কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
গ্রিক পুরাণে আছে নদীর দেবতা সেফিসাস এবং জলপরি লিরিওপের পুত্র নার্সিসাস। অপ্রাকৃত সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সকলেই তাঁর রূপের প্রশংসা করতেন। সেই প্রশংসাই তাঁর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সুন্দরীরা তাঁকে প্রেম নিবেদন করলে তাঁদের কুরূপা ভেবে তিনি অস্বীকার করতেন। নিজেকে ছাড়া সকলকে তিনি ঘৃণা করতেন। এমনকী কাউকে কাউকে ঘৃণায় হত্যাও করতেন। একদিন তিনি হঠাৎ স্বচ্ছ জলাশয়ের দিকে তাকালেন। সেখানে নিজের প্রতিবিম্বকে ভাবলেন অন্য কেউ। সেই প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে তার দিকে হাত বাড়ালেন। প্রতিবিম্বও তাঁর দিকে হাত বাড়াল। হঠাৎ জলে আঙুলের স্পর্শ লাগতেই জল কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠে হারিয়ে গেল প্রতিবিম্ব। তাকে ধরার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন নার্সিসাস। আত্মবিস্মৃত হয়ে জলে ঝাঁপ দিলেন এবং তাঁর সলিল সমাধি হল।
তাই আজও যখন কোনও মানুষ আপন সৌন্দর্যে, আত্মগরিমার মিথ্যে অহঙ্কারে উন্মাদ হয়ে যান, তাঁকে নার্সিসাসের সঙ্গেই তুলনা করা হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এই আত্মগরিমা সংক্রান্ত অহঙ্কারের একটা লক্ষণ বারবার ফুটে ওঠে। তিনি আপন সৌন্দর্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন এবং সাজতে খুব ভালোবাসেন। দামি জিনিস ছাড়া কিছুই ব্যবহার করেন না। তাঁর এই স্ব-রূপ প্রীতি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার কয়েকদিনের মধ্যেই ধরা পড়ে গিয়েছিল।
মোদি জমানায় একটা কথা চালু আছে, সেটা হল কেউ তাঁকে পছন্দ করুন আর নাই করুন, কিন্তু তাঁর ফ্যাশনদুরস্ত মানসিকতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। দুনিয়ার সেরা মূল্যবান পোশাক ও শৌখিন সামগ্রী ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে তাঁর যে মানসিকতা ফুটে ওঠে, তা নজর টানবেই। সে পাশ্চাত্য আবরণের চোস্ত আবির্ভাবেই হোক অথবা ক্লাসিক এথনিক সজ্জাতেই হোক, তাঁর সাজবদলের ধারাবাহিক ছবিগুলি দেখলে মনে হয় ফ্যাশন প্যারেডের ক্যাটওয়াক। তাঁর ওয়ার্ডরোব হয়ে উঠতে পারে এক দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শশালা। হবে নাই বা কেন, দেশ-বিদেশের সেরা ফ্যাশন ডিজাইনরা তাঁকে সাজানোর জন্য তাঁদের মেধা ও শ্রমকে ব্যবহার করেন। টাকার মূল্যে তাঁরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মোদি ছাড়াও তাঁরা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় বিলিওনারদের ফ্যাশন ডিজাইন করেন। সাজপোশাকের সঙ্গে বুলগারি ফ্রেমের চশমা, মঁ ব্লাঁ কলম এক অন্যধরনের বার্তা এনে দেয়। একসময় স্টেশনে চা বিক্রি করা বা খাকি হাফপ্যান্ট কুর্তা পড়ে সঙ্ঘের অনুশীলন করা মোদি আজ সরে গিয়েছেন অনেক দূরে। এই ফ্যাশনপ্রীতির কারণে অনেকেই তাঁকে নানাভাবে ব্যঙ্গও করেছেন। বাজপেয়ি জমানার মন্ত্রী অরুণ শৌরি একবার মোদির ফ্যাশনপ্রীতি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর জমানায় মানুষের ভিতরে যে অস্তিত্বের সঙ্কট ঘনিয়ে উঠেছে, সেই সঙ্কটের ছাপ মোদিকেও স্পর্শ করেছে। বারবার তাঁর মনে হয়, এই বুঝি তাঁর সিংহাসন চলে গেল। এই মানসিক অস্থিরতা দূর করতে তিনি মনস্তাত্ত্বিক লড়াই করেন। নিজের সঙ্কটত্রস্ত মানসিকতাকে অন্যের কাছ থেকে লুকাতে দামি দামি পোশাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করেন। শৌরিজির এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে সত্য। নিজেকে নিজের কাছ থেকে লুকাতেই তিনি বেছে নিয়েছেন নার্সিসিজমকে। কবিগুরুর কবিতার লাইনগুলি অনায়াসে মনে এসে যায়, ‘পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি / আপন গন্ধে মম,/ কস্তুরী মৃগ সম।’
শুধু পোশাকেই নয়, নিজের বক্তৃতা শুনতে শুনতে তিনি এতই মোহিত হয়ে যান যে, সেই বক্তৃতার মাঝেই হাততালি দিয়ে ওঠেন। যেন নিজেই নিজেকে বাহবা দিচ্ছেন। তিনি বলতে ভালোবাসেন, শুনতে নয়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন না প্রশ্নবাণের ঝক্কি এড়াতে। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে সাংবাদিকদের চিরকালই এক মধুর সম্পর্ক। জওহরলাল, লালবাহাদুর, ইন্দিরা, রাজীব, অটলবিহারী, মনমোহন পর্যন্ত সেই সম্পর্কের মধ্যে হৃদ্যতা দেখা গিয়েছে। কিন্তু মোদি ক্ষমতায় আসার পরই সাংবাদিকদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। নিজের সামনে গড়ে তুলেছেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। সাংবাদিক করণ থাপারের সঙ্গে সেই তিক্ত সাক্ষাৎকার পর্বের পর তিনি আর সাংবাদিকদের কাছে ঘেঁষেন না। সেই সাক্ষাৎকার পর্বে গোধরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে একরকম অস্বস্তি এড়াতেই সাক্ষাৎকার অসম্পূর্ণ রেখে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অবাক লাগে, স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উদযাপনকালে আমরা পেয়েছি এমন এক মানসিকতার দেশনেতাকে, যিনি কারও প্রশ্নের মুখোমুখি হন না। কখনও ইচ্ছে হলে তিনি মনোমতো সাংবাদিককে ডেকে নিজেরই তৈরি করা প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রতিটি বক্তৃতার মধ্যে তিনি নিজের বিজ্ঞাপন করেন। নিজেকে মহান করে দেখানোর চেষ্টা করেন। এটাও এক ধরনের মানসিক ভীতি। এমনকী রাষ্ট্রসঙ্ঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে মহান করে তুলে ধরার লোভটুকুও সামলাতে পারেন না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজের ফিরিস্তি দিয়ে বলেন, দেখুন আমরা কত কী করেছি। বারবার সেই চা বিক্রির গল্প বলে সহমর্মিতার ফাঁদ পাতেন। নিজের কীর্তি ব্যাখ্যা করেন। রাষ্টসঙ্ঘের মঞ্চের গুরুত্বটুকু তো বোঝা দরকার! আসলে উত্তরপ্রদেশে ভোটের আগে বেশ নার্ভাস মোদি। নব্বইয়ের ঘরে ব্যাট করার সময় ব্যাটসম্যানের যে অবস্থা হয়, বর্তমানে মোদির অবস্থাও তাই। উত্তরপ্রদেশ নিয়ে সংশয় থেকেই তাঁর আপন মহিমা কীর্তন।
আসলে তিনি জানেন, তিনি পদে পদে ভুল করছেন। সেটাকে চাপা দিতেই মিথ্যা প্রচারের আশ্রয় নিতে হয়। তাঁর সরকার সত্যকে চাপা দিতে উন্নয়নের ভুয়ো রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই মিথ্যা কিন্তু চাপা থাকে না। তাঁর ব্যর্থতার সত্যটা বারবার প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাঁর সেই ব্যর্থতাকে চাপা দিতে তৎপর সরকারের বিজ্ঞাপন দপ্তর, তৎপর বিজেপির আইটি সেলও। ব্যর্থতা যত প্রকট হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের দাপট তত বাড়ছে। গরিমা প্রকাশের ক্লিশে বিজ্ঞাপনে বার্নিশ মেরে চকচকে করে তোলা হচ্ছে।
