সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন। অর্থপ্রাপ্তির যোগ ... বিশদ
এটা ঠিক, এই কঠিন সময়ে বিদেশ নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বেমানান। উচিতও নয়। যে কোনও আর্ন্তজাতিক বিপর্যয়ের সময় সরকার ও বিরোধী
পক্ষ অন্তত এই একটা ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েই চলে। এটাই আমাদের রাজনৈতিক সৌজন্য ও শিক্ষা। এবারও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে কট্টরপন্থীদের বাড়বাড়ন্ত, বছরখানেক আগে ইমরান খানের গ্রেপ্তার, শ্রীলঙ্কার অভূতপূর্ব আর্থিক সঙ্কট এবং দু’বছর আগে রাজাপাক্ষের দেশত্যাগের পিঠোপিঠি এবার বাংলাদেশে হাসিনার আচমকা পতন ও কোথাও আশ্রয় না পেয়ে প্রাণভয়ে দিল্লিতে পালিয়ে আসা এপারের অস্বস্তি বাড়াতে বাধ্য। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো সেদেশের সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের হুঁশিয়ারি, ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনেতাকে যেন বেশিদিন আশ্রয় না দেয় দিল্লি। বারে বারে ঘুরে আসে একটাই অভিযোগ, ভারত সরকার যখন হাসিনাকে আশ্রয় দিতে পারল তাহলে আগাম ঢাকার নিয়ন্ত্রণ যে দ্রুত মুজিবুর কন্যার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেই ব্যাপারে সতর্ক করেনি কেন? অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ তো ২৪০’এ থেমে যাওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে শাসক বিজেপি’র কাছে কম বড় জ্বালা নয়। তার অভিঘাত এ দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলির নাগরিক জীবনকে টালমাটাল করে দিতে পারে আগামী দিনে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের।
গত সোমবার বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙার নির্মম দৃশ্য দেখে এই একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ঘুরে আসছে, দেশের বড় অংশের মানুষ যে পুরোপুরি বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে, তা ঘুণাক্ষরে কেন বুঝতে পারলেন না বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দু’শো বিচ্যুতির মধ্যে প্রথম ভুল, বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ‘রাজাকার’ মন্তব্য করা। দ্বিতীয় ভুল, আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে আওয়ামি লিগের সংগঠন ছাত্র লিগকে লেলিয়ে দেওয়া। আর তৃতীয় ভুল, ছাত্রদের উপর পুলিসকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া। এখান থেকেই পুরো আন্দোলনটা অন্যদিকে মোড় নেয়। সেনা নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় যে সরকার গঠিত হয়েছে তা কতটা ছাত্রদের দাবিকে সম্মান জানাবে, সন্দেহ আছে। ইউনুস সাহেবকেই বা সবাই মেনে নেয় কি না, সেটাও দেখার। কিন্তু আওয়ামি লিগের একাধিপত্য যে বলপূর্বক উপর থেকে চাপানো ছিল, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
একইসঙ্গে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ সব শ্রেণির শাসককুলের কাছেও বড় শিক্ষা। যেনতেনপ্রকারেণ ভোটে জেতার অর্থই জনগণ ষোলোআনা সঙ্গে, তার কোনও মানে নেই। বিশেষ করে সিংহভাগ বিরোধী দলই যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে, তাহলে শাসকের বিরুদ্ধে আঙুল উঠতে বাধ্য। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় গণতন্ত্রে অভিশাপ। একসময় বিস্ফোরণ হতে বাধ্য। বাংলাদেশের বর্তমান অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি, বাধ্য হয়ে হাসিনার দেশত্যাগ দুনিয়ার ক্ষমতার কারবারিদের সেই মোক্ষম শিক্ষাই দিয়ে গেল। ক্ষমতার দম্ভে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কুক্ষিগত করার মাশুল আজ না হয় কাল দিতেই হবে। মাত্র সাত মাস আগেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে হেলায় সেই ভোট লড়াইয়ে জয়ীও হন মুজিবুর কন্যা হাসিনা। সেই দিক দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে হাসিনা সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু প্রদীপের তলাতেই যে এত অন্ধকার কে জানত? ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তারপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর যে তিনটি নির্বাচনে জিতে তিনি গদি ধরে রাখেন, সেগুলি খুবই বিতর্কিত, একপেশে ছিল। কারণ বহু বিরোধী নেতানেত্রীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। মামলা থেকে বাঁচতে অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেন। মুজিবুর কন্যা ক্ষমতাকে এতটাই কেন্দ্রীভূত করেছিলেন যে তাঁকে অপরাজেয় বলেই মনে হচ্ছিল। এই বিরোধীশূন্য আবহে নির্বাচনে জয়লাভ যে আখেরে ব্যুমেরাং হতে বাধ্য, ইতিহাসের এই পাঠ মুজিবুর কন্যা নেননি। ছাত্র আন্দোলনের নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে গত সোমবার একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আবারও তা মনে করিয়ে দিল নির্মমভাবে। তাঁর বহু স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন, ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে লুটপাট চলল, ভাঙচুর হল। দেশে-বিদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন, সেই উন্নয়নকে নিমেষে ম্লান করে লাগামহীন দুর্নীতির পাল্টা জবাব এই বিক্ষোভের মাধ্যমে বেরিয়ে এল ঢাকার রাজপথে। তা সঙ্কট ডেকে আনল পড়শি এপার বাংলাতেও।
মোদিজি যতই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়ান, নিজেকে স্বঘোষিত বিশ্বগুরু সাজিয়ে ভাবমূর্তির মারকাটারি বিপণনে মন দিয়ে থাকুন, এই উপমহাদেশে দিল্লির কূটনৈতিক কর্তৃত্ব কিন্তু ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। একের পর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কট্টর ভারত বিরোধী মনোভাব মোটেই আমাদের বিদেশ নীতির ভালো বিজ্ঞাপন হতে পারে না। এটা ঠিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া পাকিস্তানকে ক্রমাগত অক্সিজেন দিচ্ছে চীন। মূলত ভারতকে চাপে ফেলতে। নেপাল, ভুটান থেকে মায়ানমারও ইদানীং আর্থিক প্রয়োজনে দিল্লির তুলনায় বেশি শুনছে বেজিংয়ের কথা। এর উপর বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশও কট্টর সেনা, বিএনপি, ছাত্র ও জামাত নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে দিল্লির বিপদ বড় কম নয়। এমনও খবর আছে, একটা নির্ভেজাল ছাত্র আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে পাকিস্তানের আইএসআই ও সেনার মদতে পিছন থেকে গোটা অপারেশনটা পরিচালনা করেছে চীনই। লক্ষ্য ভারতকে এই উপমহাদেশে ক্রমেই একঘরে করা। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছে চীন ও পাকিস্তান। প্যারিস থেকে উড়িয়ে এনে ইউনুস সাহেবকে এই সরকারের মাথা করার পিছনেই বা কোন বৃহৎ শক্তির হাত?
