বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
১৯৭৫ সালের ২৬ জুন দিনটির কথা মনে আছে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। ওইদিন দেশে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পরামর্শে ইন্দিরা গান্ধীর কথায় রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ এই ‘কালা কানুন’ জারি করেছিলেন। রাজনারায়ণের করা মামলায় নির্বাচনী দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এলাহাবাদ হাইকোর্ট যেদিন সেই রায় দিয়েছিল ঠিক সেই দিনই গুজরাত বিধানসভা ভোটের ফল বেরিয়েছিল। আর তাতে কংগ্রেস হেরে গিয়েছিল। একের পর এক ঘটনায় বোঝা যাচ্ছিল, কংগ্রেসি দুর্গের ভিত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। শুধু ধাক্কা দেওয়ার অপেক্ষা। সেই উদ্দেশ্যে যখন দেশের বিরোধী দলগুলি আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই জারি করা হয় জরুরি অবস্থা।
যে কোনও ‘কালা কানুন’ লাগুর লক্ষ্য একটাই, সরকারের গদি বাঁচানো। কিন্তু মজাটা হল, সবটাই চালানো হয় দেশের সুরক্ষা অথবা মানুষের স্বার্থের কথা বলে। তবে, আইন করে, দমনপীড়ন চালিয়ে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে সরকারের কাজকর্মের ধারা বদলাতে হয়। আর সরকার নিজেকে না বদলালে মানুষই সরকার বদলে দেয়। এটাই নিয়ম। তাই ব্যাঙ্ক, কোলিয়ারি জাতীয়করণ সহ বহু ভালো কাজ
সত্ত্বেও ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ ইন্দিরা গান্ধীকে ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়েছিল। মোদিজি, এই ইতিহাসটা স্মরণে রাখলে আপনারই মঙ্গল।
এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে সমস্ত সংস্কার ও নয়া আইন চালু করেছে, তার বেশিরভাগই মানুষের ক্ষতি করেছে। কিন্তু, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই আইন লাগু করার সময় দেওয়া হয়েছে জনস্বার্থের দোহাই। জরুরি অবস্থা জারির পর বেতার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধীও ‘জনস্বার্থে’র দোহাই দিয়েছিলেন, এখন নরেন্দ্র মোদিজিও সেটাই করে চলেছেন।
নোট বাতিলের সময় মোদিজি শুনিয়েছিলেন ‘কালা ধন’ নিকেশের গল্প। গোটা দেশকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। চালু করেছিলেন এক হাজার টাকার পরিবর্তে দু’ হাজারি নোট। তবে, সেই নোট বাজারে খুব বেশি দেখা যায় না। নিন্দুকেরা টিপ্পনি কেটে বলছেন, নোট বাতিলে সাধারণ মানুষের
ক্ষতি হলেও কালো টাকার মালিকদের লাভ হয়েছে বিস্তর। এখন একই জায়গায় দ্বিগুণ টাকা ধরে যাচ্ছে। এই না হলে ‘জনস্বার্থ’!
বিরোধীদের যাবতীয় প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে পাশ করা হল কৃষি বিল। বলা হল, কৃষকের স্বার্থেই কৃষি আইন। চাষি ফসলের ন্যায্য দাম পাবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অর্থাৎ অবাধ মজুতদারির ছাড়পত্র। পরিণতি, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় বহু জিনিসপত্রের দাম ১০০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গিয়েছে। আফগানিস্থানে বোমা পড়লে এখানে পোস্তর দাম বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ নাকানিচোবানি খাচ্ছে। মানুষ বিজেপিকে আর পছন্দ করছে না। তাই একের পর এক নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হচ্ছে। তবুও নিজেদের শোধরানোর কোনও চেষ্টা নেই। উল্টে ক্ষমতায় ফিরতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে নির্লজ্জভাবে কাজে লাগাচ্ছে।
মাত্র ৬ ঘণ্টার নোটিসে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে কোটি কোটি মানুষকে বিপদে ফেলেছিলেন মোদি। কিন্তু তখন তাঁর রাজ্যের সঙ্গে আলোচনার কথা মনে ছিল না। নোট বাতিলের সময়েও একই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। আর পেট্রল-ডিজেলের জিএসটি লাগুর কথা উঠলেই রাজ্যের মতামত নিচ্ছেন। আহা, কত বড় ‘গণতন্ত্রপ্রেমী’।
আসলে এই সবই রাজনীতির কৌশল। বিজেপি সব সময় ‘গাছেরও খাব তলারও কুড়াবো’ নীতি নিয়ে চলে। পেট্রপণ্যে জিএসটি লাগু করলে রাজ্যের কোষাগারে যেমন টান পড়বে, তেমনই কেন্দ্রের আয়ও বিপুল কমবে। বিজেপি যদি সত্যিই পেট্রপণ্যে জিএসটি লাগু করতে চায় তাহলে যে সব রাজ্যে তাদের সরকার আছে সেখানেই করতে পারে। সেটা করলেই তো বিরোধীদের হাতে থাকা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা চাপে পড়ে যাবেন। তখন তাঁরাও পেট্রপণ্যে জিএসটি মেনে নিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু, সেটা বিজেপি করছে না। এ থেকে প্রমাণ হয়, মানুষকে দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়া নয়, রাজনীতি করাই বিজেপির উদ্দেশ্য।
অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর কৌশলটা মোদিজির কাছেই শিখতে হবে। পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির দায় সুচতুরভাবে তিনি রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন। অর্থমন্ত্রী বলছেন, রাজ্যগুলি চাইছে না বলেই পেট্রপণ্যে জিএসটি লাগু হচ্ছে না। ভাবখানা এমন, যে ব্যাপারে কেন্দ্র-রাজ্য স্বার্থ জড়িয়ে আছে সেবিষয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া মোদিজির সরকার একটি পা ফেলে না। আচ্ছা, যেভাবে নোট বাতিল করেছেন, যেভাবে কাশ্মীরে ৩৭০নং অনুচ্ছেদ বিলোপ করেছেন, যেভাবে কৃষি আইন করেছেন, সেই একইভাবে পেট্রপণ্যে জিএসটি লাগু করছেন না কেন? কেন্দ্র যদি বলে পেট্রপণ্যেও জিএসটি লাগু করা হল। তাহলে তাদের কে ঠেকাবে?
