অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
বাজপেয়ি নির্ঘাৎ দুঃখ করে আরও লিখতেন, ‘আমাদের দলের সবথেকে বড় সম্পদ কী ছিল? উন্নত ভাষণ। অসাধারণ বাগ্মিতা। আর সৌজন্যবোধ।
আমি কল্পনা করতে পারি না যে ওরকম একটি পদে বসে কোনও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এসব কথা বলতে পারেন? ১) বিরোধীরা জয়ী হলে হিন্দু নারীর মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে। ২) হিন্দুদের দুটো মহিষ থাকলে একটি মহিষ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দেওয়া হবে। ৩) আমি জৈবিকভাবে জন্মগ্রহণ করিনি। আমাকে ঈশ্বর মানুষের সেবার জন্য পাঠিয়েছেন। ৪) ১৯৮২ সালে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর সিনেমার আগে গান্ধীজিকে বিশ্বের কেউ চিনত না। ওই গান্ধী নামক সিনেমাই তাঁকে চিনিয়েছে। ৫) বিরোধীরা যতই মুজরা করুক, আমার সিদ্ধান্তকে বদল করতে পারবে না।
আমাদের দলের কেউ এরকম ভাষা ব্যবহার করছে? আমাদের দলের? এটা কল্পনা করা যায়? আমার প্রশ্ন হল, এসব কেন করতে হল এই নির্বাচনে? তুমি কি এই প্রথম টেনশনে? তোমার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কি টলে গিয়েছে? তুমি তো এমনিতেই এগিয়ে ছিলে এবার? কেউ কি বলছে যে, তোমার দল হেরে যাবে? সরকার গড়তে পারবে না? কেউ বলছিল না। কিন্তু এখন সকলের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। আব কী বার চারশো পার। বলারই দরকার ছিল না। দরকার তো ২৭২! চারশো পার তো হবেই না! কোনওমতেই না। তাহলে কেন বলা?’
অটলবিহারী বাজপেয়ির এই চিঠি লেখার প্রশ্নই নেই। কাল্পনিক এই চিঠির অবতারণা করার কারণ হল, ২০২৪ সালের নির্বাচনে সবথেকে বিস্ময় জাগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি অনেক যত্ন করে ১০ বছর ধরে একটি ইমেজ রচনা করেছিলেন নিজের। যে আশ্চর্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে তিনি বহু হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন একক ক্যারিশমায় সেটা চরম এক সাফল্য। কিন্তু মাত্র একমাসের মধ্যে ভোটপর্বে মোদি নিজের সেই ঈর্ষণীয় ভাবমূর্তি ভেঙে দিলেন। প্রচারের সময় তাঁর মুখে শোনা গেল, যোগী আদিত্যনাথ, অনুরাগ ঠাকুর, সাধ্বী প্রজ্ঞাদের মতো ভাষা।
নরেন্দ্র মোদির সবথেকে বড় ক্ষতি হল তিনি যে আদৌ স্টেটসম্যান রাজনীতিক হতে পারেননি, এই লোকসভা ভোটে সেই প্রমাণ দিলেন তিনি নিজেই। এই লোকসভা ভোট ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটাই বহু গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে শেষ লোকসভা ভোট। ২০২৯ সালে মোদি নিজেই কি আর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কিংবা দলের সেনাপতি থাকবেন? থাকবেন না। অবশ্যই সরে যাবেন। এমনকী তার আগেও সরতে পারেন। লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশকুমার, নবীন পট্টনায়ক, এইচ ডি দেবেগৌড়াদের অবসর অবশ্যম্ভাবী। এই চারজনের সক্রিয় রাজনীতি থেকে অন্তরালে চলে যাওয়ার অর্থ হল, স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া সমাজবাদী রাজনীতির অনুগামী ও ধারকদের চিহ্ন মুছে যাবে আগামী দিনে। অর্থাৎ লোহিয়াপন্থী রাজনীতির শিষ্যরা আর কেউ থাকবেন না। অবসর নেবেন শারদ পাওয়ার। তাঁরও এই লোকসভা ভোটে শেষ সক্রিয় যোগদান। ২০২৬ সালে আবার জয়ী হয়ে একক গরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হলে, ধীরে ধীরে হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আর এত সক্রিয় থাকবেন না। দলের সুপ্রিমো হয়তো থাকবেন। কিন্তু নিত্যদিনের প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা থেকে অনেকটাই ২০২৯ সালে দেখা যাবে গুটিয়ে নিয়েছেন। সোনিয়া গান্ধী শারীরিক কারণে এখনই অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছেন। এবারই ভোটে লড়াই করেননি। সুতরাং তাঁকেও আর দেখা যাবে না সামনের সারিতে।
