সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
ভোরের আলো ফোটার আগে দধিমঙ্গল দিয়ে যে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়, তারই সমাপ্তি ঘটে রাতের আনুষ্ঠানিক সিঁদুর দানের মাধ্যমে। তার মাঝে আরও অনেক পর্ব রয়েছে। গায়ে হলুদ, সপ্তপদী, শুভদৃষ্টি, মালাবদল— সব মিলিয়ে বাঙালি বিবাহ হয়ে ওঠে সোহাগ আর ভালোবাসার মধুর মিলনক্ষেত্র। অঞ্চল অনুযায়ী বিবাহ অনুষ্ঠানের এই নানারকম স্ত্রীআচারে কিছু অদলবদল ঘটে। কিন্তু বিবাহে যা চিরাচরিত তা হল অলঙ্কার। কুসুমে চন্দনে চর্চিত কনে বউটির সাজ গা ভরা গয়না পরলে তবেই সম্পূর্ণ হয়।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অলঙ্কারের নকশায় নানা বিবর্তন এসেছে। সোনার দাম হু হু করে বেড়েছে বলে গয়নার ওজন হাল্কা হয়েছে বটে, কিন্তু তার চাহিদার কমতি ঘটেনি। বাঙালি গয়নার নকশার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল এর কারিগরি কাজ। ভারতে তখন মোগল সাম্রাজ্যের আধিপত্য। গয়নায় কুন্দনের কাজের বাহুল্য। পোলকি, কুন্দন ইত্যাদি অবাঙালি স্টাইলে তৈরি হচ্ছে ভারী গয়নার নকশা। কিন্তু বাঙালি গয়নার কারুকাজ তার মধ্যেও নিজের স্বতন্ত্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তাই নকশায় অল্পবিস্তর মীনাকারি কাজের প্রচলন দেখা গেলেও সোনার সঙ্গে পাথরের মিলমিশ বাঙালি কনের অলঙ্কারে তেমন শোভা পায়নি, জানালেন আর চৌধুরী জুয়েলার্স-এর পার্টনার শ্রীপর্ণা চৌধুরী।
তাঁর কথায়, ‘বিয়ের গয়না একটু ভরাট না হলে দেখতে ভালো লাগে না। এদিকে সোনার দাম আকাশছোঁয়া। সেক্ষেত্রে অল্প সোনায় চওড়া গয়না বানানোর দিকেই আমাদের কারিগররা নজর দিচ্ছেন। তাই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং দামের দিকটাও খেয়াল রেখে দশ থেকে বারো গ্রাম সোনায় আমরা নেকলেস গড়াচ্ছি, সীতাহার তৈরি হচ্ছে আঠারো থেকে কুড়ি গ্রামে। হাতের গয়নাতেও হাল্কা ওজনের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। মানতাসা যেমন একটা খুবই প্রচলিত ও জনপ্রিয় বিয়ের গয়না। তার ওজন এখন কমিয়ে দশ থেকে এগারো গ্রাম করা হয়েছে। কিন্তু সেই ওজনে আগের মতো বড় মানতাসা বানানো সম্ভব হচ্ছে না। বরং তাকে একটু স্লিক নকশায় ছোট আকারে বানানো হচ্ছে। বালার ক্ষেত্রেও ওজন অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আট গ্রামে বালা তৈরি হচ্ছে। কানের দুলের ক্ষেত্রেও বদলটা চোখে পড়ছে। সাবেকি সাজের ধরন মাথায় রেখেই এখনও ঝোলা ঝুমকো দুলই বিয়ের কনের পছন্দ। কানবালার চলও আবার ফিরে এসেছে। আমাদের কারিগররা সব গয়নাই একটু হাল্কা ওজনে বানিয়ে দিচ্ছেন। তাতে কারুকাজের সূক্ষ্মতা সামান্য হলেও নষ্ট হচ্ছে।’
একটা নতুন ট্রেন্ড গত কয়েক দশক ধরে বাঙালি বিয়ের গয়নায় প্রাধান্য পেয়ে চলেছে তা হল হীরে। বছর কুড়ি বা বাইশ আগে হীরের গয়নার প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল বাঙালি কনেদের মধ্যে। তারা আংটি, কানের একটু ঝোলা দুল, সরু ব্রেসলেট, পেনডেন্ট ইত্যাদিতে হীরের সেটিং চাইতেন। সেই চাহিদাই ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। এখন তো শহুরে বাঙালি কনেরা বিয়েতে একটা হীরের সেট অনেক ক্ষেত্রেই রাখেন। আংটি বদল ক্রমশ বাঙালি বিয়েরও একটা অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে হীরের আংটির চাহিদা ক্রমবর্ধমান, জানালেন শ্রীপর্ণা। তিনি আরও