দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম বাড়বে। অফিস কর্মীদের পক্ষে দিনটি শুভ । শিক্ষার্থীদের সাফল্য ও খ্যাতি ... বিশদ
সুতরাং, কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো। যে দেশ ইতিহাসকে মুছে ফেলে দানবের ভাষ্যে নতুন ইতিহাস লিখতে চায়, তার থেকে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী আর কেউ নেই। আজ সে দেশের অধিকাংশ যুবক গোপনে শিরে করাঘাত করছেন। তাঁরা ছ’মাসের মধ্যেই বুঝতে পারছেন, খাল কেটে কুমির ডেকে এনে কী ভুলই না করেছেন! ফলে শান্তিহীন, কল্যাণহীন, সংস্কৃতিহীন এক মূর্খের ‘বেহেস্তে’ আজ তিল তিল করে দগ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে মৌলবাদ অবশ্য আজ নতুন নয়। এক সাংস্কৃতিক চেতনার দুর্বিনীত প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা খর্ব হলেও সেখানে মৌলবাদের দাঁড়া সবসময় সক্রিয় থেকেছে। ১৯৯৩ সালে তসলিমা নাসরিন তাঁর ‘ফেরা’ উপন্যাসে এই মৌলবাদের স্বরূপটাকে দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন কীভাবে শিশুমনে মৌলবাদের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদেরই অজান্তে। বহুদিন পর কল্যাণী তার ছেলে দীপনকে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছে। তার ছেলেবেলার দিনগুলোকে ফিরে পেতে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।
‘কল্যাণী জিজ্ঞাসা করে— ওদের সঙ্গে খেললে বুঝি? কি খেললে?
দীপন ভাঙা কণ্ঠে বলে— আমি খেলিনি। ওরা পিঁপড়ে পিঁপড়ে খেলছিল।
—পিঁপড়ে পিঁপড়ে আবার কী খেলা, এই নাম শুনিনি তো!
—দেওয়ালে যখন লাইন ধরে পিঁপড়ে যায়, ওরা বেছে বেছে লাল পিঁপড়ে মারে, কালো পিঁপড়ে মারে না। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কালোগুলো মারছো না কেন? ওরা বলল, কালো পিঁপড়ে তো মুসলমান, তাই। তবে লালগুলো কী? ওরা বলল, হিন্দু।
কল্যাণীর বুক কেঁপে ওঠে। দীপনের মুখে কী শুনছে সে! শরিফার ছেলেমেয়েরা হিন্দু পিঁপড়ে মারে?’
এভাবেই অবোধ চৈতন্যের ভিতরে বিষবাষ্পকে ঠুসে দেওয়ার কাজ চলেছে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে। জানোয়ারের মন থেকে যেমন বনকে ফেলে দেওয়া যায় না, তেমনি বাংলাদেশের ভিতর থেকে রাজাকারদেরও নিঃশেষ করা যায়নি। আজ তারাই হিংস্র হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে মৌলবাদীদের হাতে চলে গিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাই সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, মানবিক মূ্ল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ কেউ ঘরে ঢুকে গিয়েছেন, কেউ আত্মগোপন করেছেন। গৃহযুদ্ধে দীর্ণ এই রক্তাক্ত বাংলাদেশে মুক্তমনা মানুষের কোনও জায়গা নেই। তাদের নানা মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয় জেলে পোরা হচ্ছে কিংবা গুমখুন করা হচ্ছে। গত ছয় মাসে সেদেশে দেড় হাজার মানুষের কোনও খোঁজ নেই। ভেঙে ফেলা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি, স্মৃতিসৌধ, স্বাধীনতার স্মৃতি মুছে ফেলতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! কারাগার থেকে একের পর এক মুক্তি দেওয়া হচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের। মিরপুরের কিলার আব্বাস, তেজগাঁওয়ের সুইডেন আসলাম, মহম্মদপুরের পিচ্চি হেলাল, হাজারিবাগের ফ্রিডম রাসুর মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের নতুন করে জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দিচ্ছে সরকারই। জঙ্গিদের হাতে বৈধ পাসপোর্ট তুলে দিতে পুলিস ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। ইউনুসের সঙ্গে নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে কুখ্যাত জঙ্গিরা।
শান্তির জন্য নোবেল পাওয়া একটা মানুষের নৃশংস উস্কানিতে বাংলাদেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। হায়নারা বেরিয়ে এসেছে অন্ধকার গর্ত ছেড়ে। এই প্রেক্ষাপটের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন একুশে ফেব্রুয়ারি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান আজ তার মর্যাদা হারিয়েছে। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং প্রথমে আবদুল লতিফ ও পরে আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত এই গানটি একটা আন্দোলনের ইতিহাসকে অমর করে রেখেছে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মহম্মদ আলি জিন্না পূর্ববঙ্গে এসে ঢাকা, চট্টগ্রামে কয়েকটি সভা করেন। সেই সভায় তিনি স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সেখানে বাংলার কোনও স্থান নেই।’ স্বাধীনতার পর থেকেই এনিয়ে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছিল পূর্ববঙ্গে। জিন্নার সেই ভাষণে ঘৃতাহুতি হল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আন্দোলনের অগ্নিশিখা। বাংলা ভাষার দাবিতে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। অচিরে মানুষের মনে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। সেই আন্দোলনকে সমূলে দমন করতে রাষ্টশক্তির অস্ত্রকেই ব্যবহার করল পাকিস্তান। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি চলল গুলি। মৃত্যু হল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের। সেই আন্দোলকে শ্রদ্ধা জানাতে জন্ম নিল আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। আজ প্রতিটি জাতি তার ভাষাকে নিয়ে গর্ব করে, উদযাপন করে।
