কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায় ... বিশদ
দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক দু’দিন আগে এনডি টিভি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনুস বলেছিলেন, ‘আপনি (বা অন্য কেউ) যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলেন, তাহলে সেই অস্থিরতার আঁচ কিন্তু বাংলাদেশের বাইরেও মায়ানমার, সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ—সর্বত্রই অগ্ন্যুৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়বে।’ আর সেই বক্তব্যকে বিকৃত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের দিকে চোখ-রাঙালে ভারতের সেভেন সিস্টারের অস্তিত্ব থাকবে না: ইউনুস’।
তারপর থেকেই বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেভেন সিস্টার্স নিয়ে নানা ধরনের মিম, স্লোগান ও মন্তব্যের বন্যা। সেইসব মন্তব্য দেখলে মনে হবে, যেন যেকোনও দিন সেভেন সিস্টার্স যুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশের ম্যাপে। এই নিয়ে বাংলাদেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমও পিছিয়ে নেই। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ও কট্টর ভারত-বিরোধী মৌলবাদী শক্তিকে খুশি করতে প্রতিদিন শোনানো হচ্ছে—সেভেন সিস্টার্স ভাঙছে। আগুন জ্বলছে পশ্চিমবঙ্গে। এমনকী বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার পর কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ছাত্রদের স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছিল, ‘বন্যায় যদি মানুষ মরে, সেভেন সিস্টার্স থাকবে না রে!’ ফেসবুকের সৌজন্যে সেই ছাত্রদের ভিডিও প্রবল বেগে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এই সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। সাতটি রাজ্যের মধ্যে চারটি রাজ্য— অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বাংলাদেশ। ইতিহাস জানাচ্ছে, সেভেন সিস্টার্স-ভুক্ত এই রাজ্যগুলির বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অতীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকেই অবাধে তাদের কাজকর্ম চালিয়েছে। আবার যখন ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের সক্রিয়তাতেও দেখা গিয়েছে ভাটার টান! প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে কী ভারত ভূমিকে অগ্নিগর্ভ করতে ফের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদের মদত দেবে বাংলাদেশ? বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠছে তারই ইঙ্গিত। তাতে উস্কানি দিচ্ছে বাংলাদেশের মৌলবাদী দলগুলির নেতারাও।
মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) বিদ্রোহীরা প্রায় তাদের জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে (পূর্ব পাকিস্তান) আশ্রয় পেয়েছিলেন। ষাটের দশকের শেষ থেকে প্রায় দীর্ঘ দু’দশক ধরে সেখান থেকেই চালিয়েছে যাবতীয় অপারেশন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় বর্তমান রাঙামাটির জেলা পুলিস সুপারের বাসভবনের কাছে (তৎকালীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাকবাংলো) সপরিবার ছিলেন এমএনএফের নেতা লালদেঙ্গা। লালদেঙ্গার বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকেই সাহায্য করত। শুধু তা–ই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান ছিল তাদের। ওই গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেক ভ্যালি ও তার আশপাশের এলাকায়। ১৯৭১–এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দ্রুততার সঙ্গে লালদেঙ্গা তাঁর বাহিনীসহ রাঙামাটি থেকে চলে যান মায়ানমারে। জোরামথাঙ্গা ছিলেন লালদেঙ্গার বিশ্বস্ত অনুচর ও ছায়াসঙ্গী। ১৯৮৭-তে ভারতে মিজো শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পৃথক মিজোরাম গঠনের পথ প্রশস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ও তাঁর বহু সতীর্থ জীবনের বেশিটা সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। সেই জোরামথাঙ্গা এখন মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মিজোরামের দু’বারের মুখ্যমন্ত্রীও।
একই তথ্য রয়েছে অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা-র পরেশ বড়ুয়া, অনুপ চেটিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো সর্বোচ্চ নেতাদের ক্ষেত্রেও। তাঁদের সশস্ত্র আন্দোলনের অনেকটা সময়ই তাঁরা আত্মগোপনে ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে। ত্রিপুরার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এনএলএফটি কিংবা ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্সের (যার নেতা বিজয় কুমার রাংখল। এখন একজন মূল ধারার রাজনীতিক) সদস্যরাও অনেকেই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেখান থেকেই পরিচালিত হতো
তাঁদের অপারেশন।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ সরকার অবশ্য কখনওই তাদের দেশের মাটিতে এইসব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। ফলে এই ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম তিক্ততার জন্ম দিয়েছিল। ২০০৯-এ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় মেয়াদে এই দৃশ্যপটে একটা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে হাসিনা সরকার। একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে ভারতের হাতে তুলে দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের মাটিতে ওই সব গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরও একে একে বন্ধ হতে থাকে। উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া অবশ্য তার আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুপ চেটিয়া বা অরবিন্দ রাজখোয়ার মতো গোষ্ঠীর অন্য নেতারা ততদিনে ভারতে ফিরে এসে সরকারের সঙ্গে ‘শান্তি আলোচনা’ও শুরু করে দিয়েছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা সেভেন সিস্টার্স গত এক দশকে অনেকটাই স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ থাকার পিছনে শেখ হাসিনা সরকারের অবদান নয়াদিল্লি আজও স্বীকার করে। সেভেন সিস্টার্সের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের আর একটি বড় উপহার ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। এই দু’টি বন্দর ব্যবহারের সুযোগ সেভেন সিস্টার্সকে শুধু সামুদ্রিক বাণিজ্যের নতুন দিগন্তই খুলে দেয়নি, ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্বও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে সেই সুযোগ আরও বাড়বে। আসলে ‘সেভেন সিস্টার্সে’র সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নেপথ্যে বিশেষ করে গত দেড় দশকে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার কি সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ধাক্কা দিতে চায়? এমন প্রশ্ন শুধু ভারতের নয়, জানতে চায় গোটা দুনিয়াও!
