১৯১৮ খৃঃ ২৪শে ডিসেম্বর ছিল শ্রীশ্রীমায়ের জন্মতিথি। তিনি তখন উদ্বোধনেই ছিলেন। জ্ঞান মহারাজ সেদিন আশ্রমের বালকদের নিয়ে এলেন মায়ের জন্মতিথির পবিত্র দিনে মাকে দর্শন ও প্রণাম করার জন্য। পথে আসতে আসতে উদ্দীপ্ত হয়ে, মা যে সাক্ষাৎ জগন্মাতা সে সম্বন্ধে অনেক কথা সকলকে বলতে বলতে এলেন। তখন সমস্ত দিনের উৎসব সবে শেষ হয়েছে। মায়ের সেবক রাসবিহারী মহারাজ দোতলায় মায়ের ঘরের বারান্দা থেকে বললেন, ‘সমস্ত দিন ভক্তদের দর্শন দিয়ে মা এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। জ্ঞান মহারাজ একা মাকে প্রণাম করে যেতে পারেন।’ কিন্তু জ্ঞান মহারাজ উত্তরে জানালেন, তাঁর সঙ্ঘের বালকদের যদি মাকে দর্শন ও প্রণামের সুযোগ না হয়, তাহলে তিনিও সকলের সাথে মাকে নিচের থেকেই প্রণাম করা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সকলের খুবই মন খারাপ হল। কয়েকজন কেঁদে ফেলে নিজেদের হতভাগ্য ভাবতে ভাবতে আকুল হয়ে দর্শন ও প্রণামের জন্য মনে মনে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন। শুদ্ধসত্ত্ব, সরল, পবিত্র বালকদের আকুল প্রার্থনায় অন্তর্যামিনী জগৎ জননী স্থির থাকতে পারলেন না। রাসবিহারী মহারাজকে ডেকে বললেন, ‘যারা এসেছে সকলকে উপরে এসে প্রণাম করে যেতে বল।’ কৃপাময়ী মায়ের আদেশে সজল চোখে সকলে উপরে গিয়ে এক এক করে মাকে দর্শন ও প্রণাম করলেন। মা তখন তাঁর ঘরের দরজার সামনে স্বভাবসুলভ ভাবে আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে একটি চেয়ারে বসেছিলেন শুধু শ্রীচরণ দুটি বের করে রেখে। সুতরাং মায়ের মুখ দেখার সুযোগ কারো হয়নি। নিচে এসে পূর্ণ আনন্দে মায়ের পাঠানো প্রসাদ সকলে গ্রহণ করেন। ঐ একবারই মাকে স্থূল শরীরে দর্শন ও প্রণাম করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় দর্শন হয়েছিল মায়ের মহাসমাধির পরে। স্বামী সারদানন্দের নেতৃত্বে সকলের সঙ্গে মায়ের ভগবতী তনু নিয়ে তিনিও মঠে গিয়েছিলেন এবং শেষকৃত্য সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সমাধি প্রাঙ্গনে ছিলেন। মায়ের নশ্বর দেহ দাহ করার পূর্বে স্বামী শিবানন্দজী সমবেত সাধু ব্রহ্মচারীদের বললেন, ‘পূর্বে সতীর পুণ্যদেহের অংশ বিভিন্ন স্থানে পড়ে একান্নটি মহাশক্তিপীঠ হয়েছে। এখানে সেই সতীরই পুণ্যদেহাবশেষ সবটুকু একসঙ্গে থাকছে। আর একান্নপীঠ ঘুরে তপস্যা করতে হবে না। এখানে তপস্যা করলে তার চেয়ে বেশিই হবে।’
এই সময় মামার বাড়ীর সঙ্গে বিজয়চন্দ্রের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। একদিন মুষ্টি ভিক্ষার সময় পরিচিত একজন খবর দিলেন, তাঁর মা চারুবালা দেবী খুব অসুস্থ হয়ে গ্রাম থেকে মামার বাড়ী এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মামার বাড়ী গিয়ে দেখেন মা খুবই অসুস্থ। তিনি প্রাণপণে মায়ের সেবা করতে লাগলেন। কিন্তু মাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ করে একদিন তাঁরই কোলে মাথা রেখে সজ্ঞানে জপরত অবস্থায় মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। বাবা পূর্ণচন্দ্র তিন বছর আগেই পরলোক গমন করেছিলেন। ফলে বিজয়চন্দ্রের সংসারের প্রতি আর কোন আকর্ষণ বা বন্ধন রইল না। এনট্রান্স পরীক্ষা না দিয়েই তিনি তপস্যা করতে হরিদ্বার চলে যান। বন্ধু ফণী ট্রেনের টিকিট করে দিয়েছিলেন। ওর বাবা পূর্ত বিভাগের কন্ট্রাক্টর ছিলেন। উনি বাবাকে সেই কাজে সাহায্য করতেন। তাই হাতে টাকা পয়সা থাকত। যাইহোক তিনি হরিদ্বারে নেমে কনখল সেবাশ্রমে উঠলেন। সেখানে স্বামীজীর দুই শিষ্য স্বামী কল্যাণানন্দজী ও স্বামী নিশ্চয়ানন্দজীর পূত সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁরা তাঁর বৈরাগ্য দেখে এবং তপস্যার জন্য ব্যাকুলতা দেখে খুশি হন।
‘প্রণামিকা’ পূজ্যপাদ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজের স্মরণে