প্রেম-প্রণয়ে কিছু নতুনত্ব থাকবে যা বিশেষভাবে মনকে নাড়া দেবে। কোনও কিছু অতিরিক্ত আশা না করাই ... বিশদ
‘‘নাই কিরে সুখ, নাই কিরে সুখ
এ ধরা কি শুধু বিষদাময়?
যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
শুধুই কি নর জনম লয়?’’
এই হাহাকার, এই আর্ত্তনাদ শুধু আজিকার নয়, ইহা নিত্যকার চিরন্তন। যুগযুগান্তর, জন্মজন্মান্তর ধরিয়া মানুষ প্রতিনিয়ত অসহ্য জ্বালায় জ্বলিয়া পুড়িয়া সুখের সন্ধানে কত বিনিদ্র রজনী, কত বিরামহীন দিবস কাটাইয়াছে। নিরবচ্ছিন্ন শান্তির চেষ্টায় নিদাঘ-মধ্যাহ্নের কত প্রচণ্ড তাপ, শীত-নিশীথের কত দুরন্ত হিমানী, ঘন বর্ষার কত প্রবল বারিধারা সে মস্তকে ধারণ করিয়াছে; কত উত্তুঙ্গ শৈলশৃঙ্গ উলঙ্ঘন করিয়াছে, কত দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দিয়াছে, কত ঊষর মরুপ্রান্তর অতিক্রম করিয়া সে প্রতিনিয়ত সুখের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে; কিন্তু কৈ, তবুও তাহা মিলল কোথায়? বিপুল বৈভব, অটুট স্বাস্থ্য, অগাধ বিদ্যা বুদ্ধি পাণ্ডিত্য, কত ধনজনপরিবার, মানযশ-প্রতিপত্তি লাভ হইল, কিন্তু তথাপি প্রকৃত শান্তি, সত্যিকার আনন্দ লাভ হইল কোথায়? দুই দিন যাইতে না যাইতে প্রাপ্ত বিষয়ের মনোরমত্ব ঘুচিয়া যায়, মহাকালের নির্ম্মম আঘাত মানুষের বড় সাধের আশা-আকাঙ্ক্ষা মুহূর্ত্তে ভাঙ্গিয়া চুরমার হয়, মানুষ যাহা কিছুকে আনন্দের উপাদানরূপে আঁকড়াইয়া ধরে, ঘটনাচক্রের আবর্ত্তনে তাহাই নিঃশেষে ধ্বংস হইয়া যায়, আর প্রতিক্রিয়ার অশান্তির আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠে। দেহবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ স্থূল ইন্দ্রিয়গ্রাম সহায়ে যতই সুখের আশায় বিষয়ের পানে আগাইয়া যায়, ততই সুখ আলেয়ার আলোর মত দৃষ্টিবিভ্রম ঘটাইয়া মরুমরীচিকার মত কুহকজাল সৃষ্টি করিয়া কেবলই দূরে সরিয়া যায়; লাভ হয় শুধু শ্রান্তি, ক্লান্তি, বিষাদ, অবসাদ, দুঃখ, দৈন্য, অশান্তি, হাহাকার।
হা মানব! ভ্রান্ত তুমি। শান্তির আশায় বৃথাই তুমি বাহিরে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তি, সত্যিকার আনন্দ বাহিরে নয় ভিতরে, তোমার অন্তরে-তোমার নিজের কাছে। কস্তুরীগন্ধে আত্মহারা হরিণ যেমন কোথা হইতে গন্ধ আসিতেছে বুঝিতে না পারিয়া দিগ্বিদিগ্ জ্ঞানশূন্য হইয়া চারিদিকে ছুটাছুটি করে, তুমিও তেমনি স্বীয় অন্তরস্থিত আনন্দ-উৎসের সন্ধান না জানিয়া শান্তির আশায় দিশাহারা হইয়া সমস্ত জগৎ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। একবার বহির্মুখী মনকে জগতিক বিষয় হইতে ফিরিয়া অন্তর্মুখী কর, হৃদয়ের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে প্রবেশ কর, দেখিবে—চিরশান্তির অক্ষয় উৎস সেখানে লুক্কায়িত রহিয়াছে।
আত্মন্! সুন্দর আকাশের গাঢ় নীলিমা যেমন মিথ্যা ও ভ্রান্তি, তেমনি বিষয়ে যে সুখ বা আনন্দ বোধ হয়, তাহাও মিথ্যা, ভ্রান্তি। সূর্য্যের কিরণ চন্দ্রের উপর বিচ্ছুরিত হওয়ার যেমন চন্দ্রকে আলোকসম্পন্ন বলিয়া মনে হয়, বস্তুতঃ চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলোক নাই, তেমনি আনন্দস্বরূপ আত্মার আনন্দধারা বিষয়ের উপর বিচ্ছুরিত হওয়ারই বিষয়কে আনন্দময় বলিয়া মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে বিষয়ের কোন আনন্দসত্তা নাই। বিষয়ে যদি প্রকৃতই সুখ থাকিত, তবে আজ যাহার প্রাপ্তিতে তুমি সুখ পাইতেছ বলিয়া মনে করিতেছ, কালই তাহাতে অসুখী হইতেছ কেন?