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলি বলা শুরু করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে মণিপুর ও মায়ানমারের চিন প্রদেশের ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণের হিসেব নিকেশ সব পাল্টে দিচ্ছে। বিশেষ করে গত বছর থেকে শুরু হওয়া মণিপুর দাঙ্গায় হিন্দু মেইতেইদের হাতে খ্রিস্টান কুকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা এই জনপদে একটি নীরব জাগরণের ঢেউ তৈরি করেছে। আবার মায়ানমারের সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে চিন প্রদেশের যুদ্ধরত স্বাধীনতা সংগ্রামী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিজোদের সহানুভূতির ডালি সৃষ্টি করেছে নানা রহস্যের। ভূরাজনীতিতে ঘুরে ফিরে আসছে পুরনো মডেলের রসায়ন।
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে ভারতের বৃহৎ ভূ-খণ্ডকে এমনভাবে ভাগ করে যায়, যাতে জিইয়ে থাকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্যার বীজ আসলে নিহিত, জনজাতিদের জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার এবং সরকারি চাকরি-সহ অন্য লাভজনক পেশায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একাধিপত্যের ধারণায়। শুধু কি মণিপুরই অগ্নিগর্ভ ঘটনার সাক্ষী? ত্রিপুরাতেও জনজাতি সম্প্রদায়গুলি উচ্চশিক্ষা বা সরকারি চাকরিতে একে অন্যকে আটকানোর চেষ্টা করে। ১৯৬০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যখন চাকমা, হাজংরা পালিয়ে এসে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল, সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিল টিইউজেএস নামে এক জনজাতি সংগঠন। অরুণাচলেও একই চিত্র— স্থানীয় জনজাতিরা অভিবাসী চাকমা, হাজংদের রাজ্য থেকে তাড়াতে চেষ্টা করছে। তাই মণিপুরের ঘটনা কেবল মণিপুরের নয়— বহু জায়গার, বহু মানুষের ভাগ্য নির্ধারণকারী। ১৯৭২ সালের পরে ‘সেভেন সিস্টার্স’ তৈরি হওয়ার পর জাতিগত সংঘর্ষ এই রাজ্যগুলির অস্তিত্বের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেনল্যান্ডের সমাজে এই শব্দের মানে, বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর আদিম লড়াই। আর এই লড়াইকে কেন্দ্র করে উস্কে দেওয়া হচ্ছে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সুপ্রাচীন দাবিও। বাংলাদেশের একাংশ এখন যে ভারত ভাঙার স্বপ্নে বিভোর, তা টের পাওয়া যায় সে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলির মন্তব্যেই!
অথচ, বাংলাদেশ কি ভুলে গিয়েছে, তাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু কিছু ক্ষুদ্র আদিমগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে ‘জুম্মল্যান্ড’ নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রের। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের মতো গেরিলা সংগঠনও কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। কেএনএফের হিংসার মাত্রা কেমন, তা কিছুদিন আগেই প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশের মানুষ। ফলে সেভেন সিস্টার্স অগ্নিগর্ভ হলে তার রেশ গিয়ে পড়বে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন কেএনএফের একচ্ছত্র আধিপত্য। এর বাইরে সেভেন সিস্টার্সে এবং পাশের মায়ানমারের চার রাজ্য গেরিলা সংস্কৃতিতে ভরপুর। এর মধ্যে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি (কেআইএ), আরাকান আর্মি, নাগাদের ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন), চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সশস্ত্র বাহিনী এই মুহূর্তে গোটা পাহাড়ি তল্লাটের সবচেয়ে বড় গেরিলা দল। সমমনা হওয়ায় তাদের সঙ্গে কেএনএফের যোগাযোগ থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কেএনএফ প্রধান নাথান বম এখন কোথায়, সেটাই কেউ জানে না!
কেএনএফের দাবি— বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি নিয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠন। এই অঞ্চলের নামও তারা দিয়ে দিয়েছে, ‘কুকি–চিন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ বা কেটিসি। কেএনএফ দাবি করে, কুকি–চিন তথা বম, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। কুকি জঙ্গিরা তাদের দীর্ঘদিনের পুরনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। কুকি-চিনদের নিশানা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলও। আসলে কুকি জঙ্গিরা সেভেন সিস্টার্স অগ্নিগর্ভ করলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনওভাবে তা সামাল দিতে পারবে না। অনেকটা ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ এই নীতির মতো। কারণ, বাংলাদেশের কোনও সরকারই পাহাড়িদের সুরক্ষায় তেমন কোনও কাজ করেনি। বরং জিইয়ে রেখেছে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত। যুগ যুগ ধরে তারা হয়ে এসেছে বৈষম্যের শিকার। রাষ্ট্রের বাহিনী দিয়ে তাদেরকে করা হয়েছে প্রতিঘাত। তাদের আন্দোলনকে চেষ্টা করা হয়েছে বারবার দমিয়ে রাখার। বাংলাদেশ এখনও জানে না, কুকি জঙ্গিদের নিয়ে তাদের অবস্থান কী হবে? ভারত বিরোধিতার মধ্যেও অনেকে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, নিজেদের পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত করে কি অন্যের যাত্রাভঙ্গ করা আদৌ মোক্ষম কাজ হবে?
যদি বাংলাদেশের একমাত্র লক্ষ্য হয়, বিচ্ছিন্নবাদীদের আশ্রয় দিয়ে যেকোনও মূল্যে ভারতকে কোণঠাসা করা, তাহলে অন্তর্ঘাতে পড়তে হবে তাদেরও। কে না জানে, আগুন নিয়ে খেললে একদিন সেই আগুনেই পুড়ে মরতে হয়। ইতিহাস তার সাক্ষী!