বললেন এখন একটা ট্রেন্ড হয়েছে চোকার সেট। এতে বাঙালির সঙ্গে অবাঙালি নকশার সামান্য মিশেল দেওয়া হয়। এই গয়নাটি লেহেঙ্গার সঙ্গে খুবই ভালো লাগে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকাদের সাজেরও বিভিন্ন বিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা বিয়ের দিন বেনারসিতে সজ্জিত হলেও বউভাতে লেহেঙ্গা পরছেন। আর সেইমতোই গয়নার নকশাতেও পরিবর্তন আসছে। লেহেঙ্গার সঙ্গে একটা গলাভরা গয়নাই সবচেয়ে মানানসই। সেই মতোই ঝোলা দুল আর হাতে চুড় টাইপের কিছু। এ ধরনের গয়নাও তাই এযুগের কনেদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শ্রীপর্ণার কথার সঙ্গে অনেকটাই একমত হলেন অঞ্জলি জুয়েলার্স-এর কর্ণধার অনর্ঘ্য উত্তীয় চৌধুরী। এ যুগের কনেরা চোকার সেট পছন্দ করছেন বেশি, জানালেন তিনি। একটু চওড়া চোকার সেট তাঁদের খাস পছন্দ। তার সঙ্গে আবার অনেকেই টিম করে সীতাহারও পরতে চাইছেন। চওড়া চোকার আর লম্বা সীতাহার দারুণ লাগে বিয়ের বেনারসির সঙ্গে।
এছাড়াও হীরে তো আছেই। কেউ হীরের সেট কিনছেন কেউ বা একটু হাল্কার উপর হীরে বসানো মঙ্গলসূত্র চাইছেন, কেউ লোহা বাঁধানোতে হীরের নকশা খুঁজছেন। আর বিয়ের আংটির ক্ষেত্রে হীরে এখনকার কনেদের হিট চয়েস।
হীরে বা সোনার ট্রেন্ড যেমন বিয়ের গয়নায় চিরকালীন, তেমনই কিছু বদল কিন্তু কনেদের চাহিদায় এসেছে, বললেন অনর্ঘ্য। যেমন আগে বিয়ে মানেই ছিল সোনার গয়না, এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। বিয়ের অনুষ্ঠানের শুভসূচনা যাঁরা সঙ্গীত-এর মাধ্যমে করেন তাঁরা পোশাকের ক্ষেত্রেও লেহেঙ্গাই বেছে নেন। এবং অনেকক্ষেত্রেই সেদিন গয়না হিসেবে রাখেন কস্টিউম জুয়েলারিকে। পাশাপাশি আইবুড়ো ভাতের সকালে শাড়ির ধরন অনুযায়ী একটু ভারী রুপোর গয়নাও এ যুগের কনেদের সাজ সম্পূর্ণ করছে। তবে বিয়ে এবং বউভাত এই দুটি অনুষ্ঠানে সোনা মাস্ট। আর তাতেও আবার সাবেকি নকশার প্রচলনই বেশি। বিয়ের গয়নার ক্ষেত্রে আধুনিক কনেদের পছন্দ সামান্য হলেও বদলে গিয়েছে। যেমন এখনকার কনেরা অনেকেই একটু হাল্কা আধুনিক নকশার দিকে ঝুঁকছেন, জানালেন মডার্ন গিনি হাউসের অন্যতম কর্ণধার বাদল চন্দ্র ধর। সেক্ষেত্রে হীরের গয়নার চাহিদা বাড়ছে। যেমন হীরে বসানো চুড়ি, হোয়াইট গোল্ডের সঙ্গে কম্বিনেশনের হীরের পেনডেন্ট, কানের দুল ইত্যাদি। বা রোজ গোল্ডের সঙ্গে হীরে কম্বিনেশনে তৈরি ব্রেসলেট পেনডেন্ট সেট, এখন আধুনিক কনেদের মনে ধরছে। পাশাপাশি বাজেট একটু বেশি থাকলে হীরের সেটও কিনতে চাইছেন অনেক আধুনিক কন্যে। আবার অনেকে মনে করেন বিয়েতে শুধুই সোনার গয়না মানানসই। সেক্ষেত্রে বিয়ের সাজের সঙ্গে পরার জন্য তাঁরা একটু ভরাট নকশার সোনার গয়নাই চান। কিন্তু ভরাট নকশা হলেও ওজনে হাল্কা গয়নাই সকলে কিনছেন বিয়ের জন্য। তার মূল কারণ অবশ্যই মূল্যবৃদ্ধি। আবার খানিকটা আধুনিক চাহিদাও রয়েছে। আর আছে ফ্যাশন বিষয়ে ধারণা বদল। একইসঙ্গে হাল্কা গয়নায় একটু আধুনিক ডিজাইন খোলে বেশি। তবে একটা সময় ছিল যখন বিয়েতেও কনেরা স্লিক ডিজাইনের গয়নাই চাইতেন, এখন কিন্তু সেটা আর হয় না। বিয়ের সাজের সঙ্গে মানানসই ভরাট গয়নাই সবাই চায়।