আসলে মোদির আত্মবিশ্বাস ভেঙে গিয়েছে। তার একমাত্র কারণ বাংলার ভোট। যেভাবে তিনি তুড়ি মেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উড়িয়ে দেবেন ভেবেছিলেন, বাংলার মানুষের সেই তুড়িতে তিনি নিজেই উড়ে গেলেন। তারপর থেকেই আত্মবিশ্বাসে ভাটার টান তাঁর। শুধু বাংলার হারটুকু নিয়ে মোদি চিন্তিত নন। তিনি চিন্তিত মমতার উত্থান নিয়েও। যেভাবে তিনি একদিন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থেকে দ্রুত মানুষের মন জয় করে দেশের শীর্ষ ক্ষমতা দখল করেছিলেন, আজ মমতার তেমনই উত্থানে তিনি সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। বুঝতে পারছেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আজ উম-পুনের গতিতে ধেয়ে আসছেন। মমতা আজ টর্নেডোর বেগে ধেয়ে চলেছেন ভারতজয়ের বার্তা নিয়ে। ঠিক এইখানেই মমতাকে তাঁর ভয়। আর সেই ভয়ের তল কতটা, সেটা বোঝাই যাচ্ছে মমতার রোম যাত্রা বাতিল করার ভ্রষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে। বিশ্ব শান্তি নিয়ে রোমে এক বিশ্ব সম্মেলনে মমতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বলার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু মমতাকে সেই সভায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই নিষেধজ্ঞা যে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক এবং শীর্ষকর্তার নির্দেশ ছাড়া হতে পারে না, এটা যে কোনও গো-মুখ্যুও বুঝবেন। এই যে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও মমতা আজ মোদির সমকক্ষ হয়ে উঠছেন, জনপ্রিয়তায় তাঁকে ধীরে ধীরে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছেন, এটা মোদিবাবুর না-পসন্দ। কিন্তু এভাবে দুরভিসন্ধি দিয়ে কাউকে আটকানো যায় না। একটা ছোট রাজ্যের প্রধান হয়ে মমতা যে কাজটুকু করেছেন, যে স্বপ্নটুকু তৈরি করে সীমিত ক্ষমতার মধ্য দিয়ে মানুষকে আলোর দিশা এনে দিতে চেয়েছেন, তা আগামী দিনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আগামী দিনে মমতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও বড় পদক্ষেপ রাখবেন, মেয়েদের আলোর পথযাত্রী করে তোলা, মেয়েদের ক্ষমতায়নের স্বীকৃতি তিনি পাবেনই, বড় আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পাবেন। সেদিন কিন্তু মোদি সরকার তাঁকে পিছন থেকে টেনে আটকে রাখতে পারবেন না।
রাত পোহালেই ভোট ভবানীপুরে। ‘খেলা হবে’ স্লোগানের পর্ব বোধহয় একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। বাংলায় ২০২১ সালে সেমিফাইনাল খেলা হয়েছে। ফাইনাল ম্যাচ দেশজুড়ে ২০২৪ সালে। ভবানীপুরের ভোট সেই বার্তাই ছড়িয়ে দেবে। ভবানীপুরে যে পথের শুরু, সেই পথই একদিন ভারত বিজয়ের পথ দেখাবে। এই আতঙ্কটাও তো মোদির পক্ষে কম নয়! নার্সিসাসের মতো মোহান্ধ হয়ে তিনি ক্ষমতার দিকে হাত বাড়াচ্ছেন। কিন্তু সেই মোহ চুরমার হয়ে যাবে একদিন। স্বীয় কৃত ভ্রান্তিই হবে পতনের মূল কারণ।