বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
অযোধ্যা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, সেই বিশ্বাস তো বহু কালের। এই শহরেই তুলসীদাস রামচরিতমানস লিখতে শুরু করেছিলেন। লোকবিশ্বাস মেনে নিয়েছিলেন মুঘল সম্রাটরাও। আকবরই গোটা প্রদেশের নাম রাখেন ‘অওধ’। আবুল ফজলের সাক্ষ্য, ‘অযোধ্যা থেকে অওধ। হিন্দুধর্মের অন্যতম অবতার রামচন্দ্র অযোধ্যাতেই জন্মেছিলেন।’ ইতিহাস ওইটুকুই। রামচন্দ্র শহরের কোথায় জন্মেছিলেন, ‘সীতা রসুই’তে সীতার রান্নাঘর ছিল কি না, এ সব নিয়ে আকবরের আমলেও কারও মাথাব্যথা ছিল না। এসবই মুঘল আমলের শেষ দিকে, অষ্টাদশ শতকে রামানন্দী সাধুদের আখ্যান। আসলে ইতিহাস অযোধ্যা শহরে এমন সব বাঁক নিয়েছে, যা আগে থেকে বোঝা যায়নি। রাজনীতিও তেমনই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলে গিয়েছে। এটাই নিয়ম। সাধুসন্তদের আখ্যানও ভারতে অনেক পুরনো জায়গার উপর নতুন আস্তর ফেলেছে। তৈরি হয়েছে নতুন ইতিহাস। নতুন রাজনীতিও। তাই রামরাজ্য আজ আর মহাকাব্য নয়, এখন রাম মানে রাজনীতি আর অন্ধ ভক্তি। রামমন্দির আজও সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্রীড়াক্ষেত্র। ভোটতান্ত্রিক রাজনীতির অবয়ব মাত্র।
গত বছর ৫ আগস্ট অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন ‘রামভক্ত’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে মন্দির নির্মাণের কাজ। মন্দির ট্রাস্ট সূত্রে খবর, ২০২৩-এর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কাঠামোর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ পুরোপুরি শেষ করে মন্দিরের প্রথম তলে রামলালার মূর্তি স্থাপন করা হবে। আর সেই রামকে ঘিরেই ফের লোকসভা ভোটের বৈতরণী পার করতে ময়দানে নামবেন নরেন্দ্র মোদি। একটা গণতান্ত্রিক আদালতের ধর্মাধ্যক্ষের মধ্যেও রামচন্দ্রের যে লীলাস্ফূর্তি ঘটেছিল, তার পূর্ণ পরিণতি ঘটেছে দেশের রাজার মাধ্যমে— তিনি এবার রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা চাইবেন। সম্ভবত ২০২৪ সালের মধ্যেই।
অঙ্ক একেবারে স্পষ্ট!
মোট ১১০ একর জমিতে ছড়ানো মন্দির নির্মাণের জন্য ৯০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা খরচের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। রামভক্তিতে ‘মুক্তহস্তে’ দান করছেন দেশের মানুষও। সেই চাঁদা তোলা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি শিবসেনাও। তাদের সামনা পত্রিকায় অভিযোগ তোলা হয়েছিল, রামের নামে চাঁদা তোলা আসলে ‘ভোটের অঙ্ক’ ছাড়া কিছু নয়। আর কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীর অভিযোগ, কোন পরিবার রাম মন্দিরের জন্য চাঁদা দিয়েছে, আর কারা দেয়নি, সেই সব বাড়িগুলোকে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতো চিহ্নিত করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। তবুও রামভক্তদের ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা জমা পড়েছে রামমন্দির নির্মাণ খাতে। আর জনগণের দেওয়া সেই বিপুল টাকা নিয়ে বদনামও কম নয়। অভিযোগ, রামমন্দিরে দানের টাকা নয়ছয় হচ্ছে। চাঁদা তুলে মানুষের টাকা লুট করছে রামজন্মভূমির কারিগররাই। ‘পবিত্র’ মন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া জনগণের টাকা ঘুরপথে গেরুয়া শিবিরের নেতাদের পকেটে ঢুকছে। কীভাবে?
