মেয়াদি সঞ্চয় বা পৈতৃক সম্পত্তি সূত্রে ধনাগম যোগ দেখা যায়। কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও আর্থিক দিক ... বিশদ
সেই নকশি কাঁথায় ফুটে ওঠে জীবনের গল্প। পদ্ম, মাছ, ঘরের চাল বেয়ে ওঠা মাধবীলতা ফুটে থাকে তাঁদের তৈরি শাড়িতে। পুজোটাই তাঁদের রোজগারের সময়, সুখের সময়। বেশিরভাগ বরাত আসে এই সময়ে। আবার বেশি করে জিনিস তৈরি করে দোকানে বা পুজোর মুখে নানা মেলায় পৌঁছে যাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। সেই আনসুরা বিবিদের চোখে মুখে এখন আতঙ্ক। শহরের কিছু বাবু নাকি এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় উৎসব ‘বয়কট’-এর কথা ঘোষণা করেছেন। তাহলে কি ভেসে যাবে তাঁদের একটা বছরের লড়াই? মাটির গন্ধে ফোঁড় তোলা নকশি কাঁথার পোশাক পড়ে থাকবে কাকলি টুডুদের ঘরে ঘরেই? বছরভর স্বপ্ন দেখা গরিব সংসারগুলি শারদোৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে শুধুমাত্র শহুরে হুঙ্কারেই? আনসুরা বিবিদের মতো গায়ে-গঞ্জের কত গরিব মানুষ তাকিয়ে থাকেন পুজোর কটা দিনের দিকে। আর তাঁদের সেই স্বপ্নের দিনগুলি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেলেখেলা শুরু করছে এরাজ্যের কিছু মানুষ। অথচ, তাঁরাই নাকি ভোট এলে গরিবের যন্ত্রণায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হন! এই বাংলা জানতে চায়, একটা ধর্ষণকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলে লক্ষ লক্ষ গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারে আঘাত হানা কোন যুক্তিতে? এর দায় কে নেবে?
এ কথা সত্যি, সোশ্যাল মিডিয়ায় উৎসব বয়কটের হুঙ্কারে কাশফুল এ বছরও নীলচে হয়ে যায়নি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠস্বরও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। টেলিভিশন, স্মার্টফোন, খবরের কাগজ পুজোর নতুন বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে ‘শারদ সংখ্যা’। গোটা বাংলায় দৃশ্যত কোনও বদল নেই। বদল হওয়ার কথাও নয়। কেবল ‘তিলোত্তমা’-র কিছু মানুষের মুখে শুধুই ‘বয়কট’-এর ডাক। উৎসব বয়কট করলে যেন সব ‘জাস্টিস’ হাতের মুঠোয়! দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কিছু বিরোধী শক্তি বাংলায় অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করছে। আর তা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও আক্রমণ করতে ছাড়ছে না। আরও বিস্ময়কর, মিডিয়ার একটা বড় অংশ পরিকল্পিত উস্কানি দিয়ে এই অশান্তিকে প্রোমোট করছে। কাগজ খুললেই তাই এখন শুধু ‘জাস্টিস’ সংবাদ। প্রতিদিন আন্দোলনকে অভিনব মাত্রা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
এ কথা ঠিক, আর জি করের ঘটনা ভয়ঙ্কর। ধর্ষণ সমাজের অভিশাপ। মানবজাতির আদিমতম অপরাধ। এই অপরাধের দোষীদের শাস্তি হোক। যারা আড়াল করার চেষ্টা করেছে, তাদেরও শাস্তি হোক। সিবিআই দ্রুত শেষ করুক তদন্ত। সুপ্রিম কোর্ট কড়া মানসিকতায় তদন্তে নজর রাখুক। এই বিষয়ে এ রাজ্যের কে একমত নন? তবুও ভুল তথ্য, একতরফা তথ্য, বিকৃত তথ্য, বিষ মেশানো তথ্য এমনভাবে মানুষকে গেলানো হচ্ছে যে, আজকের দিনে তার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই প্রবলতরভাবে নেতিবাচক। যে অরাজকতায় উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, তা সফল হলে বাংলার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। শুধু ভাবমূর্তিই নষ্ট নয়, রীতিমতো আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো বিপর্যস্ত হবে। এটা কে না জানে? তবুও নিজের রাজ্যকে গোটা দুনিয়ার কাছে হেয় করার এরকম ব্যস্ততা কি আগে কখনও চোখে পড়েছে?