বিজেপির প্রতিটি পদক্ষেপেই থাকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি। পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব এবং অসমে বিএসএফের ক্ষমতা বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে পাকা মাথার অঙ্ক। নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতারা বুক ফুলিয়ে একটা কথা বলতেন, এবারের ভোট ‘দিদির পুলিস’ দিয়ে হবে না, ‘দাদার পুলিস’ ভোট করাবে। বিজেপি নেতাদের দাদার পুলিসের উপর বড় ভরসা। কারণ তারা অনায়াসেই ঘটিয়ে দিতে পারে ‘শীতলকুচি’। গুলি করে মারা জলভাত। এবার সেই ‘দাদার পুলিস’কেই বঙ্গের ১০টি জেলার ২১টি লোকসভার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকায় খবরদারির ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হল।
বাংলার নির্বাচনের পর বিজেপির ছন্নছাড়া অবস্থা। নীচের তলায় ঝান্ডা ধরার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। দলের এমএলএ, এমপিরাও তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। বিজেপি কর্মীরা প্রাক্তন আর বর্তমান রাজ্য সভাপতির সামনেই মারামারি করছেন। এই অবস্থায় বিজেপির ভরসা সেই এজেন্সিই। বিএসএফকে সামনে রেখে সীমান্ত এলাকায় ঘর বাঁচানোর চেষ্টা চালাবে। কারণ বিজেপির দিল্লির নেতারা খুব ভালো করেই বুঝেছেন, বিধানসভা ভোটের পর যেভাবে ভাঙন এবং বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে তাতে লোকসভা ভোটে হালে পানি পাবে না। তাই বিএসএফকে সামনে রেখে এলাকা কব্জা করার চেষ্টা চালাবে। আর তার প্রতিবাদ করলেই উঠবে চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযানে ও দেশের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ।
তবে, বিএসএফ এখনই খুব বেশি লাফঝাঁপ করবে না। এখন থেকে এলাকা ধরে ধরে নামের তালিকা তৈরি করবে। মাঝেমধ্যে তল্লাশির নামে পরিচয়পত্র দেখতে চাইবে, চমকাবে। আসল খেলাটা শুরু করবে লোকসভা নির্বাচনের আগে।
কোচবিহার জেলার রাজনীতিতে জঙ্গি নেতা হিসেবে নিশীথ প্রামাণিকের উত্থান। মারদাঙ্গা তো বটেই, অভিযোগ খুনের ঘটনাতেও জড়িয়েছে তাঁর নাম। সীমান্ত এলাকার চোরাচালান, বিভাজনের রাজনীতি তাঁর খুব ভালো করে জানা। সেই নিশীথবাবু এখন ‘দাদার পুলিসে’র হর্তা কর্তা বিধাতা। নয়া বিজ্ঞপ্তি তাঁর সামনে এনে দিয়েছে রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়ি ঘোরানোর আইনি অধিকার।
কথায় আছে, কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। বঙ্গে বিজেপি পরাস্ত হওয়ায় দিলীপ ঘোষের কপাল পুড়লেও কপাল খুলে গেল নিশীথ প্রামাণিকের। অমিত শাহের ‘জহুরির চোখ’। তাই নিশীথবাবুকেই যোগ্য সহযোগী ঠাওরেছেন। এমনিতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রীদের তেমন কিছু কাজ থাকে না। কিন্তু, অমিত শাহ বিএসএফের কর্তৃত্ব করার এলাকা বাড়িয়ে নিশীথবাবুর ‘কাজ করার’ জায়গাটা তৈরি করে দিলেন।
অমিতজি, ফন্দি এঁটে, বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য নিত্যনতুন কৌশল বের করে আপনি বড়জোর ‘চাণক্য’ হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হতে পারবেন না। কারণ দলকে সঙ্কট থেকে বের করে আনার ফর্মুলা আপনার জানা নেই।