গত জুন মাসে দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং এবং উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী পবন পান্ডে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কিছু জমির রেজিস্ট্রির কাগজ ও অন্য দস্তাবেজ দেখিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। অভিযোগ, রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট রামমন্দির নির্মাণের জন্য দেওয়া জনতার চাঁদার পয়সা নিয়ে নয়ছয় করছে। জমি মাফিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ২ কোটির জমি সাড়ে ১৮ কোটিতে কিনেছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে জমি ১৮ মার্চ, ২০১৭ তারিখের সন্ধে ৭ টা ১০ মিনিটে ২ কোটিতে রেজিস্ট্রি হয়, সেটাই ঠিক দশ মিনিট পরে সাড়ে ১৮ কোটিতে বিক্রি হয় কী করে? ওই জমিতে কী এমন সোনা রয়েছে, যাতে ১০ মিনিটে জমির দাম বেড়েছে ৯ গুণ?
আঙুল তোলা হয় ট্রাস্টের সচিব চম্পত রাইয়ের দিকে। যিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্টও বটে। জমি বিক্রির নথিতে দেখা যাচ্ছে, অযোধ্যার হাভেলি অওধ পরগনার, সদর তহসিলের বাগ বিজৌসি মৌজায় ১২০৮০ বর্গ মিটার এই জমি কুসুম পাঠক নামে এক মহিলার থেকে ২ কোটি টাকায় কিনেছেন সুলতান আনসারি নামে এক ব্যক্তি। উত্তরপ্রদেশ সরকারের রেজিস্ট্রির নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৮ মার্চ এই রেজিস্ট্রি হয়েছে। জমির সার্কেল রেট ধরে হিসেব করলে অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত দাম দাঁড়ায় ৫.৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু জমিটি কেনা হয়েছে ২ কোটি টাকায়। সার্কেল রেটের হিসেবেই জমির স্ট্যাম্প ডিউটি স্থির হয়েছে। সেই অর্থ দুই দফায় ৪০,২৩,৯২০ টাকা এবং ৩৪,৮৪০ টাকা দেওয়া হয়েছে। এরপর ওই একই দিনে ওই জমিটিই ওই সুলতান আনসারির থেকে ১৮.৫০ কোটি টাকায় কিনে নিয়েছে শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্ট। তার জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়েছে ১.২৯ কোটি টাকা। ট্রাস্টের সভাপতি চম্পত রাইয়ের ছবি ও সই রয়েছে রেজিস্ট্রিতে। সঞ্জয় সিং চম্পত রাইকে ‘চান্দাচোর’ বলতেও ছাড়েননি। বলেন, সাহস থাকলে আমার নামে মানহানির মামলা করুক, বা আমাকে মিথ্যে অভিযোগের দায়ে জেলে ভরে দিক। আমার কাছে দস্তাবেজ দলিল সব আছে। আমি ভয় পাই না।
জমি বিতর্কে নাম জড়িয়ে গিয়েছে অযোধ্যার মেয়র তথা বিজেপি নেতা হৃষিকেশ উপাধ্যায়ের। সঞ্জয় সিং আরেকটি দস্তাবেজ তুলে দেখিয়েছেন, ঠিক এর পাশের জমিটি ট্রাস্টের তরফে চম্পত রাই সেই দিনই, মানে ১৮ মার্চ বিকেলে কিনেছেন ৮ কোটি টাকায়। এবং দুটো দস্তাবেজেই সাক্ষীর জায়গায় সই করেছেন অযোধ্যার বিজেপি মেয়র হৃষিকেশ উপাধ্যায় ও ট্রাস্টের মেম্বার ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনিল মিশ্র। তার মানে ট্রাস্ট ওখানে জমির বাজার দাম সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। তাহলে পাশাপাশি দু’টি জমির দামে এত হেরফের কেন? সিবিআই তদন্ত চেয়েছিলেন আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং। ট্রাস্টের থেকে অবশ্য আর কোনও পাল্টা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
