বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
শীর্ষ পদ ছুঁয়ে ফেলার আগে পথটা কি আদৌ মসৃণ ছিল?
চলার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। নানাসময় নানারকম লড়াই করতে হয়েছে। তবে তার পাশাপাশি বলব, বিরাট বা ভয়ঙ্কর নাটকীয় কোনও বাধা এসে আমায় আটকে দিয়েছে, এমন নয়। আমি ভাগ্যবান, চারপাশ থেকে অনেকটাই সহযোগিতা পেয়েছি। তাই বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতেও পেরেছি। কিন্তু মহিলা হওয়ার জন্যই সব বাধা তৈরি হয়েছে, এটা আমি বলব না। হয়তো এমন কোনও পদক্ষেপ করতে হয়েছে যেটা একজন পুরুষকে করতে হতো না, কারণ তাঁর সেটা করার দরকারই পড়ত না। তবে আমি তো শুধু একজন মহিলা বিজ্ঞানী নই, আমি মা, স্ত্রী, একমাত্র পুত্রবধূ এবং নিজের বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। এতগুলো দায়িত্ব ছিল। তার জন্য কেরিয়ারে প্রভাবও পড়েছে। তবে আমার মতে, মহিলারা যখন মনে করেন, কোনও লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন, তখন তাঁরা একেবারে সাহসী এবং নির্ভীক হয়ে যান। এই একরোখা একগুঁয়েমি ভাবটা আমার মধ্যে ছিল। অনেক দ্বন্দ্বের মধ্যেও সেই ভাবনাটা ঠিক এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই যে কোনও বয়সের মেয়ের এটা মনে রাখা উচিত, নিজের মধ্যেকার শক্তিটা হারিয়ে ফেলা যাবে না কিছুতেই। আমি হয়তো একটা জিনিস প্রাথমিকভাবে পারব না, কিন্তু ছাড়বও না। বলা ভালো, শেষ দেখে ছাড়ব।
![](https://bartamanpatrika.com/userfiles/1630675004_pic8.jpg)
ভবিষ্যতে জেডএসআইতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য আপনি কী ভেবেছেন?
কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং বায়ুপরিবর্তন মন্ত্রকের অধীনে জেডএসআইয়ে কিন্তু অনেক মহিলাই এসেছেন। মহিলাদের বিজ্ঞানী হিসেবে অংশগ্রহণ বেড়েছে ২০-২১ বছর আগে থেকেই। তারপর থেকে যত রিক্রুটমেন্ট হয়েছে, তার মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ মহিলা আছেন। আলাদা করে মহিলাদের নিয়োগ করার জন্য তাই কিছু করতে হয় না।
বিজ্ঞানে মহিলারা কম উৎসাহী। এ অভিযোগ বহুদিনের। এখন ধারণাটা অনেকটা পাল্টালেও মুছে যায়নি, কী কারণ এর জন্য দায়ী বলে আপনার মনে হয়?
মেয়েদের উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রেই খুব অভাব রয়েছে। শহরে এটা এতটা বোঝা যায় না। কিন্তু গ্রামের দিকে গেলে বোঝা যায়। বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য অনেক সময়ই ভালো শিক্ষক পায় না মেয়েরা। একেকটি জায়গায় অবশ্যই অনেক দক্ষ মনোযোগী শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু একটা বড় অংশে মেয়েরা সেই সুযোগটা পায় না। আমি এটা বুঝতে পারি বাড়ির পরিচারিকার সঙ্গে কথা বলে। ওদের ছেলেমেয়ে বা নাতিনাতনির পড়াশোনা নিয়ে প্রশ্ন করলে বলে, স্কুল থেকে ঠিকমতো গাইড করে না, ভালো শিক্ষক শিক্ষিকাও নেই। এটাই তো বড় বাধা। আর গ্রামে এমনিতেই মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে লোকে ভাবে কম। ভাবে রান্না শিখুক বা বিয়ে হবে। আর একটা অংশ আছে মোবাইল দেখবে, কিন্তু পড়াশোনায় মাথা ঘামাবে না। শহরে চিত্রটা আলাদা। সেখানে অনেক বেশি সংখ্যক মেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, ইচ্ছেটা থাকা সত্ত্বেও হয়তো জেদটা থাকে না, তাই অনেকে পিছিয়ে পড়ে। কিছুই তো সহজে পাওয়া যায় না জীবনে। তা সে পুরুষ হোক বা মহিলা, প্রত্যেকেই তার মতো করে চেষ্টা করে। এটা ঘটনা যে, মেয়েদের মাথায় অনেক বেশি দায়িত্ব দিয়ে বড় করা হয়। তাই মেয়েদের মনে সেই সব আনুষঙ্গিক বিষয় অনেকটা জুড়ে থাকে। তাতে জেদ বা লক্ষ্যটা ধাক্কা খায়। একইসঙ্গে মেয়েরা যে মাল্টিটাস্কিং করতে পারে, সেটাও তৈরি হয়ে যায়। এটা কিন্তু পুরুষরা পারে না।
বিভিন্ন পেশা অথবা গবেষণার ক্ষেত্রে মহিলারা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নানাভাবে। সমাজে একাংশ মহিলাদের অবদান স্বীকার করে নিলেও তলায় তলায় সেই চেপে দেওয়ার ব্যাপারটা খুবই প্রকট। কীভাবে লড়বেন মেয়েরা?
