কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
তারই মাঝে যে অমল ধবল পালে হাওয়া লাগে। হাওয়া বয়ে যায় মন্দ মধুর ছন্দে। প্রকৃতির আচরণের এই নিরপেক্ষতা কে আটকাবে! তাই কবিকে প্রতিবারই শরতে বলতে হয়, ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া’। সেই নৌকা, তিনি লক্ষ করেন, কোনও এক সাগরের পার, অজানা সুদূর থেকে অমূল্য ধনসম্পদ বয়ে আনে। সব চাওয়া-পাওয়া ফেলে সেই আনন্দে কবি এখন শুধু ভেসে যেতে চান। পিছনে মেঘের গুরু-গর্জন, জল ঝরছে অঝোরে। কবি সেসব পরোয়া করতে চান না। কেননা মেঘের ঘনঘটা ছিন্ন করে তাঁর মুখে সোনারোদ এসে পড়েছে। তিনি সেই পবিত্র আলোয় স্নাত হতে চান আজ। বিপন্নতা বোধ করলেই আমরা কাণ্ডারীকে খুঁজি। কবিও খুঁজে পেয়েছেন তাঁকে, যিনি সমস্ত হাসিকান্নার ধন। তিনি সেই পরমাত্মার কাছে জানতে চান, ‘কোন সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে গাওয়া।’ এতক্ষণ যাঁকে নিয়ে এত কথা হল, তাঁর বিচরণ মনোজগতে, ভাবনার জগতেই কেবল। কিন্তু সেই দেবী নিজেকে বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারলেন না তো! কবিকে তাই আনন্দে গেয়ে উঠতে হল, ‘আমার নয়ন-ভুলানো এলে’। কবি যখন আমাদের হৃদয়ের কাছে মুখটি বাড়িয়ে এই গান ধরেন, তখন বঙ্গসন্তানের মাদুর্গা ছাড়া আর কারও মুখই মনে আসে না বোধহয়। শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে এগিয়ে আসছেন তিনি। আবির্ভূত হচ্ছেন দশ হাত দিয়ে মেঘের আবরণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে। অমনি আমাদের হিয়ার মাঝে সোনার নূপুর বেজে উঠছে। এই চরম দুর্দিনে বরাভয়ও জাগছে বইকি। কেননা, ‘ডান হাতে যার খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাতে করে শঙ্কাহরণ/ দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।’ হবে নাই-বা কেন? তিনিই তো মহাশক্তি—শুধু সন্তানের জন্ম দেন না, তাকে সবরকমে লালন-পালন করেন এবং তাঁর হাতে দুষ্টের দমনও চলে সমানে—আমাদের বাঁচা ও বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে অনাবিল রাখতে।
আজ মহাষষ্ঠী। দেবী বছরে একবারই সপরিবারে আসেন আমাদের মাঝখানে। তিনি ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছেন। প্রথমে জানতে চেয়েছি, ‘শরতে আজ কোন্ অতিথি এলে প্রাণের দ্বারে।’ কিন্তু তিনি স্বয়ংপ্রকাশিত হতেই সেই আমরাই বলেছি, ‘আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে’ এবং ‘তোমার মোহন রূপ কে রয় ভুলে।’ আমাদের মন প্রাণ সমস্ত সত্তা দিয়েই তাঁকে বরণ করে নিয়েছি আমরা। কিন্তু এইভাবে যাঁকে কাছে পেয়েছি এবং বুকের মাঝখানে সবচেয়ে দামি আসনখানি পেতে দিয়েছি, তিনি কি আর আমাদের দূর গ্রহের কেউ রইলেন? তিনি আর কঠিন কঠোর কোনও দেবতা থাকতে পারলেন কি একটুও? ভারতীয় সংস্কৃতি তাঁকে আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় করেছে। তাঁর ঠাঁই হয়েছে আমাদেরই তৈরি ঘরে। প্রয়োজনে তাঁকে সন্তানের স্নেহ ভালোবাসাও দিই—প্রিয় বস্ত্র ও অলংকার পরাই, সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারটি খাওয়াই, পাখা নেড়ে হাওয়া করি, ঘুম পাড়াই, তাঁকে গান শোনাই, তাঁকে ঘিরে বাদ্যসহকারে নৃত্য করি, আমাদের ইহজাগতিক সমস্ত সুন্দরই উজাড় করে দিই তাঁর কাছে।
