হস্তশিল্পীরা তাদের কাজের সাফল্যের জন্য সুনাম পেতে পারেন। সঙ্গীতাদি চারুকলার ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মান লাভের যোগ। ... বিশদ
এই অবস্থাতেই, হল পাঁচ রাজ্যে বিধানসভার ভোট। বৈতরণী পেরনোর জন্য বিজেপি এবার নতুন প্ল্যান নেয়। কোনও রাজ্যেই আলাদাভাবে কোনও স্থানীয় ‘মুখ’ সামনে আনেনি তারা। সর্বত্রই ভোট চাওয়া হয়েছে মোদির নামে। কোনও সন্দেহ নেই, মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে যে ঘরোয়া কোন্দল রয়েছে, সেটা ধামাচাপা দিতেই এই কৌশল। অন্যদিকে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ‘গণতন্ত্রী’ কংগ্রেস বলল, তারা মনে করে বিধানসভা নির্বাচনে হাইকমান্ড নয় স্থানীয় নেতৃত্বেরই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। দুটি লাইনেরই ভালোমন্দ দুটি দিক এবং ঝুঁকি আছে। ৩ ও ৪ ডিসেম্বর রেজাল্ট বেরনোর পর পরিষ্কার হয় যে, এই জুয়ায় বিজেপি’ই জিতেছে।
কিন্তু শুধু এই কৌশলেই হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপি জেতেনি এবং বিশেষ শক্তিবৃদ্ধি করেনি দক্ষিণী রাজ্য তেলেঙ্গানায়। বাকিটা ছিল মানুষের মন জয়ের নানা দিক। বিজেপির হিন্দুত্বের তাস অত্যন্ত পুরনো। বহু ব্যবহারে অস্ত্রটির ধার আর কতটা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে গেরুয়া শিবিরের অন্দরেই সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। অতএব মোদিরা এবার গরিব ও মধ্যবিত্তের মন জয়ের জন্যও বিপুল পসরা সাজিয়েছিলেন। কৃষকদের সঙ্কট, নারীর ক্ষমতায়ন, রান্নার গ্যাসের দাম, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্য আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলিতে দিল্লির বিরুদ্ধে যে অভিযোগের তর্জনী উঁচু হয়ে রয়েছে, তা খর্ব করতে কিছু ‘মানবিক’ ঘোষণা রয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ফ্রি রেশনের মেয়াদ বৃদ্ধি, ভর্তুকি বৃদ্ধি রান্নার গ্যাসে, সারে ভর্তুকি প্রদান, এমএসপি’তে কৃষকের ধানক্রয়, বিনামূল্যে শস্যবিমা প্রভৃতি। বিপুল অর্থের পিএম জনজাতি আদিবাসী ন্যায় মহা অভিযান নামের একটি প্রকল্পও ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতা পুনর্দখল করেছে ‘লাডলি বহেনা’য় ভর করে। সারা দেশ জানে, এটা বাংলার অতিজনপ্রিয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সোজাসাপটা টুকলি। বাকিগুলিও কমবেশি বিভিন্ন বিরোধী রাজ্যের ‘হল কালেকশন’। পাঁচ রাজ্যেই কংগ্রেস গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য নানাবিধ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বস্তুত কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের সঙ্গে ‘রেউড়ি’ বিতরণের প্রতিযোগিতার উপরেই বেশি ভরসা রেখেছিল মোদির পার্টি।
কিন্তু মোদির রেউড়িকে ভোটদাতারা কি বেশি মিষ্টি মানলেন? হিন্দি বলয়ের রেজাল্টের পর রাজনৈতিক মহলকে প্রশ্নটি ভাবাচ্ছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস-সহ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি কি তাদের চেনা জনমুখী লাইনে কিঞ্চিৎ হলেও আস্থা হারিয়েছে? তা না-হলে এবার কেন তারা হিন্দুত্বের লাইনে মোদির সঙ্গেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হল? খেয়াল করার মতো ব্যাপার এই যে, গত মার্চে কর্ণাটকে মোদিকেই সামনে রেখে হিন্দুত্বের যাবতীয় অস্ত্র প্রয়োগ করেছিল বিজেপি। তবু