কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু সাধারণ মানুষ ভেবে ক্ষমা করে দেবেন। সাধারণের এমন একটু ভুলচুক, দেরিটেরি হয়ে থাকে। নানান বাজে কাজের মধ্যে থাকি আমরা। কারও ১০টা-৫টার অফিস, কারও আবার দিনমজুরি। আপনারা দেশ চালান। আপনারাই আমাদের মাই-বাপ। অনেক বড় দায়িত্ব আপনাদের। তাই দু’হাত জড়োসড়ো করে, মনের ভিতর একরাশ ভয় নিয়ে আপনাদের অনুগ্রহের আশায় তাকিয়ে থাকি আমরা... লকডাউনে কাজ হারিয়ে আমরা ভাবি, কখন পাওয়া যাবে বিনা পয়সার রেশন! মাস্টার ডিগ্রি করে বছরের পর বছর বসে থাকা বেকার ছেলেমেয়েগুলো ভাবে, কখন মিলবে একটা চাকরির সুযোগ! নিদেনপক্ষে ডোমের হলেও চলবে। কিছু তো একটা জুটল! কিংবা করোনার আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবন ভুলতে বসা আপামর জনসাধারণ ভাবতে বসে... কখন মিলবে ভ্যাকসিন? একটা সুচের ফোঁটা... তাই যে মহামারীর মধ্যে বিশল্যকরণী। এরই মধ্যে দেখলাম, আপনার জন্মদিন, মানে ১৭ সেপ্টেম্বর আড়াই কোটির বেশি মানুষ করোনা টিকা নিয়েছেন। মোট সংখ্যাটা দেখলাম ২ কোটি ৫০ লক্ষ ১০ হাজার ৩৯০। চমকে যাওয়ার মতো পরিসংখ্যান। একদিনে এত ভারতবাসী তাহলে করোনা টিকা পেতে পারে! অপরাধ নেবেন না... সংখ্যাটা দেখতে দেখতেই মনে পড়ে গেল রাজা যযাতির কথা। কেন? একটু ব্যাখ্যা করি। শুক্রাচার্যের অভিশাপে বেজায় বিপাকে পড়েছিলেন যযাতি। রাজশেখর বসুর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘শুক্র ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন, মহারাজ, তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে অধর্ম করেছ... আমার উপদেশ গ্রাহ্য কর নি, অতএব দুর্জয় জরা তোমাকে আক্রমণ করবে। শাপ প্রত্যাহারের জন্য যযাতি বহু অনুনয় করলে শুক্র বললেন, আমি মিথ্যা বলি না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে তোমার জরা অন্যকে দিতে পারবে।’ দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার থেকে পাঁচটি সন্তান ছিল যযাতির। একে একে তিনি প্রত্যেককে অনুরোধ করলেন, আমার জরা নিয়ে নাও। কিন্তু কেউ রাজি হল না। তাতে বিষম রেগে গেলেন যযাতি। আর নিজের সন্তানদেরই ভয়ানক সব অভিশাপ দিলেন। তুর্বসুকে বললেন, তোমার বংশলোপ হবে। দ্র্যুহ্যু দুর্গম জায়গায় গিয়ে ভোজ উপাধি নিয়ে থাকবে। অনু জরান্বিত হবে আর তার সন্তান যৌবনকালেই মারা যাবে। শুধু সবচেয়ে ছোট ছেলে পুরু বলেছিলেন, যেমন আপনার আজ্ঞা। পিতা যযাতির জরা নিজের শরীরে নিয়ে নিয়েছিলেন পুরু। আর যযাতি মহাশয়? সন্তানের যৌবন হাতিয়ে তিনি মন দিয়েছিলেন ভোগকর্মে।
ভারতবাসীর অবস্থা এখন হয়েছে সেই পুরুর মতো। বিপুল ভোট দিয়ে সরকারের মাথায় আপনাদের বসিয়েছি আমরা। পিতার কাছে সন্তানের কী চাহিদা থাকে? শিক্ষা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। মহামহিম সরকার বাহাদুরের কাছেও সাধারণ মানুষের এই এতটুকুই তো চাহিদা! আরও একটা আছে। বেঁচে থাকার অধিকার। একটি ভাইরাসের হামলা... আর তাতেই এক অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখে পড়ল মানুষ। পরীক্ষার সুযোগ নেই, পরীক্ষা হলেও রিপোর্ট আসতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে রোগী, হাসপাতালে বেড নেই, মৃতদেহ পোড়ানোর স্থানাভাব, গঙ্গার বুকে ভাসছে লাশ। আর সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ। আশার আলো বলতে ভ্যাকসিন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা হয়তো ঠেকানো যাবে না। কিন্তু টিকা নেওয়া থাকলে ভাইরাসের অভিঘাত কমবে। মৃত্যুর থেকে বাঁচবে অধিকাংশ মানুষ। তাই ভ্যাকসিনের দু’টো ডোজ—এটাই আজ আঁকড়ে ধরার একমাত্র সম্বল। বেঁচে থাকার উপায়। মৌলিক অধিকার। মোদিজি... আপনি দেখালেন, কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে একদিনে আড়াই কোটি ভারতবাসীকে টিকা দেওয়া সম্ভব। তাহলে এতদিন হল না কেন? শুধুমাত্র একটি দিন, একটি লগ্নের জন্য মানুষের এই অধীর অপেক্ষা কেন? দিনের পর দিন মানুষ লাইন দিয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে। রাত তিনটে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা... বয়স যাই হোক না কেন... ৬০, ৭০ বা ৮০! তাঁরা দাঁড়াচ্ছেন, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছেন। তারপর শুনছেন, আজ আর কোভিশিল্ড নেই। কিংবা কোভ্যাকসিন আজ আর হবে না। সামনে কোলাপসিবল গেটের গায়ে ঝুলে পড়ছে তেরা-বেঁকা হাতের লেখায় ‘নো ভ্যাকসিন’। তাঁরা বাড়ি ফিরেছেন... ক’দিন পর খোঁজ নিচ্ছেন, ভ্যাকসিনের স্টক কি এল? আবার শুরু হয়েছে লাইন দেওয়ার পালা। একবুক আশা নিয়ে।
১৩০ কোটির দেশ আমাদের। একদিনে, এক সপ্তাহে কিংবা এক মাসেও সবার টিকাকরণ সম্ভব নয়। এতটুকু বোধ আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও আছে। তাও আমরা আশা করেছি। ভেবেছি, আজ হল না... ঠিক আছে। কাল তো হবে! সেই আগামী কাল আর এসে পৌঁছচ্ছে না। কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে সেন্ট্রাল ভিস্তার প্রজেক্ট। আসছে রাফাল। ধুমধাম করে
পালিত হচ্ছে আপনার জন্মদিনের কর্মসূচি। সাতদিন ধরে তার প্রোগ্রাম তৈরি হচ্ছে। পোস্টার লাগছে।
খরচ কত? সে তো আবার আরটিআই করতে
হবে! সরকার বলবে, আমরা তো খরচ করিনি! ওটা পার্টির ব্যাপার। পার্টি বলবে, ভক্তরা ভালোবেসে দিয়েছে। না হয় তাই সই। কিন্তু ওই ভক্তরা একবার যদি ভাবতেন... এই টাকা দিয়ে কত মানুষের ভ্যাকসিন হবে! নাঃ, ভাবেননি। সেটা তাঁদের স্বভাব নয়। বরং সেই সময়টা খোলকরতাল বাজালে কাজে দেবে। নেতাদের কাছে নম্বর বাড়বে। ক্ষমতার অলিন্দে পা পড়বে আরও একটু।
অনেক কাজ আপনার। এক ছিলেন যুধিষ্ঠির... মাটিতে পা পড়ত না তাঁর। আপনারও পড়ে না। এতটাই ব্যস্ত আপনি। নিয়ম করে রাজ্যে রাজ্যে যাওয়া, মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, কার কোথায় সমস্যা হচ্ছে... এসব নিশ্চয়ই আপনি খোঁজখবর করেন? ফেডেরাল কাঠামোয় মাথার উপর থাকে কেন্দ্র। আর রাজ্য সরকার কাজ করে তাদের সঙ্গে। একে অপরের পরিপূরক। সেখান রাজনৈতিক দল, বা শাসক-বিরোধী গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি নিশ্চয়ই