এমন আনন্দের পরিসরে কে আর গণ্ডি এঁকে দিতে চায়, কে চায় যে তা ছোট হোক। আমাদের সহজাত আকাঙ্ক্ষাই এমন আনন্দের দু-কূল ভাসিয়ে দিয়েছে—এবারও। করোনা মহামারীর রক্তচক্ষুও পুজোর আনন্দ থেকে বাঙালিকে দূরবর্তী করতে পারেনি। বাংলাদেশ পরিস্থিতি, আর জি কাণ্ড, বন্যা, মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধের আবহ প্রভৃতি একজোট হয়ে এবারও বাঙালিকে গৃহবন্দি করতে পারেনি। বস্তুত মহালয়া পার করে দেবীপক্ষে প্রবেশ করতেই শহর কলকাতা, শহরতলি, কল্যাণী ছাড়িয়ে বাংলার প্রায় সর্বত্র মানুষ পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ঠাকুর দেখেছেন। এসে গিয়েছেন যথারীতি বিদেশি অতিথিরাও।
দেবদেবী আমাদেরই হাতে সাকার হলেও ভিতরে ভিতরে নিরাকারই তাঁরা। মৃত্যু বা বিনাশ বলে কিছু নেই তাঁদের। তাই মাদুর্গা এবং তাঁর চার সন্তান—গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে এক কাঠামোয় বিসর্জন দিতে পারি আমরা। বিচ্ছেদ বিরহ মাত্রই দুঃখের কষ্টের যন্ত্রণার। তবু আমরা মাটির প্রতিমাকে বিসর্জন দেব, এমনকী শোভাযাত্রাসহকারে। এটা আমরা পারব, কেননা আমাদের হৃদয় জুড়ে থাকবে মায়ের চিন্ময়ী রূপখানি। আমরা আরও জানি, ‘আসছে বছর আবার হবে’। মা তো চিরদিনের জন্য সন্তানকে ফেলে যান না। তাঁর প্রস্থানের প্রতিটি পদক্ষেপে লেখা হয়ে যায় আগমনির সুর। প্রতিমা বিসর্জন দিয়েই আমরা মগ্ন হয়ে যাই তাঁর আগমনের কাউন্ট ডাউনে। কিন্তু দেবী যতক্ষণ পুজোমণ্ডপে অধিষ্ঠিত রয়েছেন ততক্ষণ তাঁকে ঘিরেই চলবে আমাদের আনন্দযজ্ঞ। আজকের দিনটি ধরে, আনন্দ লুটে নেওয়ার আরও চারদিন আমাদের হাতে। সবাই ঠাকুর দেখুন, আনন্দ করুন। তবে এসব কোনোভাবেই যেন অন্যের দুঃখকষ্ট, এমনকী সামান্য অসুবিধারও কারণ না-হয়, সবটাই করতে হবে দেশজ রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং অবশ্যই আইনকানুন মেনে। আনন্দের আতিশয্য যেন নিজেরও বিপদের কারণ না-হয় কোনোভাবে, তার নিশ্চয়তা নিজেকেই দিতে হবে।
বিবর্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। দুর্গোৎসবও তার অংশভাক। ভগবান রামচন্দ্র দেবীর অকালবোধন করেছিলেন। রামচন্দ্র ভারতবাসীর আদর্শ রাজা। প্রতিটি মানুষ রামরাজ্যের বাসিন্দা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। কিন্তু স্বাধীন ভারতও রামরাজ্য উপহার দিতে পারেনি। উল্টে শ্রীরামচন্দ্রের পবিত্র মূর্তি আর জন্মতিথি ঘিরে ‘প্রজাদের’ যার পর নাই দুঃখ-যন্ত্রণা দেওয়ার চেষ্টায় থাকেন একদল স্বঘোষিত রামভক্ত! রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ফয়সালা রাজনীতির কারবারিরাই করুন। সাধারণ মানুষ তার মধ্যে না ঢুকে দেবীর অকালবোধনকে গ্রহণ করে ভালোই করেছে। তবে বঙ্গদেশে শরতে দেবী দুর্গার আরাধনার