সেখানে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি তারা। এটা দেখার পরও নরম হিন্দুত্বের লাইন থেকে বহুগুণ বেড়েই খেলল এবার কংগ্রেস। রাহুল গান্ধী এবং অন্য কিছু নামী কংগ্রেস নেতার মন্দিরে মন্দিরে পুজোপাঠের ছবি ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছে। দারিদ্র্য-পীড়িত ছত্তিশগড়ের ভূপেশ বাঘেল সরকার ‘রাম বনগমন পথ’ প্রকল্প গড়তে বিপুল টাকা খরচ করেছে। নয়টি স্থানে বড় মন্দির নির্মাণসহ রামচন্দ্রের মূর্তি বসানো হচ্ছে। কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এই কৃতিত্বকে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণেরও ঊর্ধ্বে রেখেছেন! জনসভায় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন বাঘেল, ‘বিজেপি কি কংগ্রেসের চেয়ে বড় হিন্দু?’ পুষ্করের জগৎপিতা ব্রহ্মা মন্দিরের রূপ বদলে ব্যস্ত হয়েছিল রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার। মরুরাজ্যের মন্দিরটি মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট গড়ে তুলছিলেন অযোধ্যার রাম মন্দিরের আদলে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথও মন্দির-রাজনীতিতে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংকে দশ গোল দিতে সক্রিয় ছিলেন। গেরুয়া শিবিরের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে মন্দির রাজনীতির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর-ও। সরকারি কোষাগার উজাড় করে একাধিক হিন্দুমন্দির নির্মাণ ও সংস্কারে জোর দেন তিনি। চার রাজ্যের রেজাল্ট এটাই কি বুঝিয়ে দিল না, ‘কণ্ঠীদের’ গান মানুষ তেমন পাত্তা দেয় না?
রবিবারের রেজাল্ট ছিল বিজেপির পক্ষে ৩/৪ বা কংগ্রেসের পক্ষে১/৪। সোমবার মিজোরামে জেডপিএম জয়ী হওয়ার পরও উপর্যুক্ত দল দুটির জন্য রেজাল্ট অবিকৃত মনে হতে পারে, বাস্তবে কিন্তু তা নয়। কারণ ২০১৮ সালের রেজাল্টের পাশে উত্তর-পূর্বের এই ক্ষুদ্র রাজ্যেও কংগ্রেস অনেক পিছনে চলে গিয়েছে। গতবার পাঁচটি আসন পেয়ে কংগ্রেস তৃতীয় স্থানে ছিল, এবার সেই জায়গাটিও রইল না, একটি আসনের মালিক কংগ্রেস এবার ৪ নম্বরে নেমে গিয়েছে। এমনকী নাগাল্যান্ডে একটি আসনের উপনির্বাচনেও গোহারা রাহুল গান্ধীর দল। অন্যদিকে, তেলেঙ্গানায় ক্ষমতায় না গিয়েও বিজেপি এগিয়েছে অনেকটাই—আসন ১ থেকে ৮ হয়েছে।
রাজ্য দখলের ক্ষেত্রে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে গেল বিজেপি। এই ভোটের আগে বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় ছিল দশটি (হরিয়ানা, ইউপি, উত্তরাখণ্ড, এমপি, গোয়া, গুজরাত, ত্রিপুরা, অসম, মণিপুর ও অরুণাচল) রাজ্যে। রবিবার রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে জয়ের পর বিজেপি এক ডজন রাজ্যের ‘মালিক’ হয়ে উঠেছে। এনডিএ হিসেবে আরও পাঁচটি (মহারাষ্ট্র, পুদুচেরি, মেঘালয়, সিকিম ও মিজোরাম) রাজ্যে ক্ষমতা ভোগ করে দলটি। কোনও সন্দেহ নেই দল এবং এনডিএ-র ফাটল মেরামতে মোদির এই সাফল্য অনেকখানি সহায়ক হবে। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে পার্লামেন্টের ভিতরে বাইরে গেরুয়া শিবিরের নয়া আস্ফালন! সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়ায় যে, লোকসভা নির্বাচনের আগের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক লড়াই শেষে কংগ্রেসের মুখ সোমবার আরও বেশি ম্লান হয়েছে। তাহলে ব্রাত্য ‘মোদি ম্যাজিক’ তত্ত্বই ফের মাথা তুলছে না কি?