অথচ সেই দেশে নিজেদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে নেমেছে একদল মানুষ। তারা সবকিছু ভেঙে ফেলতে চাইছে। চাইছে শিক্ষা চুলোয় যাক, ঘরে ঘরে জন্ম নিক বিচ্ছিন্নতাকামী মৌলবাদ। তাই শিক্ষাবর্ষের বেশ কয়েকমাস কেটে গেলেও এখনও ছাত্ররা হাতে বই পায়নি। মাত্র ১৫ শতাংশ পড়ুয়ার হাতে বই পৌঁছেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিকে পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজন হয় প্রায় ১০ কোটি এবং মাধ্যমিকে বইয়ের প্রয়োজন হয় ৩০ কোটি। সেই সব বইয়ের আশি শতাংশ ছাপা হয় ভারতে। কেননা ভারতে একটা বই ছাপতে যদি একশো টাকা খরচ হয়, সেটাই বাংলাদেশে খরচ হয় দু’শো টাকা। প্রথমত সেখানে কাগজের বিশাল দাম, সময়ে কাজ শেষ করার মতো প্রেসও নেই। তাছাড়া দক্ষ কর্মীরও অভাব।
একদিকে পড়াশোনা বন্ধ, অন্যদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে অবৈধ মাদ্রাসা। সেগুলি আসলে জঙ্গি গড়ার আখড়া। সেখানে ‘লাল পিঁপড়ে’ মারার প্রশিক্ষণ দেওয়া চলছে। ভারত বিরোধী মানসিকতা তাদের ভেতরে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে জঙ্গিশিবিরও।
আসলে যে কোনও ফ্যাসিস্ট সরকারই শিক্ষাকে ভয় পায়। বাংলাদেশে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রদীপে তেল কমে আসছে। বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বইমেলা। শুদ্ধ চেতনায় আঘাত হানতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৌলবাদী লুম্পেনরা গিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে নাট্যোৎসব, বসন্ত উৎসব, আবৃত্তির অনুষ্ঠান, লালন স্মরণোৎসব সহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
একনায়কতন্ত্রের মেজাজে শাসন কায়েম করলেও ইউনুস কিন্তু আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি ভালো করেই জানেন, এখনই যদি ভোট হয়, তবে হাসিনার জয় অবধারিত। দেশে যত অত্যাচার বাড়ছে, ততই শক্ত হচ্ছে হাসিনার পায়ের তলার মাটি, ততই গণতান্ত্রিক শক্তি তাঁর দিকেই ঢলে পড়ছে। তাই কোনওভাবেই ইউনুস ভোটে যাবেন না। ডিসেম্বরে ভোটের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই ভোট আদৌ হবে কি না সন্দেহ। তার আগেই সম্ভবত এমন রাজনৈতিক ঝড় উঠবে, যাতে ইউনুস-বিসর্জনের পর্ব ত্বরান্বিত হবে। আগামী ছ’মাস তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও যথেষ্ট সংশয়ে রয়েছেন। কেননা তাঁর সাম্প্রতিক একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আপনারা নতুন বাংলাদেশ এনে দিয়েছেন। আমরা সেটা রাখতে পারব কি?’ এখন তিনি বাঘের পিঠে সওয়ারি। বাঘ তাঁকে একদিন খাবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
ইউনুসের ভয়টা আরও বেড়েছে মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকের পর। ট্রাম্প খুব আন্তরিকভাবেই মোদিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাপারটা আপনিই দেখুন।’ তারপর থেকে অবশ্য ভারত বিরোধী উস্কানি কিছুটা কমেছে বলেই সেদেশের রাজনৈতিক মহলের অভিমত। ইউনুস সরকার এটাও জানে, সাতদিন যদি ভারত থেকে বাংলাদেশে ট্রাক না যায়, দেশটা স্রেফ আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকবে।
মাঝে একদিন, তারপরেই একুশে ফেব্রুয়ারি। এতদিন ধরে ভাষা দিবস কিংবা পয়লা বৈশাখ কী আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ পালন করতেন! এতদিন সীমান্তে হাত ধরাধরি করে দুই দেশ পালন করে এসেছে ভাষা দিবস। কাঁটাতারের রাজনৈতিক বেড়া থাকলেও বাংলা ভাষার আকুলতা তাকে বেড়ি পরাতে পারেনি। কিন্তু এবারের উৎসব বিদ্ধ হয়েছে সেই কাঁটাতারেই। মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় আওয়াজ তুলেছিলেন ‘আমারে দাবায়ে রাখতে পারবা না। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ বাংলাদেশে তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছে। হয়তো আরও অনেকটা সময় লাগবে। কিন্তু একুশের ময়দানে বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য শুরু হবে নতুন লড়াই। বাঙালি হিসেবে দুই প্রান্তের মানুষেরই এক সুর। ‘বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক…’। এই রোমান্টিসিজমেই কিন্তু বাঙালি ডুবে যায় না। তারপরেও থাকে অন্য স্বর— ‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তির ধনুক’। লড়াইয়ের বজ্রনির্ঘোষও লুকিয়ে রয়েছে বাংলা ভাষায়, বাঙালির মননে। কোনওদিনই বাঙালিকে ‘দাবায়ে’ রাখা যায়নি। সে এপার বাংলাই হোক বা ওপার বাংলা।