সেই মতোই জহুরিদের কাছেও নকশার নানারকম পাবেন। বালার সঙ্গে সরু সলিড সোনার চুড়ি গড়ানোর ক্ষমতা অনেকেরই আজকাল থাকে না। সেক্ষেত্রে তাঁরা চওড়া পাতের ডিজাইনে হাতের গয়না গড়াতে চান। তাতে একটু ভরাট লুক আসে। আবার অনেকে শাঁখা এবং পলার সঙ্গে হাফ জালি কাজের সোনার নকশা করছেন। তাতে দামটাও একটু কম হচ্ছে। তারের কাজ আজও খুবই জনপ্রিয়। বিশেষত হাতের গয়নার ক্ষেত্রে। এখন একটা আধুনিক ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে ঝিনুকের গয়নায়। মাদার অব পার্ল (ঝিনুক)-এর সঙ্গে সোনার কম্বিনেশনে গয়না হচ্ছে।
‘আধুনিক কনেদের সব বিষয়েই একটা ভিন্ন ধারণা রয়েছে। স্বচ্ছ একটা চিন্তা নিয়ে তাঁরা চলতে ভালোবাসেন। অন্যের কথায় মত দেন না, ফলে গয়নার ক্ষেত্রেও তাদের চিন্তাটা খুবই স্পষ্ট। তাঁরা জানে বিয়েতে কেমন গয়না কোন সাজের সঙ্গে মানাবে। এবং সেই ধরনের গয়নাই গড়াতে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে সাবেকি এবং আধুনিকতার একটা মেলবন্ধন ঘটে। আর সেই স্টাইলের মাধ্যমে আধুনিক কনের নিজস্বতা ফুটে বেরয়। যেমন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে বা কনট্রাস্টে অনেকেই এখন স্টোন সেটিংয়ের গয়না গড়ান। এতে সোনার সঙ্গে স্টোনের মিলমিশ ঘটে এবং গয়না দেখতে একেবারেই অন্যরকম হয়। এছাড়া টেম্পল ডিজাইন এখন আধুনিক কনেদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। দক্ষিণী নকশাই শুধু নয়, সেইরকম পালিশও বিয়ের গয়নায় চাইছেন অনেক মেয়ে। তাতে নকশা এবং গয়নার চেহারা দুটোতেই সাবেকি লুক থাকে।’ বললেন সেনকো জুয়েলার্স-এর কর্ণধার জয়ীতা সেন। তাঁর কথায় এখনকার কনেরা ফিলিগ্রি, নকশি, বল, তারের কাজ ইত্যাদির কদর করছেন। ফলে এই নকশাগুলো নতুনভাবে ফিরে আসছে। এছাড়া আবার গয়নায় স্টোন সেটিংও এখন খুবই চলছে। তারের কাজের অলঙ্কারে পাথর সেটিংয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এই ধরনের গয়না লেহেঙ্গার সঙ্গেও খুবই মানানসই।
বিয়ের গয়নায় একটু সাবেকি ছোঁয়া চায় আধুনিক কনেরা, জানালেন বি সরকার জহুরির কর্ণধার শ্রী সরকার। আসলে বিয়ের গয়নার দু’টি ধরন। একটা ভারী, অন্যটা একটু হাল্কা, স্লিক, ডিজাইনার। একটা সময় ছিল যখন বিয়ের ক্ষেত্রেও মেয়েরা শুধুই স্লিক ডিজাইনের গয়না চাইতেন। এখন সেই ট্রেন্ডটা একটু হলেও কমেছে। এখন স্লিক গয়নার পাশাপাশি একটা ভারী চওড়া সোনার সেট চাইছেন আধুনিক কনেরা। তাছাড়া বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গেই গয়নায় একটু বিদেশি নকশাও পছন্দ করছেন অনেক বাঙালি কনে। যেমন গলার চওড়া নেকলেসে ভিক্টোরিয়ান ডিজাইন। অবাঙালিরা যেমন কুন্দন আর পোলকির বাইরে খুব একটা যেতে চান না, বাঙালি কনেরা কিন্তু বরাবরই গয়নার নকশা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন। তাই তাঁরা বনেদি নকশার সঙ্গে বিদেশি ডিজাইনের মিলমিশ ঘটাচ্ছেন আধুনিক বিয়ের গয়নায়। এছাড়াও আছে সবসময় পরার মতো গয়না। বিয়েতে একটা ভারী সেটের সঙ্গে কিছু রেগুলার সেটও কিনতে চান আধুনিকারা। অনেকে আবার পরবর্তীকালে পুজো, বাড়ির অন্যদের বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও পরার মতো গয়না কেনেন নিজের বিয়ের অলঙ্কারের সঙ্গেই।
নববধূর সলাজ সাজে অলঙ্কারের অসীম মহিমা। তার ধরন যেমনই হোক না কেন, গুরুত্ব কমেনি একটুও। তবে মেয়েদের জীবনযাপনের বদলের সঙ্গেই তাঁদের চাহিদা অনেকটাই খোলতাই হয়েছে। আর সেই সঙ্গেই বদলে গিয়েছে অলঙ্কারের নকশা ও কারিগরি। তবু কিছু সাবেক টান আজও বিয়ের গয়নায় বতর্মান। পুরনোকে নতুন রূপে পাওয়ার আশা আজকের কনেদের মধ্যে সমান তালে বিরাজমান।