দেখুন লিঙ্গবৈষম্য এমনি এমনি একদিন চলে যাবে না। এটা বিশ্বজুড়ে চলে। ধরে নিতে হবে এটা একটা বাধা, যেটা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সেইভাবেই তো নিজেকে মোটিভেট করতে হয়। পুরুষদের মধ্যে একটা আত্মতুষ্টি চলে আসে, তাদের মনে হয় আমি যোগ্য হলেই সুযোগ পাব। এই আত্মতুষ্টিটা মেয়েদের মধ্যে আসে না। কারণ তারা জানে তারা যোগ্য বলেই শুধু তাদের লড়াই করতে হয় না, তাদের চারপাশে যে অনেকে অযোগ্য, এটা প্রমাণ করার জন্যও তাদের লড়তে হয়। এটা বড় লড়াই। আর এটা সবসময় থাকবে।
আপনি নিজে একজন মা। বলা হয় জীবনের প্রথম শিক্ষা শিশু পায় তার মায়ের কাছ থেকে। সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় রাখা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
আমার এক মেয়ে। ওর গায়ে হাত তুলিনি কোনওদিন। বকিওনি। আমি বরাবরই ওয়ার্কিং মাদার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম। আমার মা আমায় বলেছিলেন, ‘তুই মেয়েকে সারাদিনে কতটা সময় দিস যে তুই দেখা হলেই শাসন করবি?’ সেই কথাটা মাথায় রেখেছিলাম। আমি নিজে ছোটবেলার মারধোর খাইনি, তা কিন্তু নয় (হাসতে হাসতে)। তবে তখন সময়টা অন্যরকম ছিল। মা আমায় বোঝালেন, ‘যেটুকু সময় মেয়েকে দিচ্ছিস, সেটা বকেঝকে নষ্ট করিস না। তাতে তুই বাড়ি ফিরলে ওর খুশিভাবটা চলে যাবে।’ সেটা বুঝেছিলাম। আর আমি ভাগ্যবান, মেয়ে খুব ভালো মানুষ হয়েছে। একটা কথা ওকে ছোট থেকে বুঝিয়েছি, প্রত্যেকের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। জীবন যতই কঠিন হোক, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। মানুষের প্রতি যত্নবান হবে। এটা থাকলেই দায়িত্ববোধ আসে। আমি চেয়েছিলাম ও ছোট থেকেই বুঝুক, ওর চারপাশে যারা রয়েছে, তাদের কতটা গুরুত্ব। তারা না থাকলে ওর কতটা অসুবিধে হবে। এই বিষয়টা আমি নিজেও বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। জীবনে তার ফলও পেয়েছি। আমার চারপাশের মানুষজনের সহযোগিতা পেয়েছি বলেই অনেক কাজ সহজ হয়ে গিয়েছে।
পরিবারের সমর্থন না পেলে কাজের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। আপনি সেটা পেয়েছেন। কিন্তু মহিলাদের একটা বড় অংশের লড়াই শুরু হয় ঘর থেকেই। অনেকে একারণে থমকে যান। কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়। মনের জোর কীভাবে পাবেন তাঁরা?
ওই যে বললাম, হাল ছেড়ো না। ওটাই মন্ত্র। লেগে থাকতে হবে। কিছু না কিছু হবেই। এটা আমার বিশ্বাস। সবসময় যে লক্ষ্য ঠিক করা থাকে, তা নয়। আমি যখন জেডএসআই জয়েন করি, তখন আমার ২৮ বছর বয়স। আমি তো ভাবিনি ৫০ বছর বয়সে ডিরেক্টর হব। কিন্তু যা করেছি, সিরিয়াসলি করেছি। ভালো ছাত্রী ছিলাম, সেটা একটা সুবিধা হয়েছে। জীবনে ওঠা-পড়া তো থাকবেই। মসৃণ রাস্তা দিয়ে কেউ হাঁটে না সারাজীবন। দেখবেন যার কেরিয়ার খুব মসৃণ, তার বাড়িতে হয়তো সমস্যা রয়েছে। আর একটা বড় কথা, জীবনে কিছু জিনিস ছেড়ে দিতে শিখতে হয়। কারণ অনেকে এমন থাকবে যারা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে বা আমার বিরুদ্ধে কিছু করবে। আর আমি একটা বিশেষ পদমর্যাদায় পৌঁছনোর পর ভাবব, তাদের শিক্ষা দেব— না, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় মা কানে কানে বলেছিলেন, ‘বোবার শত্রু নেই।’ কেরিয়ার-অফিস কিংবা ব্যক্তিগত জীবন, সব জায়গায় এটা আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। অনেক বিষয় থাকে, যা নিয়ে মুহূর্তের অসাবধানতায় আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এটা করতে নেই। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করব। কিন্তু সব কিছুকে গুরুত্ব দিতে নেই। সামনে কোনও বাধা এলেই ভাবব, এটা আমার সঙ্গেই কেন হচ্ছে? বাধাটাকে এত বড় করে কেন দেখব? সেটা পেরিয়ে যে রাস্তাটা পাব, সেটার কথা কেন ভাবব না? মেয়েদের সেটা মাথায় রাখতে হবে।
মেয়েরা মেয়েদের পাশে থাকলে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ পিতৃতন্ত্রের বুলিটাও মেয়েদের দিয়েই বলিয়ে নেয়। কীভাবে একে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন মেয়েরা?
