কর্ম সম্বন্ধে সাধারণ লোকের স্পষ্ট ধারণা না থাকিলেও ইহা অধিকাংশ লোকেই বিশ্বাস করে যে এই সংসার প্রপঞ্চের এবং ব্যাপক দুঃখ জঞ্জালের মূল একমাত্র কর্ম। এই বিশ্বাস যে অমূলক তাহা নহে। তবে ইহা স্পষ্টরূপে বোধগম্য হওয়া উচিত। যে কর্মের প্রভাবে সংসারে সুখ দুঃখ উত্পন্ন হয় তাহা অজ্ঞানমূলক কর্ম। অজ্ঞান অথবা অবিদ্যাই সংসারের মূল। অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ-দ্বেষ ও অভিনিবেশ—এই পাঁচটি ক্লেশের মধ্যে অবিদ্যাই মূল ক্লেশ। অবিদ্যা হইতে অস্মিতা অথবা অহংভাবের উদয় হয়। এই উদয়ের ফলে অবস্থা অনুসারে চিত্তে রাগ-দ্বেষ জন্মে এবং তাহার পর অভিনিবেশ বা মৃত্যুভয় উত্পন্ন হয়। অবিদ্যা প্রভৃতি পাঁচটি ক্লেশ সাংসারিক জীবনের মূলস্তম্ভস্বরূপ। অবিদ্যা বলিতে এখানে অবিবেক বুঝিতে হইবে। যে বস্তু যাহা নয় তাহাকে তাহাই মনে করা অবিদ্যা এবং মিথ্যাজ্ঞান হইতেই অস্মিতা বা অহংভাবের উদয় হয়। সত্তা ও চৈতন্য এই উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তাহা বোধে না নিয়া উভয়কে একরূপ মনে করা ইহাই অস্মিতা এবং ইহারই নামান্তর ‘অহম্ভাব’। এই অহম্ভাব হইতে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ অর্থাত্ রাগ-দ্বেষ উভয়ই উত্পন্ন হয়। স্থূল দেহের পরিত্যাগের আশঙ্কাকে অভিনিবেশ বলে। এই অবিদ্যাদি পঞ্চক্লেশ ইহা হইতে উদ্ভূত কর্ম। কর্ম হইতে বিপাক উত্পন্ন হয়। বিপাক বলিতে জন্ম, আয়ু ও ভোগ এই তিনটি বুঝিতে হইবে এবং চরমে কর্মাশয় নামক সংস্কার উত্পন্ন হয়। কর্মাশয় অনুসারে সুখ-দুঃখ নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্লেশ, কর্ম, বিপাক এবং কর্মাশয় সংসারী আত্মা মাত্রেই থাকে কিন্তু ঈশ্বরের এসব নাই। ক্লেশ হইতে অর্থাত্ অবিদ্যাদি ক্লেশের প্রভাবে যে কর্ম উদ্ভূত হয় তাহাই ক্লিষ্ট কর্ম। অবিদ্যার মূল স্বরূপ অবিবেক অর্থাত্ পুরুষ ও প্রকৃতির পার্থক্য বুঝিতে না পারা। যোগমার্গে প্রবিষ্ট পুরুষ বিবেক-খ্যাতির আভাস করেন। পুরুষ ও প্রকৃতির অভেদ জ্ঞানকে আশ্রয় করিয়া যে কর্ম হয় তাহাই ক্লিষ্ট কর্ম।
বিবেকখ্যাতিকে পৃষ্ঠভূমিতে রাখিয়া যে কর্ম উত্পন্ন হয় তাহার নাম অক্লিষ্ট কর্ম। অবিবেকমূলক কর্ম নানা প্রকার হইতে পারে। শ্রেণীবিভাগ করিবার সময় এইগুলি শুল্ক, কৃষ্ণ ও মিশ্র এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়। এইগুলি সবই সাংসারিক কর্ম। এইসব কর্মের ফলে সংসারবন্ধন ক্রমশঃ দৃঢ় হয়। কিন্তু বিবেকখ্যাতিমূলক কর্ম হইতে সংসারবন্ধন ক্রমশঃ শিথিল হইয়া যায়। যোগিগণ, শুল্ক, কৃষ্ণ ও মিশ্র নামে প্রধানতঃ তিন প্রকারে কর্ম বিভাগ করিয়া থাকেন। তাহার পর বিবেকখ্যাতি হইয়া গেলে ঐ জাতীয় কর্মের অবসান ঘটে। তখনকার কর্মের নাম অশুক্ল-অকৃষ্ণ। ঐ সকল কর্মে সংসারবন্ধন তো হয়ই না বরং পূর্বাস্থিত বন্ধন কাটিয়া যায়। যোগীর কর্ম অশুক্ল-অকৃষ্ণ, তাই ঐ কর্মের প্রভাবে সংসারোত্পাদক মিশ্র কর্ম, শুক্লকর্ম এবং কৃষ্ণকর্ম এবং অশুক্ল-অকৃষ্ণ কর্ম পরস্পরবিরোধী। শুক্ল ও কৃষ্ণ কর্মে যেমন মিশ্রণ হয় না তেমনি অশুক্ল-অকৃষ্ণ কর্মের সহিত শুক্ল কর্মেরও মিশ্রণ হয় না। শুক্লের সঙ্গে কৃষ্ণ থাকিলেও সান্নিধ্য বশতঃ শুক্ল কৃষ্ণ হয় না। ঠিক এই প্রকার অশুক্ল-অকৃষ্ণ সঙ্গে শুক্ল ও কৃষ্ণ কর্মের মিশ্রণ হয় না। ইহাই কর্ম-বিজ্ঞানের রহস্য। ইহা সংরক্ষিত না থাকিলে অনাদি সংসারের মধ্যে এক অবস্থা হইতে অন্য অবস্থায় পরিণতি হইতে পারিত না। ক্লিষ্ট কর্ম সংসারজনক কিন্তু অক্লিষ্ট কর্ম সংসারনাশক।
ডক্টর গোপীনাথ কবিরাজের ‘সাধনা ও সিদ্ধি’ থেকে