আসন্ন উৎসবের রাজ্যে এর চেয়ে আর ভালো খবর হতেই পারে না। হাড়হিম করা অতীত অভিজ্ঞতা আর গায়ে কাঁটা দেওয়া আশঙ্কার মধ্যেই খবরটা শুনিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা আইসিএমআর। কী সেই সন্দেশ? ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের আশ্বাস, করোনার তৃতীয় ঢেউ আসছে না। এই একটা আশ্বাসই যেন আশ্বিনের রোদ ঝলমলে আকাশে খুশির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরুর গোড়া থেকে গত দেড় বছরে এর চেয়ে ভালো আশ্বাস বুঝি আর হয়নি। তবে একইসঙ্গে সংক্রমণের সম্ভাবনাও একেবারে দূর হয়ে যায়নি। সেই আশঙ্কা যতটা না ভাইরাস থেকে, তার চেয়ে বেশি করোনাবিধি না মেনে চলার খেসারত হিসেবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনায় থেকে যায়। বিশেষজ্ঞরা তাই আশ্বাসের পাশাপাশি সতর্ক করেও দিয়েছেন। করোনার উৎসস্থল নিয়ে যত বিতর্কই থাক, গোটা বিশ্বে গত দু’বছরে কোভিড-১৯ সবচেয়ে আলোচিত ও সাড়া ফেলে দেওয়া ঘটনা সন্দেহ নেই। বিশ্বের তাবড় প্রশাসনকে নাগাড়ে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে এই মারণ ভাইরাস। গোটা দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা অগুনতি। শেষ পর্যন্ত কবে কোন পথে এর থেকে মুক্তি মিলবে—সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা। কারণ কোভিডের সংক্রমণ থেকে মূলত মৃত্যুর সম্ভাবনা ঠেকাতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ একাধিক সংস্থার ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। কিন্তু কোভিড একেবারেই হবে না—এখনও এমন কোনও মহৌষধি আবিষ্কৃত হয়নি, যা খেলে বা ইনজেকশন নিলে করোনা পালাবে চিরতরে। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচাতে ভ্যাকসিন নিয়ে কোভিড বিধি মেনে চলাই এক ও একমাত্র ভরসার জায়গা। বিশেষজ্ঞরা তাই মাস্ক-স্যানিটাইজার, দূরত্ববিধি মেনে চলার জীবনকেই বেছে নেওয়ার নিদান দিয়েছেন।
কোনও ব্যবস্থাই যে করোনার জন্য যথেষ্ট নয়, আগের দুটি ঢেউয়ের আঘাতই তার প্রমাণ। এদেশের গত বছরের মার্চ থেকে ছড়াতে শুরু করলেও সেপ্টেম্বরে শিখর ছুঁয়েছিল করোনা। দ্বিতীয় ঢেউ এসে প্রথম ঢেউয়ের আক্রান্তের রেকর্ডকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। এখন করোনা আক্রান্তের হার নেমে এলেও আশঙ্কা কিছু পুরোপুরি যাচ্ছে না। কারণ দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝাপটার জেরে মহারাষ্ট্র, কেরল, মণিপুরের মতো কয়েকটি রাজ্যে নতুন করে সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশের প্রায় সব রাজ্যেই পরিস্থিতি অনুযায়ী বিধিনিষেধ মেনে চলতে হচ্ছে নাগরিকদের। এদেশের বেশিরভাগ রাজ্যে এখনও চালু হয়নি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় দু’বছর ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন অবতার হিসেবে দেখা দিয়েছে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা। যার জেরে গৃহবন্দি বহু পড়ুয়ারই শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। এরকম এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও আশার বাণী শুনিয়েছে কেন্দ্র, যা নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। করোনা তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় যখন মানুষ উদ্বেগে রয়েছেন তখন সংক্রমণের হার, টিকাকরণে দ্রুততা এবং ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আইসিএমআর আশ্বাস দিয়েছে যে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আগামী দিনে কোনও কোনও রাজ্যে বিক্ষিপ্তভাবে সংক্রমণের আঁচ অনুভব হতে পারে। তবে তা দেশজুড়ে আঘাত হানতে পারবে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতার সময়ে অনেকেই বলেছিলেন, তৃতীয় ঢেউ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে শিশুদের উপর। সেই আশঙ্কায় ঘুম ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে এ ব্যাপারে অযথা আতঙ্ক না ছড়িয়ে শুধুমাত্র সতর্ক থাকারই নিদান দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বলা হচ্ছে, তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুরাই যে বেশি আক্রান্ত হবে এমন ভাবার কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তবু সাবধানের মার নেই। তাই শিশু চিকিৎসায় ফাঁক না রেখে বাড়তি কিছু ব্যবস্থাও সরকারি তরফে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন একটা সময় দেশে দৈনিক সংক্রমণ ৪ লক্ষ ছাড়িয়েছিল। এখন তা ৩০ হাজারের আশপাশে। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের আশ্বাসে সব পক্ষই কিছুটা স্বস্তিতে। তবে মানুষ তখনই পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন যখন তাঁরা জানবেন করোনা বিদায় নিয়েছে। 
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে তাই উদ্বাহু-নৃত্য করার সময় এটা নয়। বিশেষত উৎসব মরশুমে। বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো আসন্ন। ইতিমধ্যেই দোকানে-বাজারে শপিংমলে ক্রেতার ভিড় বাড়ছে। অনেকেই সতর্ক নন, মাস্ক ছাড়াই ঘুরছেন! মানছেন না করোনাবিধি। অতীত থেকে তাঁরা কোনও শিক্ষাই নেননি। এই প্রবণতায় বিপদ যে বাড়বে তা অনুমেয়। ওনাম উৎসবের পর কেরলে সংক্রমণ বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত আমরা ভুলিনি। তৃতীয় ঢেউ আসছে না ভেবে লাগামছাড়া হলেই বিপদ। উৎসবের মরশুম সর্বাঙ্গসুন্দর তখনই হবে যখন সবাই সুরক্ষিত থাকবেন। তাই তৃতীয় ঢেউ আসুক বা না আসুক আগামী দিনগুলিতে করোনাবিধি মেনেই চলতে হবে। না-হলেই বিপদ। কারণ করোনা মোটেই পিছু ছাড়েনি।