কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
বড় মুখ করে বলতেন নরেন্দ্র মোদি। সেই প্রধানমন্ত্রীই আজ দেশের ‘দুর্নীতির ইতিহাস’ ভুলে গিয়েছেন। যে ইতিহাসে জড়িয়ে পড়েছিল ভারতীয় জীবনবিমা নিগম (লাইফ ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া)-র নাম।
১৯৪৬ সাল। স্বাধীনতার দোরগোড়ায় ভারত। এই সময়ে রাম কিষন ডালমিয়া কিনে নিলেন ভারতের প্রখ্যাত মিডিয়া হাউস। প্রভাবশালী শিল্পপতি পা রাখলেন প্রকাশনার জগতে। কিন্তু ডালমিয়া গ্রুপের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা একা সামলানো দায়। রাম কিষন তিনভাগ করলেন নিয়ন্ত্রণ-কাঠামো। মূল ভাগ নিজের হাতে। একাংশের দায়িত্ব গেল ভাই জয়দয়াল ডালমিয়ার হাতে। অন্য অংশের দায়িত্বে জামাই শান্তি প্রসাদ জৈন। তৈরি হল ডালমিয়া-জৈন গোষ্ঠী। যাঁদের হাত ধরেই স্বাধীন ভারতের গায়ে লেগেছিল দুর্নীতির কালো দাগ!
দেখতে দেখতে আরও পাঁচ বছর। ১৯৫১-তে ভারতের প্রথম নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। স্বাধীনতার পর থেকেই বহু দেশীয় বাণিজ্যিক গোষ্ঠী ক্রমশ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে। পাশাপাশি দেশে আর্থিক অনিয়মও মাথাচাড়া দিতে থাকে। আর তখনই গোল বাঁধালেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জামাই। রায়বেরিলির সাংসদ ফিরোজ গান্ধী টের পেলেন, দেশের প্রখ্যাত মিডিয়া হাউস বেচাকেনার পিছনে বড় আর্থিক ঘোটালা রয়েছে। বহু নথি ঘেঁটে ১৯৫৫-র ৬ ডিসেম্বর ফিরোজ গান্ধী পার্লামেন্টে তুলে ধরেছিলেন সেই দুর্নীতির কথা। ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের লম্বা ভাষণে চমকে দিয়েছিলেন গোটা দেশকে। তথ্য দিয়ে সেদিন ফাঁস করেছিলেন ডালমিয়া-জৈন গোষ্ঠীর মালিকানাধীন ভারত ব্যাঙ্ক ও ভারত ইনস্যুরেন্স কোং লিমিটেড কেমন করে বিমা গ্রাহকদের প্রতারণা করছে। গোপনে বিমা কোম্পানির টাকা কীভাবে অন্যান্য উদ্যোগে কাজে লাগানো হচ্ছে। আর বেআইনি পথে লাভের অর্থ কীভাবে যোগ হচ্ছিল শিল্পগোষ্ঠীর কর্তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। সংসদে ফিরোজের প্রথম ভাষণের জেরেই বেসরকারি বিমা সংস্থার মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। শ্বশুর প্রধানমন্ত্রী নেহরু যতই বিড়ম্বনায় পড়ুক, তার চেয়েও দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন জামাই ফিরোজ গান্ধী।
এরপর লোকসভায় ক্রমাগত বিমা জাতীয়করণের দাবি তুলে সরব হতে দেখা গিয়েছিল ফিরোজ গান্ধীকে। বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকা বিমা ব্যবসার ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে জানিয়েছিলেন, সেই সময় ৬৬টি সংস্থা বিমা নিয়ন্ত্রকের কাছে তাদের হিসাব সংক্রান্ত তথ্য জমা করেনি। ২৩টি সংস্থা তাদের কোম্পানির ‘ভ্যালুয়েশন’ সংক্রান্ত নথি জমা দেয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল বিমাকারীদের স্বার্থরক্ষার্থে শুধু বিমা আইন সংশোধনই যথেষ্ট নয়। দেশের সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজন বিমার জাতীয়করণ। শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রবল হইচই। বাধ্য হয়ে নেহরু সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভিভিয়ান বোসের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্ট স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানির অর্থ অবৈধভাবে ব্যবহার করেছেন প্রভাবশালী শিল্পপতি রাম কিষন ডালমিয়া। দু’বছরের কারাদণ্ড হয় রাম কিষনের। তিহার জেলে অবশ্য খুব সামান্য সময়ই থাকতে হয়েছিল তাঁকে। প্রায় গোটা সময়টাই চিকিৎসার অছিলায় বিভিন্ন হাসপাতালেই কাটিয়েছিলেন।
