বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
খারাপ হয়ে যাও
১৯৪৮ সালের বিশ্ববাস্তবতাকে ধারণ করে এই নথির প্রস্তাবনা এবং ইউডিএইচআর নথিভুক্ত করা কেন প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে দেয়। কারণ ‘‘মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞার ফলে সংঘটিত বর্বরোচিত কাজকর্ম যা-সব হয়েছে তাতে মানবজাতির বিবেকের অসম্মান হয়েছে ...।’’ ১৯৪৮ সালের সত্যটি ২০২১ সালেও সত্য। হতে পারে যে এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিছু দেশে কিন্তু ভারতসহ অন্যকিছু দেশে এটির অবনতিই হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির ঘটনাটি দিয়ে শুরু করা যাক। কৃষি সংক্রান্ত তিনটি আইনের প্রতিবাদ করছিলেন কৃষকরা, প্রকৃতপক্ষে যেটি সংসদের মাধ্যমে চেপে বসেছে। মিছিলকারীদের পিছনে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা একটি কনভয়ের গাড়ি (যার মধ্যে অন্তত দুটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে) চার বিক্ষোভকারীকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এরপর তা থেকে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ জনতার হাতে ওই গাড়ির তিন সওয়ার ধরা পড়ে, তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। একজন সাংবাদিকও মারা গিয়েছেন। প্রধান গাড়িটি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর (এমওএস)। অভিযোগ উঠেছিল যে তাঁর ছেলে ছিল গাড়ির দখলদারদের একজন। এই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ইউডিএইচআর-এর অনুচ্ছেদ ১৯ ঘোষণা করে যে, ‘‘প্রত্যেকেরই মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার রয়েছে; এই অধিকারের মধ্যে রয়েছে কোনওরকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই মতামত রক্ষার স্বাধীনতা ...।’’ অনুচ্ছেদ ২০ ঘোষণা করে যে ‘‘প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার ও সমাবেশ করার স্বাধীনতা রয়েছে।’’ আন্দোলনকারী কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হয়েছিলেন এবং কৃষি আইন সম্পর্কে তাঁদের মতামতের প্রকাশ ঘটেছিল মিছিলটিতে। অনুচ্ছেদ ৩ ঘোষণা করে যে ‘‘প্রত্যেকেরই জীবন, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।’’ দ্রুতগতির গাড়িটি মুহূর্তের মধ্যে তিনটি জীবনদীপ নিভিয়ে দিল। লখিমপুর খেরিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এখনও নীরব রয়েছেন।
কর্মীরা জঙ্গি!
২০১৮ সালে সংঘটিত মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ের একটি ঘটনায় ফেরা যাক। ২০১৮ সালের ৬ জুন পাঁচ সমাজকর্মীকে পুলিস গ্রেপ্তার করে। ২০১৮-র জানুয়ারিতে ভীমা কোরেগাঁওয়ে সংঘটিত একটি জাতিগত হিংসায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। ওই পাঁচজন কারা ছিলেন? একজন আইনজীবী, একজন ইংরেজির অধ্যাপিকা, একজন কবি ও প্রকাশক এবং দু’জন মানবাধিকার কর্মী। তাঁরা এখনও কারাবন্দি। তাঁদের জামিনের আর্জি বারবার খারিজ হয়েছে (২০১৮-র ২৮ আগস্ট আরও পাঁচ সমাজকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে)। ‘সাইবার আইন এবং মানবাধিকার’ খতিয়ে দেখার অনুমতি চেয়েছিলেন আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং। তাঁর আর্জি খারিজ করা হয়েছে। অভিযোগ জানাবার একবছর পর ইংরেজির অধ্যাপিকা সোমা সেনের সেলে একটি চেয়ার দেওয়া হয়েছে। তাঁর আর্থারাইটিসের সমস্যা রয়েছে জানা সত্ত্বেও মেঝেতে পাতা একটি পাতলা ম্যাট্রেসে তাঁকে শুতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রথম কয়েক মাস তাঁকে অপরাধীদেরই সঙ্গে রাখা হয়েছিল। অধিকাররক্ষা কর্মী মহেশ রাউতের আলসারেটিভ কোলাইটিসের জন্য তাঁর পরিবারের তরফে কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধ আনা হয়, সেগুলিও তাঁকে দিতে দেওয়া হয়নি। কবি ও প্রকাশক সুধীর ধাওয়ালে তাঁর সহকর্মী এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাননি। কারণ কী? তাঁদের সঙ্গে তো তাঁর রক্তের সম্পর্ক নয়! ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে ক্রিমিনাল প্রসিডিংস হয়েছে, ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি, তাতে ১৬টি আইন লঙ্ঘনের বিষয় চিহ্নিত করেন সাংবাদিক প্রতীক গোয়েল। এর মধ্যে রয়েছে মারাত্মক রকমের কিছু বাড়াবাড়ি, যেমন ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি এবং বাজেয়াপ্তকরণ; ট্রানজিট রিমান্ডের আদেশ ছাড়াই একজন বন্দিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া; বন্দিকে তাঁর পছন্দের আইনজীবী দেওয়ার দাবি খারিজ করা; হাসপাতালে একজন বন্দির চিকিৎসার খরচ বহনের দায় গ্রহণে রাজ্যের তরফে অস্বীকার; একজন বন্দিকে তাঁর মেডিক্যাল রিপোর্ট দিতে অস্বীকার করা; আর্থারাইটিসে আক্রান্ত একজন বন্দির জন্য কমোড চেয়ার দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করা; একটি ফুল-স্লিভ সোয়েটার দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করা; স্বামী বিবেকানন্দ রচিত বইপত্র দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করা; বিজেপি সরকারকে সরিয়ে মহারাষ্ট্রে নতুন এক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার দিন দুই পর মামলাটি একতরফাভাবে মহারাষ্ট্র পুলিসের হাত থেকে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সিকে (সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড ও অপরাধের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সংস্থা) হস্তান্তর করা হয়; এক বন্দির তরফে তাঁর মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার জন্য প্যারোলের দাবি প্রত্যাখ্যান করা; এবং এইরকম আরও কিছু।
বিচারের আগেই শাস্তি
ইউডিএইচআর-এর প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেগুলি পড়ুন, অন্যান্য সবকিছুর মধ্যে, নিম্নরূপ:
অনুচ্ছেদ ৫: কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হতে হবে না।
ধারা ৯: গ্রেপ্তার, আটক বা নির্বাসনের ব্যাপারে কাউকে স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হতে হবে না।
অনুচ্ছেদ ১০: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে স্বচ্ছতার সঙ্গে গৃহীত পাবলিক হিয়ারিংয়ে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার স্বীকৃত—তাঁর অধিকার, দায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত যেকোনও ফৌজদারি অভিযোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে।
অনুচ্ছেদ ১১: একটি পাবলিক ট্রায়ালে আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না-হওয়া পর্যন্ত, দণ্ডনীয় অপরাধে অভিযুক্ত, প্রত্যেকেরই নির্দোষ বলে মনে করার অধিকার আছে ...।
আমি যত দূর জানি, গত তিন বৎসরাধিককালে প্রধানমন্ত্রী ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বন্দিদের মানবাধিকার নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি। এমনকী এনআইএ নামক যে সংস্থার দায়িত্বে তিনি রয়েছেন তার তরফে এই মামলার অভিযোগ গঠনে দীর্ঘ বিলম্বের কারণ নিয়েও তিনি নিশ্চুপ। বলা বাহুল্য যে, এই মামলার ট্রায়াল বা বিচার এখনও শুরু হয়নি।আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যখন তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের মানসিকতা মানবাধিকারের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে।’’