আয় বৃদ্ধি ও গৃহসুখ বৃদ্ধি। কর্মস্থলে সাফল্য ও প্রশংসা লাভের সম্ভাবনা। শরীর-স্বাস্থ্য বুঝে চলুন। ... বিশদ
একেবারে সোজা পাটিগণিতের অঙ্ক। অভিজ্ঞ নির্মলাদেবী একমাথা পাকাচুল বাগিয়ে যতই বলুন না কেন ‘করদান প্রক্রিয়া আরও সহজ করার জন্যই এই পদক্ষেপ’... আদপে মধ্যবিত্তের জন্য গর্ত খুঁড়ে দিলেন তিনি। সাফাই দেওয়ার অনেক চেষ্টা এই এক হপ্তায় চালিয়েছে কেন্দ্র। সরকারের তরফে উদাহরণ দিয়ে একটি ‘কেস স্টাডি’ও প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু নজর করার মতো বিষয় কী? সেখানে এমন একটি সম্পত্তিকে শিখণ্ডী হিসেবে খাড়া করা হয়েছে, যার বাজার দর বছরে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। তাহলে অবশ্যই নতুন নিয়মে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স কম দিতে হবে। কীভাবে? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরে নিন আপনার ফ্ল্যাটের দাম বছরে ১২ শতাংশ হারে বেড়েছে। সেক্ষেত্রে কী হবে?
অর্থাৎ মহামান্য ভারত সরকার দেখিয়ে দিচ্ছে, নতুন নিয়মে আপনাকে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স কম দিতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কি সত্যিই তাই? ফর্মুলার প্রথম শর্তটা একটু বদলে দিন। মানে, বছরে ওই রিয়েল এস্টেট সম্পত্তির বাজার দর বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনুন। যেমন ধরুন ৪ শতাংশ। তাহলে অঙ্কটা কেমন দাঁড়াবে?
এটাই আড়ালে রেখে দেওয়া নগ্ন বাস্তব। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কেন ১০ শতাংশের নীচে হিসেবটা ধরতে হবে? উত্তরটা হল, দেশের অধিকাংশ প্রথম শ্রেণির শহরে রিয়েল এস্টেট প্রপার্টির বাজার দর বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের উপর নয়। কলকাতায় এটা ৫ শতাংশ। আর মুম্বইতে? মাত্র ১ শতাংশ। শুধু হায়দরাবাদে এই অঙ্কটা ১০ শতাংশ। যদি গোটা ভারতের গড় করা যায়, তাহলে ৫ শতাংশের বেশি কোনও শহরে সম্পত্তির দর বাড়ে না। তাহলে এমন একটা নিয়ম আচমকা কেন চালু করা হল? কার স্বার্থে? মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত নিশ্চয়ই নয়।
অনেক কষ্টে মধ্যবিত্ত তার স্বপ্নের বাড়ি বানায়। আর বুকে অনেক বড় পাথর চেপে তা বিক্রিও করে। কখনও সন্তানের পড়াশোনার জন্য, আবার কখনও মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে। আমদানি শুল্ক কমানোর পরও সোনার দাম ৬৫ হাজারের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। মেয়েকে সাজানোর মতো কিছু তো দিতেই হবে। তাতেই অন্তত লাখ পাঁচেক টাকার খরচ। জামাইকে একটা বাইক কিনে দিলে ভালো হয়। ও চায়নি... তাও। মেয়েও তো চড়বে। এছাড়া বাড়ি ভাড়া আছে, কেটারার, বরযাত্রীদের যত্নআত্তি। না দেখা খরচের তো ইয়ত্তা নেই। অনেক ভেবেচিন্তেই হয়তো আপনি ফ্ল্যাটটা বিক্রির কথা ভেবেছিলেন। লোন শোধ করে যা বাঁচবে, মেয়ের বিয়েটা হয়ে যাবে। কিন্তু এই বাজারে এতগুলো টাকা সরকারকেও দিতে হবে?