কিন্তু সব ছাপিয়ে মূল প্রশ্ন, পদ্মাপারে নাগরিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে এদেশে সবচেয়ে বড়
ক্ষতি কোন রাজ্যের? পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হলে তার ছাপ পড়ে কাশ্মীরে, পাঞ্জাবে। আর বাংলাদেশ? বারবার প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশের সঙ্গে এরাজ্যের স্থলসীমানা প্রায় ২ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত। এছাড়া জলসীমানাও আছে। সীমান্ত বরাবর রয়েছে ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, অসম সহ উত্তর-পূর্বের বিস্তীর্ণ এলাকা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দু’কোটিরও বেশি মানুষ এপারে এসে আশ্রয় নেয়। ঢাকা, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, যশোর, চট্টগ্রাম থেকে দলে দলে শরণার্থী ঢোকার সেই দুঃসহ স্মৃতিই কি আবার ফিরে আসছে এপার বাংলায়? হাবড়া, বনগাঁ, সুন্দরবন, বসিরহাট, কোচবিহার তার সাক্ষী। এর প্রভাব পড়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে, যা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য, বেকার সমস্যা এবং রুটিরুজির ক্ষতের সঙ্গে। সেইসঙ্গে দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি। এখন ওপারের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। তাই বিপদও বেশি।
এটা ঠিক, অরাজকতা চিরদিনই বিপন্ন মানুষকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল শান্ত ভূখণ্ডের দিকেই টেনে নিয়ে যায়। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাই ঘটেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ এবারও পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে মরিয়া। মূল উদ্বেগের বিষয় প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের ওপারের সংখ্যালঘুরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে ভারত সরকারের ভূমিকা কী হবে? সরকারিভাবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাট করে দরজা খোলা হবে না। কিন্তু একইসঙ্গে শীতলকুচি, ইসলামপুর, দক্ষিণ বেরুবাড়ি, হিলি সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকার অপেক্ষায় ওপারের মানুষজন। এরা সবাই কিন্তু নির্যাতিত হিন্দু সংখ্যালঘু নন। আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার সুযোগ নিয়ে জেল ভাঙা দাগী অপরাধীরাও মিশে গিয়েছে ভিড়ে। যদি তাদের একজনও ঢোকে, তাহলে এপারে নাশকতার আশঙ্কাই বাড়বে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি যার অনিবার্য পরিণতি। মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসতেই মৌলবাদীরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। কট্টরপন্থী জামাত এবং তার সঙ্গীসাথীদের গোপন এজেন্ডা স্পষ্ট, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও বিহারের কাটিহার, কিষানগঞ্জকে নিয়ে ইসলামিক বাংলাস্তান গঠন। নিঃসন্দেহে আমাদের রাজ্যের পক্ষে এমন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। এই ষড়যন্ত্রকে কিছুতেই সফল হতে দেওয়া যাবে না। অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে হবে, অন্যথায় সর্বনাশ। সেই কারণেই আগামী ৬ মাস বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিটি রাজ্য, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে, যাতে মৌলবাদীদের পরিকল্পনা সফল হতে না পারে।
সম্ভবত মুজিবুর কন্যা নিজেও আন্দাজ করতে পারেননি তাঁর জনসমর্থনের ভিত ধ্বংস করে দিয়েছে তোষামোদির উইপোকা। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই চেয়েছিলেন। আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের এই জমে থাকা ক্ষোভের বিন্দুমাত্র আঁচ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের কাছে ছিল না, এটাই বিস্ময়ের। জনসমর্থন হারালে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সরকার কঠোরভাবে বলপ্রয়োগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা সারা দেশে ভয় ও দমনের পরিবেশ তৈরি করে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের সমালোচনার কণ্ঠরোধ করতে এবং অনলাইনে প্রচার ঠেকাতে হাসিনা সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও জারি করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
ভারতের পক্ষে এই পরিস্থিতি ঢাকার চেয়ে কম চ্যালেঞ্জিং নয়। তবে যিনিই দায়িত্বে আসুন, ভারতের একটাই চাহিদা, পরিস্থিতি দ্রুত স্থিতিশীল হোক।
সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরে আসুক। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসুক, নাহলে এপারেও স্বস্তি ফিরবে না। কাঁটাতারের ওপারে ভিড় বাড়তেই থাকবে।