প্রাচীনত্ব নিয়ে বিতর্ক মেটেনি। এমন বিতর্কে কান না দিয়ে মানুষ দুর্গোৎসব উদযাপনেই মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছে। তার ফলে ব্যাপারটি দিকে দিকে সুন্দরের প্রতিযোগিতার রূপ পেয়েছে। প্রত্যেকবার আরও সুন্দর করাই পাখির চোখ সকলের। সূচনা পর্বে প্রতিযোগিতায় ছিল ধনাঢ্য পরিবারগুলি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—বড়িশায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী, শোভাবাজারে নবকৃষ্ণ দেব, কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্র, নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায়, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচন্দ্র মিত্র, রামহরি ঠাকুর, বারাণসী ঘোষ, দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রামদুলাল দে সরকার, সুখময় রায়, মদনমোহন দত্ত, কেষ্টচন্দ্র মিত্র, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, রূপলাল মল্লিক, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রাণকৃষ্ণ হালদার, মতিলাল শীল প্রভৃতি পরিবার। একেক পরিবারের একেক দিকে নামডাক হয়। প্রবাদে পরিণত হয়—মা এসে গয়না পরেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়িতে, ভোজন করেন অভয়চরণ মিত্র বাড়িতে আর রাতে নাচগান দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে।’ দাঁ মশাই নাকি প্যারিস থেকে হিরে চুনি পান্নার গয়না গড়িয়ে এনেছিলেন! সেকালের পারিবারিক পুজোর জাঁকই, কলকাতাসহ বাংলার বিভিন্ন বিগ বাজেটের সর্বজনীন পুজোগুলিতে এসে পড়েছে নাকি?
আমরাও এই বিবর্তনের অংশীদার ও সাক্ষী থেকে সামনে সুন্দরের দিকেই এগিয়ে যাই তবে। ওইসঙ্গে গ্রহণ করি পুজোর দু-দুটি অনবদ্য উপহার। অবশেষে এসেছে আমাদের প্রাণের ভাষা, বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি এবং ঘোষিত হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার নির্ঘণ্ট। মাতৃভাষার এই কেন্দ্রীয় স্বীকৃতি নিয়েই যেন আমরা থেমে না যাই। এতে আমাদের দায়িত্ব বরং বেড়ে গেল। বাংলাভাষার চর্চা ও ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাভাষায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে হবে আরও ভালো ভালো বই। স্টাইল মেরে ‘বাংলিশ’ বা ‘বাংহি’ বলার প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে ক্রমে। এই অবাঞ্ছিত স্টাইল হীনমন্যতা থেকেই। আমরা নিশ্চয় চাইব না, ‘ধ্রুপদী’ তকমা নিয়ে বাংলাকেও সংস্কৃতের মতো ‘ডেড ল্যাঙ্গুয়েজ’ করে ফেলতে। উচ্চশিক্ষার প্রধান বাহন এবং সরকারি কাজে ও আদালতে বাংলাভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে কোনোদিনই পৌঁছতে পারব না আমরা। এবারের বইমেলা যেন বাংলাভাষার এই বিরাট স্বীকৃতির সঙ্গে যথাযথ সংগত করতে পারে, এই প্রত্যাশাও থাকবে আমাদের। তবেই পুজো দেখার সঙ্গে পুজোর উপহার দুটিও আমাদের জন্য যথার্থ আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারবে।