দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম ও পুনঃ সঞ্চয়। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি বা নতুন কর্ম লাভের সম্ভাবনা। মন ... বিশদ
প্রতি ১২ বছর অন্তর একবার হয় ‘পূর্ণকুম্ভ’। আর ১২টি পূর্ণকুম্ভ শেষে, অর্থাৎ ১৪৪ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় ‘মহাকুম্ভ’। স্বাভাবিকভাবেই ‘মহাকুম্ভ’ প্রত্যেকের জীবদ্দশায় হয় না। প্রয়াগে এবার সম্ভব হল সেই দুর্লভপ্রায় মহামিলন। শুভসূচনা হয়েছে ১৩ জানুয়ারি, সোমবার। শাহিস্নানের সমাপ্তি আজই, ২৬ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। শুরুর দিন ছিল পৌষ পূর্ণিমা, সমাপ্তির দিন মহাশিবরাত্রি। সূচনা থেকে উপসংহার পর্যন্ত মোট ছয়টি বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে ভক্তরা মহাস্নানের সুযোগ পেয়েছেন। ওই দিনগুলি ছিল ১৩ জানুয়ারি পৌষ পূর্ণিমা বা প্রথম মহাস্নান। পরদিন ১৪ জানুয়ারি ছিল মকর সংক্রান্তী। তৃতীয় মহাস্নানের দিন ছিল ২৯ জানুয়ারি মৌনী অমাবস্যা। প্রয়াগরাজে ‘মহাবিপর্যয়টি’ ঘটেছে ওইদিনে। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি বসন্ত পঞ্চমী, ১২ ফেব্রুয়ারি মাঘী পূর্ণিমাতেও মহাস্নান করেছেন অগুনতি পুণ্যার্থী। কুম্ভমেলাকে বাঙালির কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় করেছেন কথাসাহিত্যিক কালকূট ওরফে সমরেশ বসু। তিনি আমাদের সেই থেকে নিয়ে চলেছেন অমৃত কুম্ভের সন্ধানে। লেখক শুরুতে জানিয়েছেন, ‘অনেক বিচিত্রের মধ্যে মানুষের চেয়ে বিচিত্র তো আর কিছু কোনদিন দেখিনি। সে বিচিত্রের মাঝেই আমার অপরূপের দর্শন ঘটেছে।’ এই অভূতপূর্ব কাহিনি সমাপ্ত হয়েছে ‘সন্ধানের শেষ নেই’—এই চরম সত্য দিয়ে।
অমৃতের সন্ধান আজকের নয়, পুরাকালের। এমন সন্ধানী কেবল রক্তমাংসের মানব-মানবী নয়, সুর ও অসুর, দেবতা ও দানবরাও। কেন? ‘জন্মিলে মরিতে হবে’, এই ‘অন্যায্য’ বিধান মানা যায় না। সকলের একটাই আকাঙ্ক্ষা, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’! এই একটিমাত্র আকাঙ্ক্ষার জায়গায় মিল সকলের। অতএব মৃত্যুকে রুখে দিতে হয়েছিল ক্ষীরসাগর মন্থন—অসুর ও দেবতা দু’পক্ষের মিলিত উদ্যোগে। তাতে উঠেও ছিল অমৃতের ভাণ্ডার। অতল থেকে অমৃতকুম্ভ নিয়েই উঠে এসেছিলেন ধন্বন্তরি। কিন্তু এবার তার দখল নেবে কে? যে পাবে সেই তো লাভ করবে অমরত্ব! দেবতারা তা হতে দেবেন না। অতএব শুরু হল অসুর ও দেবতাদের মধ্যে লড়াই। শেষমেশ দেবরাজ ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত অসুরদের ঠকিয়ে অমৃতকুম্ভ বগলদাবা করে ছুটলেন স্বর্গের দিকে। যাত্রাকালে মোট ১২ জায়গায় অমৃত চলকে পড়ল। তার মধ্যে মর্ত্যের চার স্থানে—প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, নাসিক ও উজ্জয়িনীতে। তাতে পবিত্র হল প্রয়াগে ত্রিবেণী সঙ্গম, হরিদ্বারে গঙ্গা, নাসিকে গোদাবরী এবং উজ্জয়িনীতে শিপ্রা। বলা বাহুল্য, অমৃত কুম্ভ দখলের লড়াইতে ওস্তাদের মারটি দিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। চূড়ান্ত পরাজিত এবং বঞ্চিত হল অসুর বাহিনী। কুম্ভমেলার সূচনা সম্ভবত সেখান থেকেই। বৃহস্পতি মেষ রাশিতে, চন্দ্র-সূর্য মকরে এবং তিথি অমাবস্যা হলে প্রয়াগরাজে কুম্ভযোগ। বৃহস্পতি কুম্ভরাশিতে এবং সূর্য মেষ রাশিতে থাকলে কুম্ভযোগ হরিদ্বারে। নাসিকে কুম্ভযোগ আসে বৃহস্পতি ও সূর্যের কর্কটে গমনকালে। বৃহস্পতি, চন্দ্র ও সূর্য তুলা রাশিতে গেলে কুম্ভযোগ ঘটে উজ্জয়িনীতে।