কংগ্রেসের এই পাহাড়প্রমাণ ব্যর্থতার জন্য রাহুল গান্ধীদের চেনা ‘দাদাগিরি’র মানসিকতাই যে বহুলাংশে দায়ী, তাতে সংশয় নেই। উদাহরণ—মধ্যপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের সপা, গন্ডোয়ানা গণতন্ত্র পার্টি, রাজস্থানে ভারতীয় আদিবাসী পার্টি, জনতা কংগ্রেস ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানায় সিপিএম প্রভৃতি সামান্য কিছু আসন চেয়েও কংগ্রেসের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। হিন্দি বলয়ে আপ, সিপিআই, জেডি(ইউ) প্রভৃতিও এবার কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একা লড়েছিল। এইসব ছোটখাট আহত শক্তি জায়গা ও ক্ষমতা অনুযায়ী কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দিতে দেরিও করেনি।
‘ইন্ডিয়া’ জোটের পরবর্তী বৈঠকের আগেই, সংশ্লিষ্ট অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ‘সামন্ত প্রভু’ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি যা, তাতে ‘ম্যাজিশিয়ান’ মোদির মোকাবিলায় একজন সমকক্ষ ম্যাজিশিয়ানকেই সামনে রাখা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এমন গুরুদায়িত্বে তাঁকেই মানায় যাঁকে সারা দেশ চেনে, যিনি বিজেপির মোকাবিলা করে জিততে অভ্যস্ত ও সিদ্ধহস্ত এবং যিনি সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। সোনিয়া গান্ধীর পুত্র ও কন্যার নাম এখন আর কোনও যুক্তিতেই বিবেচনায় আসে না। কারণ রাজনৈতিক-প্রশাসনিক পরীক্ষায় তাঁরা বারবার ফেল করেছেন—এবার তো বটেই। সার্বিকভাবে ‘ইন্ডিয়া’র উজ্জ্বল মুখ হয়ে ওঠার জন্য বাংলার জননেত্রী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে যোগ্যতর কেউ নেই। প্রতিটি ভোট বৈতরণী পেরতে যে ‘গোবৎস’ ভরসা, তার নানারূপ একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই আবিষ্কার। প্রকৃত উন্নয়নের সংজ্ঞা ও পন্থা গত এক দশকে বদলে দিয়েছেন তিনি। মমতার উন্নয়নচিন্তারই অনবদ্য কিছু ফসল হল—লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, ও রূপশ্রী, ট্যাব ও সবুজসাথী, খাদ্যশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু প্রভৃতি। জয়ের ভোট পেতে মোদির পার্টিই এবার স্বনামে-বেনামে সবচেয়ে বেশি এই ‘রেউড়ি’ খাইয়েছে মানুষকে। সোজা কথায়, মমতার খাতা সামনে রেখেই গণটোকাটুকি হয়েছে এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে।
অতএব ‘ইন্ডিয়া’র ঘরে উন্নয়নের এমন পরীক্ষিত ও সুসফল মুখ থাকতে তারা কেন আদাড়ে-বাদাড়ে হাতড়াতে যাবে? জানুয়ারিতে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন করে ভোটের দামামা সরকারিভাবে বাজানো হবে ঠিকই, কিন্তু ‘রেউড়ি লাইন’ ছেড়ে বেরনোর হিম্মত মোদিবাবুদেরও আর হবে না। সেখানে মমতার প্রকৃত উন্নয়নের নীতি ফেলে হিন্দুত্বের নিন্দনীয় লাইনই-বা টুকতে যাবে কোন দুর্বুদ্ধিতে—তাঁকে সামনে রেখে প্রকৃত জনকল্যাণের নীতিতেই অধিক আস্থা রাখা দরকার ইন্ডিয়ার—গরিব এবং মধ্যবিত্তরাই যে এখনও এই গণতন্ত্রের মূল শক্তি। গরিবের উন্নয়নের নীতি ম্যাজিকের মতোই অত্যন্ত কার্যকরী উপলব্ধি করেই না, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মমতার সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা আটকে দিতে আজও মরিয়া মোদি সরকার? টুকে ফার্স্ট হওয়াই যায়, তবে তার মুখে আস্ফালন বড়ই বেমানান।