অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এরাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর ব্যাপারে একজোট। তাদের দাবি, রাজ্য পুলিসকে দিয়ে নিরপেক্ষ ভোট সম্ভব নয়। তাতে ভোট লুট হয়। তাই পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা, সব নির্বাচনেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানায় বিরোধীরা।
কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করালে রাজ্যের শাসক দল ট্যাঁ ফোঁ করতে পারে না, উল্টে কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে তারাই বেনিফিট পায়, এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে আছে। এই ধারণা ভুল না ঠিক, সেই বিতর্ক থাক। বাস্তবটা হল, এরাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করালে বিজেপি, সিপিএম উল্লসিত হয়। সেই উল্লাস গোপন থাকে না। বিজেপির নেতারা কর্মীদের এই বলে চাঙ্গা করেন, এবার আর ‘দিদির পুলিস’ নয়, ভোট করাবে ‘দাদার পুলিস’।
এহেন ‘দাদার পুলিস’ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজ্যের শাসক দলের ক্ষোভ থাকতেই পারে। তার কারণ কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা অধিকাংশই হিন্দিভাষী। তাঁরা বাংলা বুঝতে পারেন না। তাতে অনেক সময় ছোটখাট বিষয়কে কেন্দ্র করেও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়াও জওয়ানদের বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে ভোট করানোর ও ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ তো আছেই।
এবারের নির্বাচনেও বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে ভোট করানোর অভিযোগ উঠেছে। মেদিনীপুরের একটি বুথে এক জওয়ানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ওঠায় তৃণমূল প্রার্থী জুন মালিয়া তাঁকে সতর্ক করে দেন। সেই দৃশ্য গোটা রাজ্য প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকী, ভোটের দিন বিজেপি কর্মীদের বাইকে চেপে জওয়ানদের বিভিন্ন এলাকায় টহল দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এই নিয়ে কাঁথি লোকসভার পটাশপুরে অশান্তিও হয়েছে। জওয়ানদের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে টানাটানি পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ভোটারদের আটকে দেওয়া ও হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে প্রচুর। কারণ বিজেপি মনে করে, সংখ্যালঘুরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কমিটেড ভোটার’।
এহেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেই ষষ্ঠ দফার ভোটে একের পর এক বিজেপি প্রার্থী আঙুল তুলেছেন। কেউ বলেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী তার দায়িত্ব পালন করছে না। কেউ বলেছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কেবল বুথ রক্ষার দায়িত্ব পালনে বিজেপি নেতারা সন্তুষ্ট হননি। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, কোনও অভিযোগ জানালেই কেন্দ্রীয় বাহিনী তাদের উচিত ‘শিক্ষা’ দেবে। তা না হওয়ায় চরম হতাশ বিজেপি নেতারা। সেটা স্পষ্ট হয়েছে তমলুকের বিজেপি প্রার্থীর মন্তব্যে। তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো লোকজনকে তাড়া করে সরিয়ে দেওয়ার পর অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী বাঁশি বাজাচ্ছে।’ তাঁর এই মন্তব্যে অনেকেই ছুড়ে দিয়েছেন কটাক্ষ, তাহলে কি আরও একটা শীতলকুচি দরকার ছিল?
তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ঘাটালের বিজেপি প্রার্থী হিরো হিরণ। ভোটের দিন কেশপুরে ঢুকতে গিয়ে হিরণ চট্টোপাধ্যায় একাধিকবার বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। তাতে অধিকাংশ বুথেই তিনি যেতে পারেননি। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। তাঁর মতে, অবস্থা পঞ্চায়েত ভোটের চেয়েও খারাপ। তবে তাঁর বিস্ফোরক মন্তব্যটি হল, রাজ্য পুলিস ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ হয়ে গিয়েছে।
হিরণের এই মন্তব্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারা। তাঁদের খুশি হওয়ারই কথা। বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে সেটিংয়ের তত্ত্ব তাঁরা একুশের নির্বাচনের আগে থেকেই আওড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, উভয় দলের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া আছে বলেই সিবিআই, ইডি কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বাহিনীও সেইমতোই আচরণ করছে। সেটা বিজেপির প্রার্থীও উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি ‘ম্যাচ ফিক্সিং’য়ের কথা বলেছেন।
বাংলায় সর্বাধিক কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই বঙ্গ বিজেপির নেতারা উদ্বাহু নেত্য শুরু দিয়েছিলেন। বিজেপির নেতা ও প্রার্থীরা ভেবেছিলেন, একটা ফোন করলেই ঘটনাস্থলে গিয়ে তৃণমূল কর্মীদের পিটিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেবে বাহিনী। তাঁরা যে কাজটা নিজেরা করতে পারছেন না, সেটা করে দেখাবে ‘দাদার পুলিস’। আর সেই দায়িত্ব পালনে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় তারজন্য নির্বাচনের অনেক আগেই বাংলায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছে। উদ্দেশ্য, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পদক্ষেপ করা। তারজন্য রুটমার্চ করিয়ে এলাকা চেনানোও হয়েছিল।
জওয়ানরা বাংলায় পা রেখে বুঝেছিলেন, বাংলা অন্য রাজ্যের চেয়ে আলাদা। এখানে বিজেপি নেতাদের খুশি করতে গেলে পাল্টা প্রতিরোধ হবে। তাতে পরিস্থিতি ঘোরালো হবে। জওয়ানদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সেটা ভোটের দিন পটাশপুরে গিয়েই তাঁরা টের পেয়েছেন। বিজেপি নেতাদের বাইকে চেপে বাহিনী ঘুরছে, এই অভিযোগ তুলে গ্রামের লোকজন তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। এমনকী, জাওয়ানদের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে টানাটানির ঘটনাও ঘটেছিল। মারমুখী জনতার হাত থেকে বাঁচার রাস্তা ছিল একটাই, পিঠটান দেওয়া। ‘দাদার পুলিস’ সেদিন সেটাই করেছিল।
নির্বাচন ঘোষণার সময় বাংলায় ৯২০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। সপ্তম দফায় এসে তা বেড়ে হয়েছে ১০২০ কোম্পানি। কিন্তু বাহিনী বাড়িয়ে কি বিজেপির খুব একটা লাভ হবে? একুশের নির্বাচনেও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে বাংলাকে মুড়ে দিয়েছিল। তারসঙ্গে ছিল নির্বাচন কমিশনের কড়া নজরদারি। প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য একের পর এক অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপরেও বিজেপি বাংলায় দাঁত ফোটাতে পারেনি। এবারও সেই একই ছক। প্রথমেই রাজ্য পুলিসের ডিজিকে
সরিয়ে দিল। তারপর ভোটের দফা যত এগিয়েছে কমিশনের শাস্তির তালিকা ততই লম্বা হয়েছে।
এসব করে যে কোনও লাভ হয় না, সেটা বিজেপি নেতারাও জানেন। তবুও তাঁরা এসব করান। কারণ নেতৃত্বের বিশ্বাস, ঝিমিয়ে পড়া কর্মীদের চাঙ্গা করার এটাই সেরা ‘টনিক’।
এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজেপি নেতৃত্ব প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিল কেন? কেন্দ্রের সরকার তাদের। কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণে। তার সর্বময় কর্তা অমিত শাহ। তা সত্ত্বেও বাহিনীর কাজে কেন এত অসন্তোষ, কেন এত ক্ষোভ?
আসলে বঙ্গ বিজেপির নেতারা ভেবেছিলেন, সিবিআই, ইডি যেভাবে তৃণমূল সহ বিরোধীদের শায়েস্তা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীও সেই একই কাজ করবে। সেই অনুযায়ীই তৈরি হয়েছিল পরিকল্পনা। ভোটের দিন বাছাই করা সংখ্যালঘু ও তৃণমূল প্রভাবিত এলাকায় গিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। সেখানে গিয়ে হম্বি তম্বি করেছেন। অশান্তি বাঁধানোর জন্য যাকে তাকে ধরে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আর সবটাই করেছেন ক্যামেরার সামনে। তবে বিজেপির প্রার্থীরা যত তোড়পেছেন ততই জমাট বেঁধেছে মানুষের প্রতিরোধ। তাতেই ভেস্তে গিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সামনে রেখে বিজেপির এলাকা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা।
অনেকে বলছেন, মানুষের মুড দেখে প্রার্থীরা বুঝেছেন, ভোটের ফল কী হতে চলেছে। সেটা বুঝেই তাঁরা আগাম সাফাইটা দিয়ে রাখলেন।