আর জি করের ঘটনায় প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপকে ভুল বোঝার অবকাশ আছে। সেসব নিয়ে নিশ্চয়ই সরকারকে চাপ দিন। কিন্তু তার মানে এই নয়, ভারসাম্যহীনভাবে একতরফা বিষ ছড়িয়ে আম জনতাকে ভুল ধারণার বশবর্তী করে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ইভেন্টের দিকে ঠেলে দিতে হবে। আর জি কর নিয়ে অন্য রাজ্য, এমনকী, অন্য দেশেও কলকাতা নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন প্রবাসী বাঙালিরা। দারুণ উৎসাহে কভারেজ দিচ্ছে মিডিয়ার একাংশ। কেউ প্রশ্ন করার নেই— যে শহরে, যে রাজ্যে, বা যে দেশে ওই বাঙালিরা এখন থাকেন, সেখানকার ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিবাদে তাঁদের মোমবাতি জ্বালানোর ক্ষমতা আছে? যে আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিরা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ পোস্টার হাতে ছবি তুলে বাংলার মিডিয়াগুলির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, সেই আমেরিকায় প্রতি ছ’জন নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হন বা ধর্ষণের আক্রমণের মুখে পড়েন। প্রতি ৪৩ সেকেন্ডে একজন আমেরিকান যৌন সন্ত্রাসের শিকার হন। প্রতিদিন ৭০ জন আমেরিকান নারী যৌন সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেন। ধর্ষণ বা যৌন আক্রমণের শিকার হন প্রতিবছর ৬ লাখ ৫২ হাজার আমেরিকান। যে রাজ্যে ওই বাঙালিরা আর জি করের ঘটনা নিয়ে সোচ্চার, সেই সব রাজ্যেও একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। উত্তরাখণ্ডের নার্স ধর্ষণ, মহারাষ্ট্রে বদলাপুর, অসমে ছাত্রী ধর্ষণ— কোথায় প্রতিবাদ? সেখানে
একটাও মোমবাতি খুঁজে পাবেন না। মিডিয়াও দেখতে পায় না।
কিন্তু, আর জি করের নির্যাতিতার মৃত্যু ঘিরে ‘ক্ষোভ’ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পুজোর আবহেও পথ ও রাত দখলের কথা মানুষকে ভুলতে দিলে চলবে না। এমনই ভাবনা সব বিরোধীদেরই। দলের আন্দোলন শুধু কলকাতায় আটকে না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে গোটা রাজ্যে। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ার আগেই তাই দলের নিচু স্তরে আন্দোলন পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায়, ‘পুজো তো হবেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি এ বার উৎসবের মুডে থাকবেন? মুখ্যমন্ত্রী চাইলেও সেটা মনে হয় হবে না।’ অথচ, এই বিজেপি লোকসভা ভোটে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচার করেছিল— বাংলায় দুর্গাপুজোয় মুখ্যমন্ত্রীর অনীহা!
২০১৬ সালের এক গবেষণাপত্রে বুখারেস্ট ইউনিভার্সিটি অব ইকনমিক স্টাডিজ-এর তুদরাখ পেত্রোনেলা বলেছিলেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর রক্ষণাবেক্ষণ অর্থনীতির এক মূল্যবান উৎস হিসেবে কাজ করে। ২০২১-এর শেষলগ্নে কলকাতার দুর্গাপুজো যখন ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে ঋদ্ধ হল, ইউনেস্কোর নয়াদিল্লির পরিচালক বলেছিলেন, এই স্বীকৃতি উৎসাহিত করবে সংশ্লিষ্ট ঐতিহ্যবাহী কারিগর, ডিজাইনার, শিল্পী, বড়সড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংগঠক, পর্যটক, দর্শনার্থী, সবাইকে। আমরা জানি, বাস্তবে অনেক আগে থেকেই দুর্গাপুজো বহু শিল্পী, কারিগর, ঢাকি, বিক্রেতা-সহ অনেকেরই প্রায় সংবৎসরের জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম। কোটি কোটি মানুষ দুর্গাপুজোতে খরচ করেন প্রাণ খুলে। কেনাকাটায়, খাওয়া-দাওয়ায়, বেড়ানোয়। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু লিখেছিলেন, দুর্গাপুজো কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো প্রকৃতপক্ষে এত
বড় ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে যে, নানা ধরনের আর্থিক পরিষেবার পরিসর তৈরি হয়। বাজার অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, ‘মানি সার্কুলেশন’ হয়। আর
উৎসব বয়কটের হুঙ্কারে সবচেয়ে ক্ষতি তো গরিব মানুষের। তা তো অজানা নয় আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলিরও। তাতে অবশ্য শহরের বাবুদের কী যায় আসে!
আকাশপানে তাকিয়ে দেখুন, শরৎকালে আকাশ। ঘন নীল, তাতে খেলা করে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। শিউলি ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম। হঠাৎ করেই মনে হয়, মুহূর্তগুলি পাল্টে যেতে চলেছে। বাস্তবে থেকেও বাস্তবে না থাকার অনুভূতি আর একরাশ আশা নিয়ে আম বাঙালির জীবনে আসে শারদোৎসব। যেন ম্যাজিক রিয়্যালিটি। অর্থাৎ ঘোর বাস্তবের মাঝেও জাদুর ছোঁয়া। ভালো থাকার এবং ভালো রাখার সময়। বাঙালির জীবন থেকে এই চারটি দিনও কেড়ে নেবেন? কখনও ভেবেছেন, যাঁরা প্রবীণ, শারীরিক কারণে পুজোর দিন গৃহবন্দি থাকাই মনস্থ করেন, অথচ মন পড়ে থাকে বাইরে, ঢাকের বোলে, তাঁদের কথা। যাঁরা দিনদৈনিকের অন্ন কিংবা বাসস্থানের চিন্তায় আকুল, শিশুর হাত ধরে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকেন এই মহানগরে, তাঁদের কথা। যাঁরা একটু ভালো আয়ের আশায় নতুন নতুন পসরা সাজিয়ে হকারি করেন, তাঁদের কথা। একজন ফুটপাতের হকার থেকে মণ্ডপ নির্মাণকর্মী– প্রান্তিক মানুষের ভরসা শারদোৎসব। নতুন জামা-কাপড়, নতুন গান, নতুন সিনেমা। জীবনকে নতুন করে শুরু করার নামও পুজো। এই বাংলার শারদোৎসব মানেই শারদলক্ষ্মীর স্পর্শ। সেই স্পর্শ— যার আবির্ভাবে খসে পড়ে আত্মসুখের টান। এই পুজো আক্ষরিকই সর্বজনীন। কারণ, এই আনন্দের বর্ণমালায় কোনও ভেদ নেই। ধনীর দুয়ার থেকে কাঙালিনীর কুটির পর্যন্ত একইভাবে দেখা দেন জগজ্জননী। রাজনীতি করতে গিয়ে সেই স্পর্শ ফিরিয়ে দেবেন?
প্রকাশ্যে না বললেও রাজনীতির অভিমুখ কিন্তু স্পষ্ট। আসলে এখন টার্গেট, অবিশ্বাস বাড়াতে হবে। যত খুশি, যেমন খুশি। যে সরকারকে ভোটে হারানো যাচ্ছে না, বিরোধীদের প্রোমোট করে তাকে কালিমালিপ্ত করিয়ে লোক খেপাতে হবে। আর তার জের টেনে নিয়ে যেতে হবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। মানে বিধানসভা ভোট। তারই হোমওয়ার্ক চলছে!