এবার কুম্ভমেলা শুরু হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী বা জাতীয় যুব দিবসের পরদিন। প্রয়াগের সঙ্গে স্বামীজির সম্পর্ককে সামনে রেখে লখনউয়ের বিবেকানন্দ কেন্দ্র এবার ২০ জানুয়ারি থেকে সেখানে বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করে। ছাত্র-যুবদের বিবেকানন্দের শিক্ষার আলোকে উদ্বুদ্ধ করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল তাদের তরফে। এই প্রসঙ্গে জানানো যায়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদা মায়ের সংক্ষিপ্ত তীর্থযাত্রাতেও উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রয়াগের সুখস্মৃতি। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থে উল্লেখ পাই, ‘ঠাকুর দুইবার তীর্থে গমন করেন। প্রথমবার মাকে সঙ্গে করিয়া ...। এবার বৈদ্যনাথ দর্শনান্তর কাশীধাম ও প্রয়াগ দর্শন হইয়াছিল। দ্বিতীয়বার তীর্থগমন ইহার ৫ বৎসর পরে, ইংরেজী জানুয়ারি, ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে। ... এ-যাত্রায় কাশীধাম, প্রয়াগ, শ্রীবৃন্দাবন দর্শন করেন।’ এছাড়া নির্মলকুমার রায়ের ‘চরণচিহ্ন ধরে (শ্রীরামকৃষ্ণের সমগ্র লীলাস্থল)’ গ্রন্থে পাওয়া যায়, ‘ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের পরে শ্রীশ্রীমা এই ত্রিবেণী সঙ্গমে ঠাকুরের কেশ বিসর্জন দিয়েছিলেন।’ গ্রন্থটিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘পাঁচ-সাত দিন কাশীতে থাকিয়া ঠাকুর মথুরের সহিত প্রয়াগে গমনপূর্বক পুণ্যসঙ্গমে স্নান ও ত্রিরাত্রি বাস করিয়াছিলেন। মথুর প্রমুখ সকলে তথায় শাস্ত্রীয় বিধানানুসারে মস্তক মুণ্ডিত করিলেও ঠাকুর উহা করেন নাই। বলিয়াছিলেন, আমার করিবার আবশ্যক নাই।’
ভক্তরা জানেন, রামকৃষ্ণদেব তীর্থভ্রমণের চেয়ে সাধুসঙ্গকেই উপরে রেখেছিলেন। শুদ্ধ মনে ঈশ্বরের নাম করার নির্দেশ ছিল তাঁর। তিনি বলতেন, ‘দেহত্যাগের আগে যদি কেউ ঈশ্বরের সাধন করে, আর সাধন করতে করতে ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে যদি দেহত্যাগ হয়, তাকে আর পাপ কখন স্পর্শ করবে?’ ‘পাপের অভিনয়ও ভালো নয়’, বলেছিলেন তিনি। তিনি চান, ভগবানের উপর ‘জ্বলন্ত বিশ্বাস’ স্থাপন। ঠাকুর বলেছেন, ‘যার ঠিক বিশ্বাস—‘ঈশ্বর কর্তা আর আমি অকর্তা—তার পাপ হয় না। যে নাচতে ঠিক শিখেছে তার বেতালে পা পড়ে না।’ প্রকৃত সাধুজনের কাছে এই ত্রিবেণীসঙ্গম তো প্রতীকী। সত্য-জ্ঞান-আনন্দের ত্রিবেণী বা প্রবাহে, অর্থাৎ সচ্চিদানন্দে অবগাহনের কথাই বলা হয়েছে শাস্ত্রে। তবে এমন অবগাহনের আগে মনকে সবরকমে প্রস্তুত করতে হবে, না-হলে যাবতীয় আয়োজনই বৃথা!
লেখাটি শিব-পার্বতীকে নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প দিয়ে শেষ হতে পারে, যেখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশের মিল রয়েছে হুবহু। কুম্ভস্নান নিয়ে মর্ত্যবাসীর উন্মাদনা দেখে পার্বতী প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, স্নাত প্রতিটি নরনারী কি পাপমুক্ত হচ্ছে এবং পুণ্যলাভ করছে?’ শিব বললেন, ‘চল তবে কুম্ভস্নানের ঘাটে, যাচাই করেই দেখা যাক।’ শলাপরামর্শ মতো শিব এক সাধারণ মানুষের এবং পার্বতী এক হিন্দু বধূর বেশে উপস্থিত হলেন। মৃতের ভান করলেন শিব, আর পার্বতী সেই শব আগলে বসে বিলাপ করতে থাকলেন। থেকে থেকে বলে উঠছেন তিনি, ‘যেকোনও একজন পাপমুক্ত মানুষ এসে শুধু ছুঁয়ে দিয়ে আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে তোলো!’ দ্বিধা নিয়েও দু’-একজন এগিয়ে গেল। তখন সাধারণ নারীরূপী পার্বতী হুঁশিয়ার করলেন, ‘আমার মৃত স্বামীকে সেই স্পর্শ করবে যে সত্যিই পাপমুক্ত হয়েছে। প্রকৃত পাপমুক্ত না-হয়ে এসে এই শব ছুঁয়ে দিলে কিন্তু উল্টে সেই ব্যক্তিকেই প্রাণ হারাতে হবে!’ এই শুনেই ‘দরদিরা’ একে একে সরে গেল। শেষমেশ একজন মাতাল গোছের লোক এসে ছদ্মবেশী শিবকে স্পর্শ করে দিতেই তাঁরা অন্তর্ধান করলেন। তখন পার্বতীকে বললেন দেবাদিদেব, ‘শেষের লোকটিই উদ্ধার পাবে। কারণ ও কুম্ভস্নান করেছে পরিপূর্ণ বিশ্বাস-ভক্তি নিয়েই। ও সত্যিই পাপমুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং পুণ্যলাভ হয়েছে ওর।’
তবে মানুষের মনের অভ্যন্তরের লড়াই তো অব্যাহত। কোনোদিন বন্ধ হবে না। তাই অমৃত
কুম্ভের সন্ধানে মানুষ ব্যাপৃত থাকবে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করেই, যেমন এবারও এসেছেন কোটি কোটি পুণ্যকামী নরনারী।