বিমা জাতীয়করণের উদ্যোগকে সেদিন সমর্থন জানিয়েছিল বিরোধীদল কমিউনিস্ট এবং সোশ্যালিস্টরা। ফলে ১৯৫৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতে জীবনবিমা জাতীয়করণ করা হয়। ওই সময় ১৫৪টি ভারতীয় জীবনবিমা সংস্থা, ১৬টি বিদেশি সংস্থা এবং ৭৫টি প্রভিডেন্ট অর্থাৎ মোট ২৪৫টি সংস্থা ছিল। এই সংস্থাগুলিকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল দু’টি ধাপে। প্রাথমিকভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করে সংস্থাগুলির ম্যানেজমেন্টকে হাতে নেওয়া হয়। তারপরে বিল জারি করে মালিকানা নেওয়া হয়েছিল। ১৯৫৬-র ২৩ মে জীবনবিমা নিগম বিল এবং ১৯ জুন ভারতীয় জীবনবিমা নিগম আইন-১৯৫৬ পাশ হয়। এর কয়েকমাসের মধ্যেই ১৯৫৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভারতীয় জীবনবিমা নিগম-এর আত্মপ্রকাশ। নিগমের কেন্দ্রীয় অফিস হয় তৎকালীন বম্বেতে। কেন্দ্রীয় অর্থসচিব এইচ এম প্যাটেলকে নিগমের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনিই তখন হন নতুন এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। একইসঙ্গে টি টি কৃষ্ণমাচারি হন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কারণ, তার আগেই পূর্ববর্তী অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ পদত্যাগ করেছিলেন। বিমা জাতীয়করণের পর সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে ফিরোজ বলেছিলেন, ‘ঘোড়া ধরে রাখার জন্য আপনার লাগাম লাগবে, একটি হাতি ধরে রাখার জন্য আপনার একটি শেকল দরকার।’ কিন্তু এরপরও দুর্নীতি পিছু ছাড়েনি!
১৯৫৭ সালেও রায়বেরিলি থেকে ফের জিতে সংসদে ফিরোজ গান্ধী। তখনই তাঁর নজরে আসে কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের ফাটকাবাজ হরিদাস মুন্দ্রা কেমন করে জীবনবিমা নিগমে তার প্রভাব খাটাচ্ছে। এই মুন্দ্রা ১৯৫৪ সালে ব্যবসা শুরু করে দু’বছরের মধ্যে ধনকুবের হয়ে উঠেছিল। ফলে ১৯৫৭ সালের শেষদিকে জীবনবিমা নিয়ে ফের লোকসভা উত্তাল করেন ফিরোজ। সংসদে প্রশ্ন তোলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জীবন বিমা নিগম কী করে কানপুরে হরিদাস মুন্দ্রা নামে এক শিল্পপতির ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থায় বিপুল বিনিয়োগ করতে পারে। ট্রেজারি বেঞ্চে বসেই তিনি সরকারের কাছে জানতে চান, নতুন করে গড়ে ওঠা জীবনবিমা নিগম আদৌ কি তাদের সাড়ে পাঁচ কোটি পলিসি হোল্ডারকে জানিয়ে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার কিনেছে? ওই সময় এলআইসি মুন্দ্রার ছ’টি দুর্বল সংস্থায় ১.২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বড় লোকসানের মুখে পড়েছিল। ফিরোজ গান্ধী বললেন, মুন্দ্রাদের শেয়ার কিনে নেওয়ার উদ্দেশ্য হল প্রকৃত বাজারদরের তুলনায় তাদের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে রাখা। অস্বস্তিতে পড়ে যান প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু। ক্ষুব্ধ স্বয়ং অর্থমন্ত্রী কৃষ্ণমাচারি।
সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত রাজ্যসভায় কৃষ্ণমাচারির বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় তোলেন। কৃষ্ণমাচারি দাবি করেছিলেন, “আমি হরিদাস মুন্দ্রা নামটাই কোনও দিন শুনিনি।” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় নেহরুকে চিঠি দিয়ে বলেন, অসত্য বলছেন অর্থমন্ত্রী। আর মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নেহরুকে বলেছিলেন, “তুমি যদি ওর ইস্তফা গ্রহণ না করো, তা হলে আমি ইস্তফা দেব।” সরকার বাধ্য হয় বম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম সি চাগলাকে নিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গড়তে। প্রায় সওয়া কোটি ঘাপলা! মুন্দ্রা স্ক্যান্ডাল। ২৪ দিন ধরে চলেছিল সেই শুনানি। বহু বিখ্যাত স্টক ব্রোকার যাঁরা জীবনবিমার লগ্নি কমিটিতে ছিলেন, তাঁরাও জানিয়ে দেন, এইভাবে শেয়ার কেনার মাধ্যমে বাজার চাঙ্গা হবে বলে অর্থমন্ত্রক দাবি করলেও তা আদৌ ঠিক নয়। তাছাড়া জীবনবিমা তার বিনিয়োগ কমিটির কাছ থেকে পরামর্শ নিতে গেলে তাঁরা মুন্দ্রার জাল শেয়ারের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। স্ক্যান্ডালটি উঠে এসেছিল ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের পাতায়! এর জেরে কৃষ্ণমাচারি বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এইচ এম প্যাটেল চাকরি ছেড়ে দেন। আর দিল্লির বিলাসবহুল হোটেল থেকে হরিদাস মুন্দ্রাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রক্ষা পায় দেশের আমআদমির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন— এলআইসি।
আজ মোদি জমানায় সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে নিগমের শেয়ার বেচে দিতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। লক্ষ্য একটাই, এলআইসির কিছু শেয়ার বেচে সরকারের কোষাগারে অর্থ তোলা। মোদি সরকারের অভিমত, এই মেগা ইস্যুতে এদেশের শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা বিরাট সুযোগ আসছে। আর বিরোধীদের অভিযোগ, এলআইসি ফের তুলে দেওয়া হচ্ছে রাম কিষন ডালমিয়া কিংবা হরিদাস মুন্দ্রাদের হাতেই। অথচ, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই সংস্থাটি ২.১৯ কোটি ম্যাচিউরিটি ক্লেম, মানিব্যাক ক্লেম এবং অ্যানুইটি মিটিয়েছে, যার পরিমাণ ১.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। আর এই সময়ে সংস্থাটি ১১.৪৭ লক্ষ ডেথ ক্লেম মিটিয়েছে, যার পরিমাণ ২৪,১৯৫.০১ কোটি টাকা।
শুধু তাই-ই নয়, মোদি জমানায় ২০১৫ সালে কোল ইন্ডিয়ার বিলগ্নিতে এলআইসি ১০ হাজার কোটি ঢেলেছে। লোকসানে বিপর্যস্ত আইডিবিআই ব্যাঙ্ককে উদ্ধার করতে আরও ২০ হাজার কোটি। আবাসন শিল্পকে বাঁচানোর তহবিল গড়তেও স্টেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে টাকা ঢালছে এলআইসি। সেই তালিকায় রয়েছে ডেকান ক্রনিক্যাল, এসার পোর্ট, গ্যামন, ভূষণ পাওয়ার, ভিডিয়োকন, অলোক ইন্ডাস্ট্রিজ়, এবিজি শিপইয়ার্ড, ইউনিটেক, জিভিকে পাওয়ার। এমন বহু সংস্থায় এলআইসির ঋণ আটকে রয়েছে, যেখান থেকে সিংহভাগ পুঁজিই ফেরত আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলে উঠছে প্রশ্ন, এই সরকারি জীবন বিমা সংস্থায় আমজনতা টাকা রাখেন নিরাপদ মনে করে। একের পর এক দুরবস্থা সামাল দিতে তাকেই এগিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত পুঁজিকে ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে কেন? যে রুগ্ন সংস্থাগুলিকে এলআইসি টাকা ধার দিয়েছে, তা শোধ না হলে কী হবে? সকলকে বাঁচাতে গিয়ে শেষে এলআইসির লাভে টান পড়বে না তো?
এলআইসির টাকা নিয়ে যথেচ্ছাচার আসলে সাধারণ মানুষের লগ্নি নিয়ে ছেলেখেলা। অন্তত পঁচিশ কোটি গ্রাহক টের পাচ্ছেন, কেন মোদি সরকারকে বিশ্বাস করা উচিত নয়!