এই সাংবিধানিক নিয়মটুকু মেনে চলেন! না হলে এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী আপনি হতে পারতেন না। বিমানের জানালায় আমরা দেখি আপনাকে... বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। তারপর সেই রাজ্য কতটা কেন্দ্রীয় ক্ষতিপূরণ পায়? নিশ্চয়ই পায়! রাজ্য সরকারগুলো সব দুষ্টু... এরপরও অভিযোগ করে, কিছুই পায়নি! নিশ্চয়ই সেসব সত্যি নয়? কেন্দ্রীয় সরকার টিকার পর্যাপ্ত সরবরাহ করছে না বলে কত রাজ্য কতই না আওয়াজ তুলছে... কেন যে এমন সব অভিযোগ করে! আপনার কত কাজ! সবদিক বিবেচনা করে সবাইকে আপনি ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছেন। বিজেপি বা বিরোধী রাজ্য দেখে নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত নেন না! অ-বিজেপি দলগুলি কিন্তু এরপরও অভিযোগ করেই চলেছে। ওরা বলছে, আপনার বিরোধিতা করা যায় না। করলেই অসহযোগিতা নাকি অভিশাপের মতো আছড়ে পড়ে সেই দলের উপর... রাজ্যের উপর। জরায় আক্রান্ত হতে চাননি যযাতি। যৌবন ছিল তাঁর লক্ষ্য... তা সে সন্তানেরই হোক না কেন। আপনারও অভীষ্ট একটাই—আনুগত্য। সাধারণ মানুষ আপনাকে ঝুলি উপুড় করে দিয়েছেন ভোটের আশীর্বাদ। দু’বার। আপনি বলেছিলেন, করোনা বিদায় নিয়েছে। একই কথা আউড়েছিলেন আপনার মন্ত্রীও। করোনা যায়নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা সাধারণ মানুষের উপর আছড়ে পড়েছিল দ্বিতীয় ঢেউ। বেড়েছিল মৃত্যুমিছিল। এটাও কি প্রাপ্য ছিল আমাদের? শুধুই আপনাদের বিশ্বাস করেছিলাম বলেই কি মৃত্যুভয়ের শেষ কিনারে পৌঁছে যেতে হয়েছে ভারতকে? তাও আমরা মেনে নিয়েছি। নিঃশব্দে। ভেবেছি, আপনার কীই বা করার আছে! এ তো নিয়তির খেল! ভ্যাকসিন নেব, তাতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও করোনা নামক এক মহামারীর মোকাবিলা করতে পারব সামনে থেকে। জীবন আবার স্বাভাবিক হবে। জীবিকা ফিরবে চেনা ছন্দে। কিন্তু ততদিনে আবার আমরা অকাল জরায় আক্রান্ত হব না তো? ঠিক যেমন পুরুর হয়েছিল!
যযাতি ভেবেছিলেন, নাম-যশ-ভোগই জীবন। আপনি নিশ্চয়ই তেমন কিছু ভাবেন না! দেশবাসী আপনার সন্তানসম। তাঁদের প্রত্যেকের অধিকার রক্ষা আপনার কর্তব্য। আমরা এখনও মনে করি, আপনি সেটাই মেনে চলেন। কিন্তু আপনার জন্মদিনের প্রোপাগান্ডায় আড়াই কোটি ভ্যাকসিনের ডোজ আমাদের মনে কিছু প্রশ্নের ঝড় তুলে দেয়। সেখানেও হিসেবে গরমিলের অভিযোগ ওঠে। আর আমরা ভাবতে বাধ্য হই, আপনি শুধুই নিজের তূণীর সমৃদ্ধ করতে বেশি আগ্রহী। একদিন ২৫ লক্ষ ভ্যাকসিন, আর একদিন আড়াই কোটি ডোজের অঙ্কে সাধারণ মানুষের জীবনের পথ মসৃণ হয় না। তাতে কাঁটার সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ‘প্রজারা’ ভাবে, শাসক এই সত্যটা কি বুঝবেন না?
যযাতি বুঝেছিলেন। পুরুকে তিনি বলেছিলেন, ‘কাম্য বস্তুর উপভোগে কখনও কামনার শান্তি হয় না, ঘৃতসংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পায়।’ ক্ষমতার আগুনে ঘৃতসংযোগ মাটির সঙ্গে শাসকের যোগাযোগ ছিন্ন করে... প্রতিনিয়ত।
ইতি,
সাধারণ মানুষ