অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
ভোট এলেই তাঁদেরও মুখে শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের নাম। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের প্রচারে ঘন ঘন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর ভোটের পরই প্রয়োজন ফুরিয়েছিল গুরুদেবের। তাতে হয়তো তিনি হাঁপ ছেড়েই বেঁচেছিলেন। কারণ, রবীন্দ্র-ভাবনা তাঁর পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’। এক ধরনের গণতান্ত্রিকতার আদর্শ এই বাণীতে নিহিত আছে, যে আদর্শ মানলে রাজার রাজত্বে সবাই রাজা। অন্যের সম্মান করলে অন্যেও তোমার সম্মান করবে, তাই প্রকৃত সম্মান। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিদের রাজধর্মে এমন নীতি ‘অচল’। তাঁদের নীতি— অপরকে ছোট করো, অগ্রাহ্য করে কেবল নিজের এবং নিজেদের ঢাক প্রচণ্ড রবে পেটাও। আত্মপ্রচারের বহর যত বিপুল হবে, অন্যের গৌরবকে অস্বীকার করার প্রবণতাও ততটাই প্রবল হবে— এটাই তাঁদের জীবনাদর্শ। শাসক ভুল করতে পারে, এমন ধারণা ভারতের বর্তমান শাসকরা মানেন না, তাঁদের শাসন-তন্ত্রে সেই ধারণার কোনও স্থানই নেই। এই দুর্মর এবং অটল অহমিকা কীভাবে গণতন্ত্রের ভিতটিকে নষ্ট করে দিতে পারে, এক দশক ধরে ভারতের নাগরিকরা কার্যত প্রতিনিয়ত তার সাক্ষী।
গোটা লোকসভা ভোটে দেখা গেল, গেরুয়া শিবির ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারতের রাজনৈতিক স্লোগানটিকে এমন আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগে তৎপর যে, দেশের ইতিহাস থেকেও কংগ্রেসের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে পারলেই যেন তাঁদের অন্তরাত্মা তৃপ্ত হয়। জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিং সম্পর্কে তাঁদের বিরাগ এতটাই প্রকট যে, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তারস্বরে প্রচার করেন, কংগ্রেসের শাসনে ভারতের কোনও উন্নতিই হয়নি। পারলে এই শাসকরা বুঝি গান্ধীজির নামও মুছে ফেলতেন, তা নিতান্ত অসম্ভব বলে তাঁকে আত্মসাৎ করার বিচিত্র কৌশল নেন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, যাঁরা অন্তরে নিজেদের মর্যাদা নিয়ে সতত গভীর অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তাঁরাই প্রাণপণে বিরোধীদের সমস্ত কৃতিত্ব ও অবদানকে অস্বীকার করতে ব্যস্ত হন। তাঁরা জানেন, লোকে তাঁদের সম্মান করে না, বড়জোর ভয় পায়। অতএব জোর করে সমস্ত বিষয়ে সব কৃতিত্বের স্বীকৃতি বেদখল করার এমন মরিয়া উদ্যোগ। এই ব্যাধি যে সারবার নয় তা বোঝা গিয়েছে বিজেপি নেতাদের ভোট প্রচারেই। এই নেতারা কি জানেন চীন সফরে গিয়ে বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘দ্য মিক শ্যাল ইনহেরিট দি আর্থ’: দুর্বলরা একদিন এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে। সেই চীনের বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধাভরে ‘চু চেন-তান’ নামে ডাকতেন। যার অর্থ, ভারতের বজ্র-নির্ঘোষী সূর্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা রাষ্ট্রক্ষমতা বিরোধী বজ্রনির্ঘোষ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অহংকার থেকেই নিজের সামর্থ সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়, সেই অহংকারের মধ্যেই নিহিত থাকে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মধ্বংসের বীজ।’
টানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও হিন্দুত্ববাদী নেতারা বুঝতেই পারলেন না, ভারতীয় মূল্যবোধ বা ভারতীয়ত্বের শিকড় আসলে ইতিহাসের অনেক গভীরে। সভ্যতার নানা প্রবাহে বা জীবনের নানা ক্ষেত্রে ভারত যে সমস্ত শৃঙ্গ জয় করতে পেরেছে আজ, সেই সব জয়ের ভিতগুলি তৈরি হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে বিপুল বৈচিত্র্যের সমাহার ঘটাতে পারাই এই ভারতভূমির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট। বহুত্বের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোনও এক অভিন্ন বিন্দুতে পৌঁছতে পারাই ভারতীয়ত্ব। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সে কথাই আজ মনে করিয়ে দিতে পারে আরও একবার। তিনি বলেছিলেন, আমরা নাকি ধর্মপ্রাণ জাতি! তার পরিচয় হল কেমনধারা?... নির্বিচারে ধর্মের নামে মেনে নেওয়ার নাম উদারতা নয়, তা হল ভয়ঙ্কর অন্ধতা, জড়তা। এই জড়তাকে যখন কোনও জাতি উদারতা মনে করে পূজা করে তখন তার মরণ আসন্ন।... ভারতের আজ এই দশা। এই দিক থেকেই তার মৃত্যুর আয়োজন চলছে। ধর্মের নামে পঙ্গুত্ব দেশজুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে।
কবিগুরু মূঢ় ধার্মিকতা, ধর্মমোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘...ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়। ও যেন আগুন আর ছাই। ধর্মতন্ত্রের কাছে ধর্ম যখন খাটো হয় তখন নদীর বালি নদীর জলের উপর মোড়লি করিতে থাকে।... ধর্ম বলে, যে মানুষ যথার্থ মানুষ সে যে-ঘরেই জন্মাক পূজনীয়। ধর্মতন্ত্র বলে, যে মানুষ ব্রাহ্মণ সে যত বড়ো অভাজনই হোক মাথায় পা তুলিবার যোগ্য। অর্থাৎ মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র।’ তিনি অস্পৃশ্যতা, জাতপাত প্রবলভাবে ঘৃণা করতেন। তিনি ধর্মে আস্থাবান, ধর্মের বিকৃতিতে, আচারসর্বস্বতায়, আগ্রাসী ভঙ্গিতে আস্থাবান নন। ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করেছেন, ফরাসি বিপ্লব, মেক্সিকোর বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, স্পেন বিপ্লবে বিদ্রোহীরা প্রচলিত ধর্মের জাড্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। যে হিন্দু মুসলিমকে ম্লেচ্ছ মনে করে, যে মুসলিম হিন্দুকে কাফের মনে করে, সেই হিন্দু-মুসলিমের ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন না হলে সমস্যার সমাধান অসম্ভব। ধর্ম মানুষকে সঙ্কীর্ণ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ছিল ‘নেশন’-ই রূপান্তরিত হয় সাম্রাজ্যবাদে। তাঁর চিন্তায় ‘নেশন’মাত্রই সঙ্কীর্ণ জাত্যভিমান এবং স্বার্থান্ধ সাম্রাজ্যবাদ।
গেরুয়া শিবির জানে, যে কোনও ধর্মেই ধার্মিক অপেক্ষা ধর্মভীরু মানুষ বেশি। এই সংখ্যাধিক্যের মনকে লক্ষ্য করে যে দল রাজনৈতিক কর্মসূচি নেয়, তার এক প্রচ্ছন্ন গ্রাহ্যতা, মান্যতা থাকে। বিজেপি-রাজনীতির রণকৌশলে আছে দু’টি দিক, সংঘর্ষ ও নির্মাণ। ‘ব্র্যান্ড মোদি’ ঢক্কানিনাদে যা প্রচ্ছন্ন রাখা হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মতাদর্শ অনুসারী শাখা সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে বনবাসী, জনজাতি, মহিলা, ছাত্র ও অন্যান্য বর্গে নিরন্তর সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন দলীয় ব্রতীদের লেগে থাকা। এটা নির্মাণের দিক। সঙ্গে থাকে গোমাতা, এনআরসি, সিএএ, সিভিল কোড নিয়ে সংঘর্ষের অভিমুখ। মোদি, শাহ, আদিত্যনাথ যতটা দৃশ্যমান, অদৃশ্যে আছে ধারাবাহিক নেপথ্য কর্মযজ্ঞ। ফলে আরও স্পষ্ট যে, ভারতীয় রাজনীতি থেকে ধর্মের মুদ্রাদোষ যাওয়ার নয়। আর তাই মন্দিরকে কেন্দ্র করে ‘হিন্দুরাজ’-এর ধ্বনি তোলা জাতীয়তাবাদী মেরুকরণের রাজনীতি বিধ্বস্ত জনসাধারণের দাবির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দেয় সহজেই। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থানের অব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, এমন সমস্ত মৌলিক সমস্যা হারিয়ে যায় ধর্মভিত্তিক বিভাজনকারী রাজনীতির অন্ধকারে! সেই কবে ‘রাশিয়ার চিঠি’-তে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে-রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে, সে-রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে-ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে।... ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।’
তাকিয়ে দেখুন, গোটা দেশজুড়ে যখন হাসপাতাল ও বিদ্যালয় নির্মাণের প্রয়োজন, তখন মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে ১০০০ মানুষ পিছু ০.৫টি হাসপাতালের বেড আছে। ন্যূনতম প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো আমাদের গ্রামীণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নেই। ২০২৩ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশের গ্রামাঞ্চলের ১৪-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের ২৫ শতাংশ নিজের মাতৃভাষায় লেখা পাঠ্যবই পড়তে হোঁচট খায়। গ্রামের এই বয়সের ৫০ শতাংশ ছেলেমেয়ে সাধারণ ভাগের অঙ্ক করতে গিয়ে আটকে যায়। অথচ, আমাদের দেশে হাজার হাজার সরকারি বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের এই বেহাল অবস্থার পরিবর্তন করার পরিবর্তে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, ও তার সঙ্গে দেশজুড়ে নানা দেব-দেবীর মন্দির নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। আসলে শাসক চান, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি মন্দির আর মসজিদের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকুক।
বিজেপির রাজনৈতিক খেলায় আমাদের দেশে ধর্মীয় মেরুকরণের যে আবাদ হচ্ছে, তা রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন। তাঁর অজস্র লেখায় তার প্রমাণ আছে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুত্বের অনুপ্রবেশের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে মুসলিম ছাত্রের ভর্তি নিয়ে উঠে-আসা সমস্যা তিনি দূর করেছিলেন। মুসলিম যুবক আকুল সরকার ও হিন্দু কন্যা লতার ভালোবাসার বিবাহ নিয়ে ঘনিয়ে-ওঠা সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি মোকাবিলা করেছিলেন দৃঢ় ভাবেই। এমন উদাহরণ অনেক।
রবীন্দ্রনাথই বাঙালির মজ্জায় গ্রথিত করেছেন উদারতার বোধ। যে কোনও বিষয়ে তাঁর উদ্ধৃতি ব্যবহার বাঙালি আবেগ-এর কারণে নয়, তা অনিবার্য। ভারত বলতে যাঁরা শুধু বোঝেন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান, বাঙালির আদর্শের সর্বাঙ্গে সাম্প্রতিক এই আঘাতগুলি দেখেও যাঁরা আশ্রয় খোঁজেন মিথ্যে প্রতিশ্রুতির কাছে, তখন জয়সিংহের মতো তাঁদের উদ্দেশে বলে উঠতে হবেই, ‘মিথ্যারে রাখিয়া দিই মন্দিরের মাঝে বহু যত্নে, তবু সে থেকেও থাকে না। সত্যেরে তাড়ায়ে দিই মন্দির বাহিরে অনাদরে, তবুও সে ফিরে ফিরে আসে।’
না, এই বাংলা এখনও ধর্মতন্ত্রের মুদ্রাদোষে আক্রান্ত হয়নি। ভয়ঙ্কর আবহে আপামর বাঙালি বারবার ফিরে যান সেই রবীন্দ্রনাথের কাছেই। এই লোকসভা ভোটেও।