দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর ঘটনাবলীর দিকে এক নজরে তাকালে প্রত্যেক দেশেই যে-লক্ষণটি সহজে আমাদের চোখে পড়ে তা হল যৌবনের পুনরুজ্জীবন। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূব থেকে পশ্চিমে, যে-দিকেই তাকাই না কেন, যুব আন্দোলন বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। যুব আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলি কী, একদিকে কোন শক্তিসমূহ তাকে পরিচালিত করছে এবং অপর দিকে কী তার চূড়ান্ত লক্ষ্য এই সমস্ত বিষয়ে আমাদের মনে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। যুবক ও যুবতীদের যে-কোনও সংগঠনই যুব সংগঠন নামে আখ্যাত হওয়ার যোগ্য নয়। এক সমাজসেবী সঙ্ঘ অথবা এক দুর্ভিক্ষত্রাণ সমিতি অনিবার্যরূপে যুবসংগঠন নয়। যুব-সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হল বর্তমান ব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষের অনুভূতি এবং উন্নততর ব্যবস্থার জন্য আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সেই ব্যবস্থার রূপ কল্পনা করা। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে যুব আন্দোলন সংস্কারধর্মী নয়, বিপ্লবী। কোনও যুব আন্দোলন শুরু হবার আগে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থা-সম্পর্কে এক অস্থির, এক অসহিষ্ণু অনুভূতি জন্ম নেবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এমন আন্দোলনকে একটি বিংশ শতাব্দীর লক্ষণ অথবা একটি আপতিক লক্ষণ বলে বিবেচনা করি না। সক্রেটিস এবং বুদ্ধের সময় থেকে মানুষ এক মহত্তর পৃথিবীর স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং সেই অনুপ্রেরণার বশে সমাজ-পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। আধুনিক যুগের যুব-আন্দোলন-সমূহও অনুরূপ স্বপ্ন এবং প্রচেষ্টার লক্ষণাক্রান্ত। রাশিয়ার বলশেভিকবাদ, ইতালিতে ফ্যাসিবাদ, তুরস্কে তরুণ-তুর্কী আন্দোলন কিংবা চীন, পারস্য অথবা জার্মানি যেখানেই কোনও আন্দোলন হোক না কেন সর্বত্রই একই আবেগ, একই স্বপ্ন এবং একই লক্ষ্য দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানেই আগের প্রজন্মের নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেই যুবকরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন এবং সমাজ পুনর্গঠনের এবং সমাজকে উৎকৃষ্টতর এবং মহত্তর অস্তিত্বের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
বন্ধুগণ, চলুন এখন আমরা ঘরের আরও কাছে আসি। শুধু জার্মানি, রাশিয়া এবং চীনের তরুণরাই জেগে ওঠেনি, এই কল্পনাবিলাসী অলসদের দেশেও জাগরণ এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই জাগরণ এসেছে অন্তর থেকে এবং এই জাগরণ শুধু বাইরের বুদ্বুদ নয়। ভারতের তরুণরা আর সব দায়িত্ব বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, করজোড়ে বসে থেকে অথবা তাড়িত মূক গবাদি পশুর মতো অনুসরণ করে সন্তুষ্ট নয়। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁদেরই এক নতুন ভারত সৃষ্টি করতে হবে—এক স্বাধীন, মহান এবং শক্তিশালী ভারত। তাঁরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, পরিণামের জন্য তাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করেছেন এবং যে-মহান্ কার্যভার তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে তার জন্য এখন তাঁরা নিজেদের প্রশিক্ষিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন। এই সঙ্কটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ভারতের শুভার্থীদের কর্তব্য হল বর্তমানে যে-সব আন্দোলন চলছে সে-সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবেন তা নির্ভীকভাবে ঘোষণা করা। এর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে, ত্রুটিগুলিকে নির্মমভাবে অনাবৃত করতে হবে এবং সমগ্র আন্দোলনটি ফলপ্রসূ খাতে পরিচালিত করতে হবে।
সুভাষচন্দ্র বসুর সমগ্র রচনাবলী (৪র্থ খণ্ড) থেকে