মধ্যবিত্ত এই বাড়তি বোঝাটা মেনে নেবে তো নির্মলাদেবী? এমনিতেই নতুন কাঠামোয় আয়করে বিনিয়োগের বাড়তি সুবিধা মেলে না। পুরনো কর কাঠামোয় গৃহঋণের সুদের অংশটা সরাসরি আয়ের থেকে বাদ হয়ে যেত। তারপর হিসেব হতো আয়করের। এছাড়া ৮০সি ধারায় দেড় লক্ষ টাকা ছাড় তো ছিলই। গৃহঋণের ‘মূল’ অর্থাৎ প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্টও ওর মধ্যে ঢুকে যেত। সোজা কথায়, লোন নিয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনলে মাছের তেলে মাছ ভাজার কিছুটা সুবিধা পেত চাকরিজীবী সমাজ। আর তাই সে ঝুঁকিটা নিত। ঝাঁপ দিত ‘ড্রিম হোমে’র লক্ষে। আর তিলে তিলে... একটু একটু করে। আয়ের অর্ধেক টাকা হয়তো সে ইএমআই দিত। তাও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এখন? ইএমআই বাস্তব অর্থেই মধ্যবিত্তের কাঁধে বোঝা। তার উপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স গুনতে হলে তো কথাই নেই। পুরনো বাড়ি যিনি বিক্রি করছেন, তিনি কখনওই বাড়তি টাকা নিজের পকেট থেকে গুনতে চাইবেন না। তাঁর চেষ্টা থাকবে, ক্রেতার থেকেই ওর বেশিরভাগটা উশুল করে নেওয়ার। আর তাই ক্রেতার কাঁধ আরও একটু ঝুঁকবে। এবং বিক্রেতাও সেই টাকাটা অ্যাকাউন্টে নেবেন না। লেনদেন হবে নগদে। এ তো গেল খুচরো লেনাদেনা। নতুন নিয়মে অধিকাংশ মানুষই কিন্তু আর সম্পত্তির সঠিক দাম দেখাতে চাইবেন না। ছোটখাটো ব্যবসায়ী, প্রোমোটাররা চাইবেন সার্কল রেটটাই দেখাতে। অর্থাৎ, বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, কিন্তু দেখানো হবে সরকার নির্ধারিত সার্কল রেট। আসল দাম নয়। বাকি টাকাটা তাঁরা নেবেন ক্যাশে। মানেটা খুব পরিষ্কার, রিয়েল এস্টেটে কালো টাকার দরজা হাট করে খুলে দিল এনডিএ সরকার। আর তাতে সিলমোহর দিলেন নির্মলাদেবী। এতে কিন্তু সরকারেরও বিপত্তি। কেন? যে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স আমদানির লোভে এই নিয়ম চালু, সম্পত্তির আসল দাম পাবলিক না দেখালে তার কানাকড়িও রাজকোষে যাবে না। সরকার দেখবে, আপনি ২০ লাখে কেনা ফ্ল্যাট ওই দামেই বিক্রি করছেন। পাঁচ লক্ষ টাকা আপনি যে নগদে নিয়েছেন, তা জানা যাবে না। কী করবেন নির্মলাদেবী? ঘরে ঘরে ইনকাম ট্যাক্স অফিসারদের পোস্টিং? সেও যে সম্ভব নয়। যে সম্পত্তির দাম সার্কল রেট বা ক্রয় মূল্যের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে, সেখানে আপনার হাল হবে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো। এক কোটি টাকার জমি যদি কেউ ১০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করে, সেখানে আপনি গন্ধ পেতে পারেন। দু’-পাঁচ লক্ষের লেনদেনে নয়। আর এক কোটি টাকার জমি কিনবে শিল্পপতিরা, সমাজের উপর তলার শ্রেণি। তিনি ১০ লক্ষ টাকা ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দিতে পারলে ১২ লক্ষ টাকাও পারবেন। কিন্তু পারবে না মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্ত। হুড়মুড় করে পড়বে রিয়েল এস্টেট শিল্পের বাজার। পথে বসবেন বহু ছোট ব্যবসায়ী। তাহলে দেশের কত শতাংশ মানুষের জন্য এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলেন নির্মলাদেবী? সাধারণ মানুষ আপাত দৃষ্টিতে যা দেখছে, তার বাইরেও কেউ আছে নাকি?
২০১৪ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এদেশে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টকে (আরইআইটি) আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, একঝাঁক বিনিয়োগকারী মিলে একটি ট্রাস্ট, যারা মার্কেটে শেয়ার ছাড়তে পারবে। এদের কাজ কী? ধরে নিন, শপিং মলের একটি দোকান তারা কিনবে। এই ট্রাস্টের সদস্যরা মিলে টাকা দিলেন এবং সেই দোকানটি কেনা হল। তাতে ভাড়া বসিয়ে যে টাকা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই তাদের শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ড হিসেবে দেওয়া হবে। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী আপনি শেয়ার কিনলেন (দোকানে লগ্নি করলেন) এবং সেই মতো ডিভিডেন্ড পেলেন। এও এক ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড। এবারের বাজেটে তাদের লাভ কী হল? দীর্ঘমেয়াদি ক্যাপিটাল গেইনে এতদিন তাদের ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। এবার সেটা নেমে এসেছে সাড়ে ১২ শতাংশে। তার উপর জমি-বাড়ির ক্ষেত্রে এতদিন তিন বছরের মধ্যে লগ্নি অথবা কর না দেওয়ার যে সুযোগ ছিল, সেটাও নামিয়ে আনা হয়েছে এক বছরে। একেবারে বাজারের অন্য কোম্পানির শেয়ারের হিসেবে। ফল? এই ধরনের ট্রাস্টের এবার পোয়াবারো। বহু মানুষ যাঁরা রিয়েল এস্টেটে শুধু অ্যাসেট ইনভেস্টমেন্ট করতেন, তাঁরা ঝুঁকবেন ট্রাস্টে। অর্থাৎ, শেয়ার বাজারে। ২০২১ সালের হিসেবে পাঁচটি এমন ট্রাস্ট ভারতের শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত। এই সংখ্যাটা এবার বাড়বে। মানুষও ঝুঁকি নিয়ে শেয়ার বাজারে হাত পোড়াবে। এটাই তো লক্ষ্য মোদি সরকারের। কর্পোরেট, শেয়ার বাজার, সাধারণ মানুষের রক্ত জল করা টাকার গতিপথ একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। কালো টাকার বাজার খুলছে। মধ্যবিত্ত হয়ে উঠছে নিম্নবিত্ত। আর নিম্নবিত্ত নিঃস্ব। মোদি ৩.০-তে আপনাকে স্বাগত।