একজন মেয়ের গোটা জীবন আর একজনের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। তোমার রাস্তাটা দুর্গম দেখে আমি পিছিয়ে যাব না। আমার রাস্তাও দুর্গম, পাথর ছড়ানো। পাথর ডিঙিয়ে যাব। সেগুলোকে সরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছব। এই রাস্তা খুঁজে পাওয়াটাই বড় ব্যাপার। বুদ্ধির ব্যাপার। কতটা মানিয়ে নিতে পারি পরিস্থিতির সঙ্গে, সেটা দেখব। কোনও একজনের কিছু পছন্দ নয় বলে সেটা নিয়ে লড়াই করতে নামব না। এগুলো করলে এক তো সময় নষ্ট, আর নয়তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইটা করা হয় না। আমরা মেয়েরা অনেক ছোট ছোট গন্ডিতে নিজেদের আটকে ফেলি। ধরুন একজন কর্মরতা মহিলা, তার খুবই ব্যস্ত জীবন। একদিন বাড়িতে পরিচারিকা এল না। মেয়েটি যদি বাড়ির লোকের সঙ্গে ঝগড়া করতে নামে, কেন আমি এত কাজ করব? তাতে সময়টাই বয়ে যাবে। সেখানে শান্তভাবে দেখলেই হয়, তার বেরনোর সময়ের আগে কতটা কাজ সে করতে পারবে। সেটা করে সে বলে দেবে, এই অবধি আমি করলাম। এবার তোমরা দেখো। তারপর সে কাজে বেরিয়ে যাবে। তা না হলে কিন্তু যুক্তি-তক্কে অনেকটা এনার্জি নষ্ট হয়ে যায়। সেই সময়টায় বরং গঠনমূলক কিছু করা অনেক ভালো। মেয়েরা সেটাই ভুলে যায়। আর একটা কথা, তুমি মানুষকে সাহায্য করো, সেই সাহায্য অন্য কারও থেকে হলেও ফিরে পাবে।
বিজ্ঞান ছাড়া কী কী ব্যাপারে আপনার উৎসাহ রয়েছে? অবসরে কী করতে পছন্দ করেন?
ছবি আঁকা, বই পড়া, গান শোনা এ সব তো আছেই। একটা সময় খুব বনসাঁই করতাম। আগে গানও করতাম। এখন ইচ্ছে আছে গ্রাফিক আর্ট শেখার।
সামনেই তো পুজো। এই সময়টা কীভাবে কাটান? পুজোর স্মৃতি বলতে কী মনে পড়ে?
আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। সেটা সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো পুজো। যাকে জোড়াবাড়ির সিংহবাহিনীর পুজো বলা হয়। পুজোর দিনগুলো, মানে পঞ্চমী থেকে দশমী আমার তুমুল ব্যস্ততা। নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ! সপ্তমীতে ঠাকুর বরণ থেকে শুরু করে দশমীর বরণ, বিসর্জন, ভোগ রান্না, নৈবেদ্য ঠিক করা, কলা বউ কী পরবে— সবেতেই আমি। বাপের বাড়িতে জীবনে এসব করিনি। বাইরের প্যান্ডেলে অঞ্জলি, খাওয়াদাওয়া ওই অবধি। শ্বশুরবাড়ির পুজোয় জড়িয়ে পরার পর বুঝলাম এটা অফিস জবের থেকে কিছু কম নয়! যখন থেকে এখানে এসেছি, এটা জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজো বড় ব্যাপার। তাই মহালয়ার আগে থেকেই প্ল্যানিং চলে। পুরো ডায়েরি ধরে। বিয়ের পরপরই অবশ্য এত দায়িত্ব ছিল না। শাশুড়ি বা পিসিশাশুড়ি সব দেখতেন। তখন আমার কাজ বলতে ছিল আলপনা দেওয়া, ঠাকুর সাজানো ইত্যাদি। হাতেকলমে এত কাজ ছিল না তখন! সঙ্গে গৃহদেবতা আছেন। দোল উৎসবেও আমাদের খুব জাঁকজমক। তারপর চারবার লক্ষ্মীপুজো, মনসাপুজো সবই হয়। আসলে কী জানেন, মেয়েদের তো নানা সময় প্রয়োজনমতো আলাদা আলাদা ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই পরিকল্পনা করে এগতে পারলে সবই সম্ভব। সেটা আমার বাবা বলতেন।