্ষা, ‘সাম্প্রদায়িকতা’র মতো আর কোনও ‘পণ্য’ এতটা বাজারজাত হয়নি। দুয়ার বন্ধ রেখে এই পণ্যের প্রবেশ রোধ করা যায়নি। ফলে ধর্মকে জোর করে ধর্মান্ধতায় পৌঁছে দেওয়ার খেলা চলছেই। আর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন মানেই এপারে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভোটের পালে হাওয়া। এপারে শুরু হয়ে গিয়েছে ভোটের সেই অঙ্ক কষা। যতটা পারো বিদ্বেষ ছড়াও! কিন্তু বিভাজনবিষ আর অনিশ্চয়তা মিলে যে অস্থির সমাজের জন্ম দেয়, সেখান থেকে রেহাই পাওয়া কি খুব সহজ?
কে না জানে, মৃত্যুর ও-পারে ধর্ম নেই। হানাহানির অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু বিহ্বল বিপন্ন শোক। এপার-ওপার... সর্বত্র!