কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
আমরা যখন স্কুলের চাকরি পাই, কিছুদিন পর সকলেরই মনের একটি গোপন ইচ্ছা থাকে, স্কুলে আটকে থাকলে চলবে না। এরপর কলেজে শিক্ষকতার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা যখন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য অথবা কাউন্সিলার পদে নির্বাচিত হই, আমাদের বাসনা ও স্বপ্ন থাকে এরপর বিধায়ক, তারপর মন্ত্রী হব। একজন ব্যবসায়ী তাঁর ক্ষুদ্র ব্যবসাটি পরিশ্রম করে বাড়িয়ে যখন দেখলেন বেশ লাভজনক হয়েছে, তাঁর লক্ষ্য থাকে ব্যবসা বাড়াতে হবে, আরও একটি দোকান কিনতে হবে অথবা অন্য একটি নতুন বাণিজ্যে টাকা লগ্নি করলে কেমন হয়? আমাদের মধ্যে অনেকেই রাজ্য সরকারের ইউডিসি পদে চাকরি পাওয়ার পর, প্রাণপণে পড়াশোনা করি ডব্লুবিসিএস পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ডাক্তারি ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষা থাকে, এমবিবিএসের পর এমডি, তারপর বিদেশ গিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন। বসিরহাট থেকে কলকাতায় যিনি এতকাল ডিম সাপ্লাই দিচ্ছেন, তাঁর একান্ত কল্পনা থাকে, বৈঠকখানা বাজারে আমার একটা নিজের দোকান হলে ভালো হয়। এই তালিকার অন্ত নেই। অর্থাৎ জীবিকা, কেরিয়ার, রাজনীতি, পারফর্মিং আর্টস, শিক্ষা, সাহিত্য, সমাজসেবা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক একটি লক্ষ্য থাকে, আরও একটু এগিয়ে যাওয়া। যতটা অর্জন করেছি, আরও একটু নতুন লক্ষ্যপূরণের স্বপ্ন বুকে বাসা বাঁধে। এটাই স্বাভাবিক। কেউ সফল হয়। কেউ ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই যে পরবর্তী একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিশ্রম করে অগ্রসর হওয়া, এর মধ্যে অন্যায় নেই। বরং এটাই হওয়া উচিত।
এসব প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ কী? কারণ হল, বাংলার রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধীদের মধ্যে আপাতত একটি ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুরু হয়েছে। সেটি হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন? তিনি যে কোনওভাবেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এই ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি কটাক্ষ করা হচ্ছে। বিরোধীরা তো রাজনীতিগতভাবে মমতা বিরোধী। তাহলে তাঁরা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রাণপণে রাজনীতির ময়দানে পরাস্ত ও বিব্রত দেখতে চাইবেন এটা তো স্বাভাবিক? অন্যায়ের কী আছে? একেবারেই ঠিক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি নিছক রাজনীতির প্রতিপক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে এই প্রচারে যে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ধৃষ্টতা তিনি কেন দেখাচ্ছেন? তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাই যেন বিরাট অপরাধ এবং উপহাসযোগ্য!
খুব স্বাভাবিক নিয়মেই মমতা প্রধানমন্ত্রী হতে চাইতেই পারেন। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি বিরোধী নেত্রী। কংগ্রেসের মতো এক বিপুল বটগাছের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে তেপান্তরের মতো এক শূন্য ময়দানে এসে তিনি নিজের একক দলের চারাগাছ তৈরি করেছিলেন ১৯৯৮ সালে। মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে সেই দল বাংলায় সরকার গঠন করে ফেলেছিল। এর পরবর্তী দুটি নির্বাচনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিপুলভাবে গরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ মোট তিনবার তিনি সরকার গঠন করেছেন। ভারতের যে কোনও প্রথম সারির রাজনীতিবিদের কাছে তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াই এক চরম সাফল্য। সুতরাং, এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরবর্তী গোলপোস্ট যদি প্রধানমন্ত্রীর আসনটি হয়, সেটা অস্বাভাবিক তো নয়ই, বরং সেটাই কাম্য। একইভাবে নবীন পট্টনায়ক দেখতে পারেন এই স্বপ্ন। নীতীশ কুমার পারেন। শারদ পাওয়ার পারেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরও মনে এই বাসনা আছে। এসবই অত্যন্ত স্বাভাবিক।
তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার পর এবার একটি উচ্চতর সাফল্যকে স্পর্শ করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটায় তিনি সফল হতে পারেন। চরম ব্যর্থও হতে পারেন। সেই ফলাফল ২০২৪ সালে জানা যাবে। কিন্তু এই উদ্যোগটি হাস্যকর, অস্বাভাবিক, ইম্যাচিওরড এরকম ভাবছে কেন বিরোধীরা? দুবারের সফল মুখ্যমন্ত্রী, দলের উপর আধিপত্য কায়েম করতে সিদ্ধহস্ত এবং গুজরাতের সফল প্রশাসক হিসেবে দেশে পরিচিত নরেন্দ্র মোদি ২০১২ সাল থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনায়। সেটাও ছিল স্বাভাবিক। তাঁর সুবিধা ছিল যে, তিনি একটি সর্বভারতীয় দলের নেতা। সুতরাং তাঁর জয়ের সম্ভাবনা বেশিই ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই কঠিন। এককভাবে তৃণমূল তো আর গরিষ্ঠতা পাবে না। সুতরাং একটি বিজেপি বিরোধী জোট গড়তে হবে। তার আগে প্রতিটি বিজেপি বিরোধী দলের মোট আসন মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির থেকে বেশি হতে হবে। গরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে। সকলকে সহমতের ভিত্তিতে একই ছাতার নীচে আনতে হবে। অনেক কঠিন রাস্তা, সমীকরণ এবং রসায়ন পেরিয়ে যেতে হবে তাঁকে। কিন্তু চেষ্টায় দোষ কী?