অর্থাৎ পুরনো প্রজন্ম এবারই শেষ লড়াইটা লড়ে নিল হয়তো। পরবর্তী লোকসভা ভোটের কারিগরদের নাম হবে তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদব, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীরা। বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহ। মোদি এবার ভোটে রাহুল গান্ধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে নিজের স্ট্যাটাস বিরোধী এতটা অসৌজন্যের ভাষ্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকলেই হয়তো তাঁর স্থান ইতিহাসে আর একটু উজ্জ্বল থাকত। এবারই প্রথম দেখা গেল, মোদির এইসব ভাষণকে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। অর্থাৎ তাঁর ভোটব্যাঙ্ক অন্য কারণে তাঁকে যথারীতি ভোট দিলেও অন্তত এসব ভাষণের ভাষা তাঁদের স্পর্শই করেনি। কোনও রাজ্যে দেখা যায়নি যে, মোদির এসব ইস্যু নিয়ে কোনও আলোচনা হচ্ছে। তাঁকে সমর্থন করা হচ্ছে। আর তিনি সম্ভবত ভুলেও গিয়েছেন যে, রাহুল গান্ধীর হাতে আরও অন্তত ২০ বছর আছে। তাঁর বোনের হাতে তার থেকেও বেশি। রাজনীতিক হিসেবে মোদি অস্তমিত সূর্য। একথা তিনি কি মেনে নিতে পারছেন না? তাঁর উচিত ছিল, ২০২৪ সালের ভোটের প্রচারকে নিজের সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এক উদার ও সৌজন্যমূলক ইমেজ গঠনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।
তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল যে, বাজপেয়ি কতটা বুদ্ধিমত্তার রাজনীতি করে গিয়েছেন। লালকৃষ্ণ আদবানির উগ্র হিন্দুত্বকে মুখ বলা হতো বিজেপির। আর বাজপেয়ির উদার মুখকে মুখোশ। বাজপেয়ির তুলনায় দলের উপর আদবানির কর্তৃত্ব অনেক বেশি ছিল। বাজপেয়ি কিন্তু সেই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে সুকৌশলে নিজের উদার সৌজন্যময় এবং স্টেটসম্যানসুলভ ভাবমূর্তিকেই লালন করে গিয়েছেন শেষদিন পর্যন্ত। আর তার ফলশ্রুতি হল, আজ আদবানির উগ্র হিন্দুত্বের জায়গা নিয়েছেন মোদি। আরও বহু ধাপ এগিয়ে। তৈরি হচ্ছেন আরও কয়েক ধাপ এগনোর জন্য যোগী আদিত্যনাথ। কিন্তু কই? বিজেপিতে কোনও অটলবিহারী বাজপেয়ি তো আর তৈরি হল না! আর তাই আজও বাজপেয়িই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক মহল অথবা দলমতনির্বিশেষে দেশবাসীর কাছে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমীহের স্থান চিরস্থায়ী করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। আদবানিকে তাঁর দল ও দেশ অতটা মনে রাখছে না। বাজপেয়িকে কিন্তু রাখছে। দেশের নাম ভারত। জিত হয় উদারতার। সৌজন্যের। ভদ্রতার। মোদি শেষ বাস মিস করলেন! ভুল অঙ্ক খেললেন এতটা উগ্র আর অশোভন হয়ে গিয়ে। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লাভের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করলেন। মোদির দুর্ভাগ্য। তিনি নেহরু হতে পারলেন না। বাজপেয়িও হতে পারলেন না!