ঘটনা হল, চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রাম জন্মভূমি সংলগ্ন ১৩৫ নম্বর ক্রমিকের যে বিস্তীর্ণ জমি রয়েছে, তার ৮৯০ বর্গ মিটার ২০ লক্ষ টাকায় মহন্ত দেবেন্দ্র প্রসাদাচার্যর কাছ থেকে কিনে নেন হৃষিকেশের ভাইপো দীপ নারায়ণ। সংবাদমাধ্যমে দেবেন্দ্র প্রসাদাচার্য জানিয়েছিলেন, ‘জমিটি রামমন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দিতে হবে বলে বেশ কিছু দিন ধরে মেয়র জোরাজুরি করছিলেন। সরকারি জমি থেকে যা পাওয়া যায় তাই ভালো। এই ভেবেই জমিটি বিক্রি করে দিই।’ সেই সময় জমিটির বাজার মূল্য ছিল ৩৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। এর ৩ মাসের মাথায়, মে মাসে ওই জমিটিই রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্রকে আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি করেন তিনি।
অথচ, ওই ৮৯০ বর্গ মিটার জমিটি লেনদেনের আওতায় পড়েই না বলে অভিযোগ। অযোধ্যা জেলার ভূমি রাজস্ব দপ্তরের নথিতে সাফ বলা রয়েছে, ভোগ-দখলের অধিকারের আওতায় জমিটি বহু বছর ধরে অনেক হাত ঘুরেছে। কিন্তু সেটি বিক্রির অধিকার দেওয়া হয়নি কাউকেই। অযোধ্যার ভূমি রাজস্ব দপ্তরের নথি বলছে, ১৪২৫ কৃষিবর্ষ অনুযায়ী রামজন্মভূমি সংলগ্ন ১৩৫, ১৪২, ১২৯ এবং ২০১ ক্রমিকের বিস্তীর্ণ জমির মালিকানা সরকারের হাতে রয়েছে। কৃষিকার্য ছাড়া অন্য কাজে বহু বছর ধরে সেগুলি লিজে দেওয়া রয়েছে। বিভিন্ন সময় তা হাতবদল হয়েছে। রামকোটের ‘বড়া স্থান’-এর মহন্ত বিশ্বনাথ প্রসাদাচার্যকে ১৩৫ নম্বর জমির একটি অংশ লিজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও সাফ লেখা ছিল, তিনি শুধু ভোগদখল করতে পারবেন। জমির মালিকানা পাবেন না। বিশ্বনাথ কবে মারা যান, সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই ভূমি-রাজস্ব দপ্তরের কাছে। তবে বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি দেবেন্দ্র প্রসাদাচার্যের নামে লিজটি হস্তান্তরিত হয়। আর তাঁর কাছ থেকেই জমিটি ২০ লক্ষ টাকায় কিনে নেন দীপ নারায়ণ। সেই জমিই কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে কেনে রামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র। এই টাকার পুরোটাই মেয়রের ভাইপোর পকেটে ঢোকে বলে দাবি বিরোধীদের। এই অভিযোগ মানতে না চাইলেও আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিং-এর চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে গেরুয়া শিবিরের কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে যাননি। এক হাজার কোটি টাকার মানহানি মোকদ্দমার হুমকি আপাতত শীতঘুমে।
তাহলে কি রামের নামে দুর্নীতিও করা যায়? প্রশ্ন যাই থাক, এটাও ঘটনা যে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় যোগী সরকার ও সঙ্ঘ অস্বস্তিতে পড়েছে। মোদি সরকারই অযোধ্যার ট্রাস্ট গঠন করে ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনকে মনোনীত করেছে। ট্রাস্টে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আমলারা রয়েছেন। ট্রাস্টের সচিব চম্পত রাই ও সরকার মনোনীত সদস্য অনিল মিশ্র— দু’জনেই আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত। ফলে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসতেই আলোচনায় সেই রামমন্দির। আলোচনায় রামের নামে দুর্নীতি! এই বদনাম কি সইতে পারবেন যোগী আদিত্যনাথ?
গত দীপাবলিতে সরযূ নদীর তীরে গিনেস বুকের রেকর্ড ভেঙে জ্বলেছিল এক সঙ্গে ৬ লক্ষের বেশি মাটির প্রদীপ। সঙ্গে চোখ ধাঁধানো আলোর খেলা (লেজার শো)। কোথাও রাম-সীতা-লক্ষ্মণ-হনুমানের মূর্তি তো কোথাও রামায়ণের পাতা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনী। রামমন্দির গড়তে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে তার শিলান্যাসের পরে প্রথম দীপাবলিতে তাকলাগানো উৎসবের মেজাজ ছিল অযোধ্যায়।
কিন্তু যোগীর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সেই ৬ লক্ষের বেশি মাটির প্রদীপের নীচে ছিল ‘দুর্নীতির অন্ধকার’-ও। তা কি কেউ জানত?