বিরোধীরা হয়তো বুঝতেই পারছেন না যে, তাঁরা এই ইস্যু নিয়ে হাসাহাসি কিংবা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করার পরোক্ষ অর্থ হল, তাঁরা মনেপ্রাণে চাইছেন না যে একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ তাঁদের মনোভাব হল, এই প্রথম কোনও বাঙালি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না সেটা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন ব্যর্থ হন। অর্থাৎ বাঙালির স্বার্থ নিয়ে তাঁদের কোনও আবেগ অথবা উচ্চাশা নেই। তাঁরা তৃণমূলকে ভোটে হারানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ুন না! সেটাই তো স্বাভাবিক হবে। কিন্তু মমতা কেন প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন এই প্রশ্ন উত্থাপন করা তো অর্থহীন!
বিরোধীদের বিশ্লেষণ করা দরকার যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করি আর নাই করি, তাঁর রাজনীতির আমি সমর্থক যদি নাও হই, শেষ বিচারে সত্যিই যদি একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী আমরা পেয়ে যাই, সেটা বাঙালি জাতি এবং রাজ্যের উন্নয়নের নিরিখে একটি বিরাট সুযোগ উপস্থিত করবে। দুই দফায় রেলমন্ত্রী থাকার সময়ই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা দেশের সব সমালোচনা সহ্য করে এবং বহু আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাংলার জন্য অগাধ উপহার দিয়েছিলেন বাজেটের পর বাজেটে। সেজন্য তাঁকে নিজের সরকারের মধ্যেই প্রচুর আপত্তি, কটাক্ষ, প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সর্বভারতীয় মিডিয়ায় মমতার রেলবাজেটে বাংলার জন্য কল্পতরু হওয়া নিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে, ‘বেঙ্গল এক্সপ্রেস’! তিনি তোয়াক্কা করেননি। পরের বছর আবার দিয়েছেন বাংলাকে উপহার।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পদটি একবার বাঙালির কাছে এলে যে আদতে বাংলার ভবিষ্যৎ অনেকটাই অন্যরকম হবে, সেই আশা করাই যায়। বিগত ৭৪ বছরে তো সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েই রইলাম আমরা। এবার একটা মরিয়া চেষ্টা হলে ক্ষতি কী? সবথেকে বড় কথা, এটাই হয়তো শেষ সুযোগ! কারণ, এই মুহূর্তে আর কোন বাঙালি রাজনীতিক আছেন যিনি প্রভাব, প্রতিপত্তি, জনপ্রিয়তায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন ভবিষ্যতে? এরকম পরিস্থিতি যে কোনও রাজ্যে তৈরি হলে কিন্তু সেই রাজ্যবাসী চাইতেন তাঁদের রাজ্যের নেতাই যেন প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি যে দলেরই হন। বাঙালিও নিশ্চয়ই সেরকমই চাইবে। বাংলার স্বার্থে।
২০২৪ সালে দেশজুড়ে ভোটের ফলাফল কেমন হবে সেটার উপর নির্ভর করছে সম্ভাবনা কোনদিকে অগ্রসর হবে। সেরকম কোনও পরিস্থিতি আদৌ তৈরি হবে কি না, হলেও মমতাকে সব বিজেপি বিরোধী দল মেনে নেবে কি না ইত্যাদি অসংখ্য পারমুটেশন কম্বিনেশনের প্রশ্ন আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্যের গ্রাফ চমকপ্রদ। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৪ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিগত ৩৭ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ হয়ে এ রাজ্যে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, এরকম প্রজন্ম একে একে মূলস্রোত থেকে বিদায় নিয়েছেন অথবা নিচ্ছেন কিংবা ভোটে হেরে গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছেন রাজ্য রাজনীতিতে। বাম, কংগ্রেস, বিজেপি সর্বত্রই এই চিত্র। সফল হয়ে রয়ে গিয়েছেন তিনি একা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি ভালো হোক অথবা মন্দ, তাঁর সমর্থক হই অথবা না হই, তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে যে, এ রাজ্যে রাজনৈতিক যুদ্ধে তিনি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ প্রতিপক্ষহীন হয়ে যাচ্ছেন!