বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই ২০১৪ সালের মে মাসে ডলারের বিনিময়ে টাকার মূল্য কত ছিল? এক ডলারের মূল্য ৫৮ টাকা। লোকসভা ভোটের প্রচারে বিজেপি কী বলেছিল? তারা বলেছিল, ক্ষমতায় এলে এক ডলারের বিনিময় মূল্য কমে গিয়ে ৪৫ টাকায় নেমে আসবে। আজ এক ডলারের বিনিময়ে টাকার মূল্য কত? ৭৫ টাকা।
নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছিলেন ২০১৪ সালে, তখন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কত ছিল? ৯.২৫ শতাংশ। আজ কত? ৫ শতাংশের আশপাশে।
নরেন্দ্র মোদি যখন ড.মনমোহন সিংকে হারিয়ে দিয়ে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন কলকাতা থেকে দিল্লির রাজধানী এক্সপ্রেসের ভাড়া কত ছিল? এসি থ্রি টায়ারের ভাড়া ছিল, ১৫১৪ টাকা, এসি টু টায়ারের ভাড়া ছিল ২১৯৭ টাকা। এসি ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া ছিল ৩৮১৩ টাকা। আজ রাজধানী এক্সপ্রেসের ভাড়া কত? এসি থ্রি টায়ারের ভাড়া ৩০৩৫ টাকা। এসি টু টায়ারের ভাড়া ৪২৪৫ টাকা। এসি ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া ৪৮৮৫ টাকা। ২০১৪ সালের আগে যাঁরা রাজধানী এক্সপ্রেসে সফর করেছেন, তাঁরা মনে করতে পারবেন সেই সময় গোটা জার্নিতে খাবার এবং অন্য সুযোগ কী কী পাওয়া যেত।
আর আজ কী কী পাওয়া যায়।
নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সময় প্রতিদিন রান্নার কাজে ব্যবহৃত নানাবিধ ভোজ্য তেলের দাম কত ছিল? ৬০ থেকে ৬৮ টাকার মধ্যে। আজ কত? ১৫৫ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে বা তারও বেশি।
২০০৮ সালের মুম্বই হামলার পর যতক্ষণ না পাকিস্তান কোনও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর পাকিস্তান সফর করার প্রশ্নই ওঠে না। যদি তিনি করেন সেটা হবে দেশের জন্য শহিদদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং সন্ত্রাসে প্রাণ হারানোর প্রতি অসম্মান। এই ছিল ভারতীয় জনতা পার্টির ঘোষিত অবস্থান। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি কী করেছিলেন? পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। সেখানেই শেষ নয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাবুল থেকে ফেরার পথে আচমকা বিনা আমন্ত্রণে, বিনা সরকারি অ্যাজেন্ডায়, বিনা আন্তর্জাতিক শিডিউলেই নওয়াজ শরিফকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন লাহোর।
এই নিবন্ধের শুরু থেকেই যে ২০১৪ সাল এবং ২০২১ সালের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিতুলনা করা হচ্ছে এর কারণ কী? কারণ হল, একটু মনোযোগ দিলে বিশ্লেষণ করা যাবে যে, একেবারেই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগবে, স্বস্তি দেবে, সংসার চালানোর সুরাহা দেবে, একটু সাশ্রয় আসবে, এরকম বিষয়গুলি ২০১৪ সালে কেমন ছিল এবং এখন কেমন আছে সেটার দিকে চোখ ফেরানো। পেট্রল, ডিজেল, ডলারের বিনিময় মূল্য, ট্রেনের ভাড়া, রান্নার তেলের দাম, ব্যাঙ্কের সুদের হার এসব কম থাকলে মানুষের উপকার হয়, নাকি হয় না? এটা বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না। তাহলে ওই শুরু নমুনাগুলি থেকে কী মনে হচ্ছে? সাত বছর হয়ে গেল, মোদির আমলে সুখের দিন এসেছে? নাকি দুঃখের দিন? আমাদের মতো আম জনতার সংসার চালাতে কষ্ট বেড়েছে? নাকি কমেছে? পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হয়েছে? নাকি আরও খারাপ? প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে এবার দেখা উচিত ২০১৪ সালের পর কী কী হয়েছে নরেন্দ্র মোদির আমলে? সেগুলিরও ভালোমন্দ বিচার করা উচিত।. অবশ্যই উচিত।
পুরনো ৫০০ এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সেই সিদ্ধান্তের পর আজ ২০২১ সালে আমাদের জীবনে আদৌ কী কী বদল এসেছে? আমাদের আয় বেড়েছে? আমাদের আশপাশে কালো টাকার রমরমা কমে গিয়েছে? সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হয়ে গিয়েছে? হঠাৎ অবৈধ উপায়ে বড়লোক হওয়ারা দলে দলে গরিব হয়ে গিয়েছে আমাদের চোখের সামনে? আমাদের ছেলেমেয়েদের চাকরি পাওয়া সহজ হয়েছে? ভারতের অর্থনীতি আরও উন্নত হয়েছে নাকি আরও ডুবে গিয়েছে? বহু ছোট কারখানা তৈরি হয়েছে? নাকি লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ক্যাশ টাকার অভাবে? প্রশ্নগুলির উত্তর আমাদের জানা। সে আমরা বিজেপির সমর্থকই হই, অথবা বিরোধী।
কাশ্মীর থেকে ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ অবলুপ্তি করে দেওয়া হয়েছে ২ বছরের বেশি হয়ে গেল। কাশ্মীরের চরিত্রকে বদলে দেওয়া হয়েছে পূর্ণ রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে পর্যবসিত করে দিয়ে। দু’বছর পর কাশ্মীরের কী পরিবর্তন হয়েছে? সন্ত্রাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে? কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং বহিরাগতদের বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে কেন? তার মানে কী? মানে হল, সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল হয়তো, কিন্তু প্রশাসনিক সুস্থিতি উপহার দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের মেকানিজম ব্যর্থ।
রামমন্দির নির্মাণ করা শুরু হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর। নোটবাতিল, ৩৭০ নং এবং রামমন্দির। তিনটির কোনওটাই সাধারণ মানুষ কোনও বিরোধিতা করেনি। বিরোধীরাও নয়। সমর্থন করেছে সিংহভাগ। কিন্তু তার বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কী উপকার করেছে মোদি সরকার? কোন সুরাহা দিয়েছে?
কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, ডিআরডিও, এইমস, আইআইটি, আইআইএম, এনআইটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ইসরো, একঝাঁক স্টিল প্ল্যান্ট...কার আমলে হয়েছে? জওহরলাল নেহরুর আমলে। ভারত এখনও অনেকটাই চলছে নেহরুবাদী ব্যবস্থায়। নেহরুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে, দুর্দান্ত ফলাফল করে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, জীবিকা ও পেশাগতভাবে চূড়ান্ত সফল হওয়া বহু মানুষ আজকাল ৭০ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা যে সম্পূর্ণ খারাপ এরকম অভিমত পোষণ করে শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দিতে বলেন। সেমিনার করেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, ধ্যান ধারণা যে শিক্ষাব্যবস্থায় হয়েছে, সেটাই যে ব্যর্থ ও ভুল শিক্ষা প্রক্রিয়া, সেটাই বলে থাকেন তাঁরা।
ব্যাঙ্ক এবং বিমার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ কে করেছেন? ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তানকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ করে ১৯৭১ সালে নতুন একটি দেশের স্বীকৃতি দিয়ে এ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সবথেকে বড় ধাক্কা কে দিয়েছেন? ইন্দিরা গান্ধী। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি।
ভারতকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সঙ্গী করে বিপুল এক অর্থনীতির শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার দিকে কে ঠেলে দিয়েছিলেন? নরসিংহ রাও এবং মনমোহন সিং জুটি। ১৯৯১ সালে অর্থনীতির উদারীকরণের মাধ্যমে। সেই অর্থনীতির শক্তি ও নীতিতে আজও ভারত চলছে। আজ আমরা যা করে থাকি প্রযুক্তি কিংবা অর্থনৈতিকভাবে, সবই ওই একটি সিদ্ধান্তের সুফল।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি বলেছেন, স্বাধীনতার পর ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তা তিনি বলুন। মানুষ ওসব মনে রাখে না। কিন্তু মাননীয় মোদিজি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা তাঁর পূর্বসূরিদের করে যাওয়া কাজকর্মের কথা চিন্তা করে নিজে কী ভাবেন? তাঁর উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। কারণ, এখনও পর্যন্ত অর্থনীতি, সামাজিক, বিদেশনীতির গতিপথই বদলে যাবে, এরকম একটিও কোনও সিদ্ধান্ত কার্যকর করে উঠতে পারেননি তিনি। বড়সড় কোনও যুগান্তকারী কাজই করে উঠতে পারলেন না। পাকিস্তান শিক্ষা পেল না, চীন ভয় পেল না, ভারত জগৎসভায় সেরা হল না, শান্তিপূর্ণ কাশ্মীর হল না, সম্পূর্ণ নতুন কোনও প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়নি। যা হচ্ছে সবই অতীতের এক্সটেনশন।
পরপর দু বার লোকসভা ভোটে জয়ী হওয়া কোনও সাফল্যের পরিচায়কই নয় ভারতে। ওসব ভারত দেখে ফেলেছে আগেই। নেহরু তিনবার জয়ী হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী পরপর দুবার জয়ী হয়েছিলেন। মনমোহন সিং পরপর দুবার জয়ী হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কিছু না কিছু বড়সড় কাজ করে যাওয়ার দাগ রেখে গিয়েছেন ইতিহাসে। মোদিজির হাতে আর মাত্র ২ বছর। তিনি রাজনৈতিক কেরিয়ারের স্লগ ওভাবে ঢুকে পড়েছেন। নরেন্দ্র মোদির প্রকৃত টেনশন এখন থেকে শুরু হচ্ছে। তাঁর কোন কাজটি মনে রাখবে ইতিহাস? কী নিয়ে আলোচনা হবে ২০৫০ সালে? কী বৃহৎ কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে? ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। কোনও উচ্চগ্রামের প্রচার, কোনও হাই ভোল্টেজ বিজ্ঞাপন, কোনও পারিষদের জয়ধ্বনি, কোনও প্রোপাগান্ডাই কালজয়ী হয় না। যাবতীয় ক্ষুদ্রতা ও মিডিওক্রিটি মুছে যায় সময়ের জলস্রোতে!